লক্ষ্য অর্জনে হাতে থাকা ৮ দিনে ৫০ লাখ শিশুকে টিকা দেওয়া সম্ভবপর হচ্ছে না।
Published : 23 Oct 2022, 01:57 AM
গত ৮ সপ্তাহে ৫-১১ বছর বয়সী ৫০ লাখ শিশু করোনাভাইরাসের টিকা নিয়েছে, ফলে চলতি মাসের মধ্যে এই বয়সী ১ কোটি শিশুকে টিকার আওতায় আনার লক্ষ্য যে পূরণ হচ্ছে না, তা মানছেন সরকারের কর্মকর্তারা।
শিশুরা টিকা নিতে বেশ আগ্রহী হলেও ব্যবস্থাপনাগত কিছু জটিলতার কথা বলছেন তারা। এখন আশা করা হচ্ছে, নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে লক্ষ্য পূরণের।
দেশে মহামারী শুরুর পরের বছর ২০২১ সালের শুরুতেই টিকাদান শুরু হয়। প্রাপ্তবয়স্কদের দিয়ে শুরুর পর বছরের শেষে ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সীদেরও টিকার আওতায় আনা হয়।
তার প্রায় এক বছর পর ৫ থেকে ১১ বছর বয়সী শিশুদেরও টিকা দেওয়া শুরু করে সরকার।
গত ১১ অগাস্ট ঢাকার আবুল বাশার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১৭ শিক্ষার্থী পরীক্ষামূলকভাবে টিকা নেয়। শিশুদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি ফাইজারের এই টিকা সিটি করপোরেশন এলাকার ৫ থেকে ১১ বছর বয়সী শিশুদের পুরোদমে দেওয়া শুরু হয় গত ২৫ অগাস্ট।
এক কোটি স্কুল শিক্ষার্থীকে টিকা দেওয়ার এই বিশেষ ক্যাম্পেইন জেলা-উপজেলা পর্যায়ে শুরু হয় ১১ অক্টোবর, তিন সপ্তাহ অর্থাৎ ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত তা চলার কথা।
ঢাকার গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবু সাঈদ ভূঁইয়া জানিয়েছেন, তার স্কুলের ৫-১১ বছর বয়সী ১ হাজার ২০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে ১ হাজার ১৬০ জন কোভিড টিকা নিয়েছে।
“যারা নেয়নি, তাদের অধিকাংশই অসুস্থ ছিল। কেউ ঢাকার বাইরে বা দেশের বাইরে ছিল। অভিভাবকদের মধ্যে তেমন অনাগ্রহ দেখিনি। তবে কিছু শিশু এতটাই ভয় পেয়েছে যে, শেষ পর্যন্ত আর টিকা নিতে পারেনি।”
রাজধানীর বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নালন্দা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৫-১১ বছর বয়সী ৫৩৩ জন শিক্ষার্থীর ৪৫০ জন টিকা নিয়েছে।
বাকি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ থাকলেও ডেঙ্গু জ্বর, সিজন্যাল ফ্লু, চোখ ওঠা, হ্যান্ড-ফুট-মাউথসহ অন্যান্য রোগের কারণে টিকা নিতে পারেনি বলে জানান স্কুলের প্রধান শিক্ষক সুমনা বিশ্বাস।
“কিছু অভিভাবক আবার টিকা দেওয়ার আগ্রহ অনুভব করেননি। আর যারা অসুস্থ ছিল, আমরা তাদের দিইনি।”
সিটি করপোরেশন এলাকার বাইরের শিক্ষক, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, জেলা-উপজেলা পর্যায়েও টিকাদানে সাড়া মিলছে ভালোই।
ঢাকার সাভারের সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা রাহেনা বেগম জানান, তার দায়িত্বে থাকা আশুলিয়া, বিরুলিয়া ও ইয়ারপুর ইউনিয়নে ৪২ হাজার শিশুকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ১৩ হাজার শিশু টিকা পেয়েছে।
এই শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, “বাচ্চারা খুব আগ্রহ নিয়ে টিকা নিচ্ছে। এটা একটা উৎসবের মতো হয়ে গেছে।”
কেরানীগঞ্জের কালীগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বৃহস্পতিবার থেকে ৫-১১ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়া শুরু হয়।
প্রতিষ্ঠানটির সহকারী শিক্ষক তানজিনা আফরোজ মৌসুমী বলেন, “শিক্ষার্থীদের মাঝে বেশ আগ্রহ দেখছি। কেউ কেউ ভয় পেলেও আমরা তাদের মোটিভেট করছি। পরে তারা টিকা নিচ্ছে।”
রাজশাহী বিভাগের বগুড়া জেলার কাহালু উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হাসান আলী মোল্লা জানান, প্রতি স্কুলে ৫-৭ জন ছাড়া সব শিশুই টিকা নিচ্ছে।
“যারা বাদ যাচ্ছে, তাদের আমরা পাশের কেন্দ্রে দিয়ে দিব। আমাদের টার্গেট ১০০ ভাগ শিশুকে টিকা দিব।”
এই উপজেলায় ৫-১১ বছরের ২৭ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে, এ পর্যন্ত ৫ হাজার টিকা পাওয়ায় তা দিতে পেরেছেন বলে জানান এই কর্মকর্তা।
“যে ৫ হাজার টিকার সাপ্লাই পেয়েছি তা দিয়েছি। টিকা পাওয়ার ভিত্তিতে রোববার থেকে আবার টিকা দিতে পারব বলে আশা করছি।”
টিকা গ্রহণের পর শিশুদের হালকা ব্যথা ছাড়া তেমন কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার খবর পাননি জানিয়ে হাসান আলী মোল্লা বলেন, “ব্যথা বা হালকা জ্বরের বিষয়ে আগেই আমরা অভিভাবকদের কাউন্সেলিং করে নেই। জ্বর আসলে প্যারাসিটামল ট্যাবলেট খাওয়ার পরামর্শ দেই। অভিভাবকদের মধ্যে কোনো শঙ্কা নেই, শিক্ষার্থীদেরও কোনো সমস্যা হয়নি।”
গত ২৫ অগাস্ট থেকে দেশে এ পর্যন্ত ৫-১১ বছর বয়সী শিশুদের ৫০ লাখ ৭৬ হাজার ৩৪২ জন টিকা নিয়েছে।
লক্ষ্য পূরণে বাকি ১১ দিনে আরও ৫০ লাখ শিশুকে টিকার আওতায় আনা সম্ভবপর হবে কি না-প্রশ্নে
করোনাভাইরাসের টিকা ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব ডা. শামসুল হক স্বীকার করেন যে সম্ভবপর নয়।
এজন্য কিছু কারণ দেখিয়ে তিনি বলছেন, সাধারণ মানুষের তুলনায় শিশুদের আগ্রহ বেশি থাকলেও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে এক সপ্তাহ বেশি সময় লাগবে।
“আসলে তিন সপ্তাহ বলা হলেও আমাদের সময় ১৩ কর্মদিবস। এর মধ্যে পূজার ছুটি, শুক্র-শনিবার। আবার কোথাও কোথাও পরীক্ষা আছে। যেহেতু আমাদের ন্যাশনাল কোনো চাপ নাই, পর্যাপ্ত টিকা আছে এবং সেটার সময়ও আছে; তাই আমাদের একটু রয়ে-শয়ে কাজটা করতে হচ্ছে।”
তিনি বলেন, “প্রাইমারির সব স্কুলগুলোকে আমাদের টাচ করতে হচ্ছে। আমরা এক জায়গায় তাদের আনতে পারছি না। কারণ ছোট বাচ্চাদের নিয়ে আসলে ওদের অভিভাবকরাও চলে আসে। স্কুলে এত মানুষের জায়গা হয় না। এজন্য প্রতি স্কুলে টিম পাঠাতে হচ্ছে বলে টার্গেটে পৌঁছাতে সময় লাগবে।”
দেশে এই বয়সী শিশু রয়েছে ২ কোটি ২০ লাখ। গত ১৫ অগাস্ট স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানান, স্কুলের বাইরে থাকা শিশুদেরও টিকার আওতায় আনা হবে।
শামসুল হক বলছেন, লক্ষ্যমাত্রা থাকা এক কোটি শিশুকে টিকা দেওয়ার পর অন্যদের জন্য কমিউনিটি ক্যাম্পেইন করা হবে।
“হয়ত একটা ওয়ার্ডে ১০টা টিম পাঠাব, যারা বাদ পড়েছে, তারা নেবে। তারা রেজিস্ট্রেশন না করলেও সমস্যা নাই। বস্তির বা ভাসমান শিশুদের কার্ড দিয়ে টিকা দিয়ে দেব।”
শিশুদের কোভিড টিকার নিবন্ধন কীভাবে?
কোভিড টিকা: ছিন্নমূল ও স্কুলহীন শিশুদের নিয়ে দুশ্চিন্তা
জাতীয় সংসদে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে করোনাভাইরাসের ৩২ কোটি ৩১ লাখ টিকা এসেছে।
এর মধ্যে শনিবার পর্যন্ত প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছেন ১৩ কোটি ৫৯ লাখ ৪২ হাজার ২৭৭ জন। যাদের ১২ কোটি ৩৯ লাখ ৮৬ হাজার ২৮৭ জন দ্বিতীয় ও ৫ কোটি ৭৫ লাখ ৬৪ হাজার ৮৯৪ জন বুস্টার ডোজ নিয়েছেন।
প্রথম ডোজ নেওয়ার সুযোগ থাকছে
৮ অক্টোবরের পর আর প্রথম ডোজ টিকা নেয়ার সুযোগ থাকবে না বলে জানিয়েছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, টিকা কেন্দ্রগুলোতে এখনও প্রথম ডোজ টিকা পাওয়া যাচ্ছে।
করোনাভাইরাসের টিকা ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব শামসুল হক জানান, প্রথম ডোজ দেওয়া বন্ধ করে দিলেও কেন্দ্রে এসে যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে কেউ কেউ তা নিতে পারছেন।
“অনেকে বলে, তারা দেশে ছিল না। যেহেতু ভ্যাকসিন আছে, সেহেতু আমরা তাদের দিচ্ছি। অনেকের বয়স ১১ ছিল, ওদের ১২ হয়ে গেছে। এই গ্রুপটা মূলত টিকাটা নিচ্ছে।”
দ্বিতীয় ও বুস্টার ডোজ চললেও বুস্টার ডোজ নেওয়ার ক্ষেত্রে মানুষের তেমন আগ্রহ দেখছে না তিনি।
“অনেক সহজে টিকা পেয়ে গেছে তো, তাই আগ্রহ কমে গেছে। এখন সামনে কী হবে, আমরা জানি না। সামনে টিকা আসবে কি না, সেই নিশ্চয়তা কিন্তু আমরা দেব না।”
ডা. শামসুল বলেন, “ভারতে ফাইজারের এক ডোজ টিকা নিতে ৫ হাজার টাকা লাগে। ফাইজার আমাদেরও হাতে আছে। একসময় তো সেটাও শেষ হবে। তখন সরকারের কেনাটাও কঠিন হবে। এখন আপনি ভ্যাক্সিন নিচ্ছেন না, ভ্যাক্সিন নষ্ট হয়ে গেলে সরকার কি আবার কিনে দেবে? সরকার তো বার বার টাকা খরচ করতে পারবে না।”