যথেষ্ট পেয়েছি এদেশ থেকে: জন্মদিনে রুনা লায়লা

বাংলাদেশের সংগীতের এই জীবন্ত কিংবদন্তী বলেন, “কখনও বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশে বসবাসের কথা ভাবিনি। আমার মনে হয় আমি এখান থেকেই যথেষ্ট পেয়েছি।”

মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Nov 2022, 10:07 AM
Updated : 17 Nov 2022, 10:07 AM

শৈশব আর ক্যারিয়ারের শুরুর সময়টা পাকিস্তানে কাটলেও স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ফিরেছিলেন রুনা লায়লা, ১৮ ভাষায় হাজারো গান গেয়ে ছড়িয়ে দিয়েছেন সংগীতের দ্যুতি; গানে গানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সমাদৃত হলেও বাংলাদেশেই প্রাণ খুঁজে পেয়েছেন কিংবদন্তী এই শিল্পী।

নিজের ৭০তম জন্মদিনে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বললেন, “কখনও বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশে বসবাসের কথা ভাবিনি। আমার মনে হয় আমি এখান থেকেই যথেষ্ট পেয়েছি।

“সবচেয়ে বড় কথা, শ্রোতাদের থেকে যে ভালোবাসা ও সম্মান পেয়েছি, সেটাই আমার বড় পাওয়া। এর থেকে বেশি কিছু চাওয়ার নেই আমার।”

১৯৫২ সালের ১৭ নভেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সিলেটে জন্ম হয় জনপ্রিয় এই শিল্পীর। বাবা সৈয়দ মোহাম্মদ এমদাদ আলী ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা এবং মা আমেনা লায়লা ছিলেন সংগীত শিল্পী। মামা সুবীর সেনও ভারতের প্রখ্যাত শিল্পী।

বাবার বদলির চাকরির কারণে আড়াই বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে রাজশাহী থেকে পাকিস্তানের মুলতানে চলে গিয়েছিলেন। শৈশব কাটে পাকিস্তানের লাহোরে। সেখানেই উচ্চাঙ্গ সংগীতে দীক্ষা নেন ওস্তাদ হাবিব উদ্দিন খান ও আবদুল কাদের পিয়ারাংয়ের কাছে। গজলে দীক্ষা পান পণ্ডিত গোলাম কাদিরের (মেহেদি হাসানের ভাই) কাছে।

গান দিয়ে জীবনের যাত্রা আর প্রাপ্তির কথা স্মরণ করে সাতবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারজয়ী এ শিল্পী বলেন, “আমি ১২ বছর বয়সে গান গাওয়া শুরু করেছি। তখন ভাবিনি এত কিছু পাব। এটা ধীরে ধীরে হয়েছে।

“১৯৭৪ সালের জানুয়ারিতে আমি বাংলাদেশে আসি। ৭৪ সালের নভেম্বরে ইনডিয়ান কালচারাল সেন্টার ফর রিলেশন্সের (আইসিসিআর) আমন্ত্রণে ভারতে যাই। সেখানে তিনটি অনুষ্ঠান করেছিলাম। দিল্লি, মুম্বাইতে অনেক শিল্পী, সংগীত পরিচালকদের সঙ্গে দেখা হল। সবাই একটাই কথা বললেন, তারা আমার গান আগে শুনেছেন। যখন আমি পাকিস্তানে সিনেমায়, রেডিওতে গান করেছি, তারা সেসব গান শুনেছেন। আমার গলা তাদের পরিচিত।”

রুনা লায়লা বলেন, “ধীরে ধীরে ভারতে গাইতে শুরু করলাম। এভাবে পরিচিতি বাড়ল। গান ছড়িয়ে গেল। আমার সবকিছু খুব সুন্দরভাবে এগিয়েছে। ভারত বলুন, পাকিস্তান বলুন কিংবা কানাডা, আমেরিকা, লন্ডন– যেখানেই গেছি, শ্রোতাদের অঢেল ভালোবাসা পেয়েছি। যে ধরনের সম্মান ও ভালোবাসা পেয়েছি, তার জন্য আমি আল্লাহর শোকর আদায় করি। এটাই আমার জীবনের সেরা পাওয়া।”

Also Read: দিদি, আমার সবচেয়ে বড় উপহার তো আপনি: লতার স্মরণে রুনা

Also Read: রুনা লায়লার ঊনসত্তর

সিনেমায় প্রথম গানকে জীবনের ‘টার্নিং পয়েন্ট’ বলে মনে করেন এই শিল্পী। তার ভাষায়, “পাকিস্তানি সিনেমায় গাওয়া প্রথম গানের কথা ছিল এমন, ‘মারনা ভি নেহি আসান, জিনা ভি কেয়ামত হ্যায়’। গানটা পর্দায় দেখানো হয়েছিল একটা বাচ্চা ছেলের লিপে। এরপর একের পর এক গানের প্রস্তাব আসে। ১২ বছর বয়সে আমার গান নায়িকাদের লিপে বাজানো হয়েছে।”

গজলশিল্পী হিসাবে দক্ষিণ এশিয়ায় খ্যাতি রয়েছে রুনা লায়লার। পাঁচ দশকের বেশি সময়ের সংগীত জীবনে ১৮ ভাষায় ১০ হাজারের বেশি গান করেছেন। বাংলা ছাড়াও উর্দু, হিন্দি  পাঞ্জাবি, সিন্ধি, গুজরাটি, পশতু, বেলুচি, আরবি, পারসিয়ান, মালয়, নেপালি, জাপানি, ইতালীয়, স্প্যানিশ, ফরাসি ও ইংরেজি ভাষায় গান করেছেন।

শুধু গানই নয়, চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘শিল্পী’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন রুনা লায়লা।

কিংবদন্তী শিল্পীদের নিয়ে বায়োপিক কিংবা বায়োগ্রাফি লেখা হয়, রুনা লায়লা সেই প্রস্তাব পাননি? উত্তরে এই শিল্পী বললেন, “অনেকজনই বলেছেন। কথা খুব বেশি এগোয়নি। এটা নিয়ে সিরিয়াসলি এখনও চিন্তা করিনি। তবে লতা মঙ্গেশকরের ভাতিজা বৈজনাথ মঙ্গেশকর বলেছিলেন, ‘আপনার বায়োগ্রাফিটা আমি লিখে দেব’। আমি বলেছিলাম, ঠিক আছে। কিন্তু সময় হয়ে ওঠেনি।”

কথায় কথায় বাংলা গানের সংকট আর উত্তরণের পথভাবনাও আসে। স্বাধীনতা পদকজয়ী রুনা লায়লা বলেন, “উপমহাদেশ জুড়েই গান ও সিনেমার ধরন পুরো বদলে গেছে। আগের মত কিছুই নেই। এখন ভালো কাজ হচ্ছে না, তা বলব না। তবে সংখ্যায় খুবই কম।

“যার কারণে পুরনো কাজগুলোই মানুষ খুঁজে খুঁজে দেখে, পুরনো গানগুলোই শোনে। একসময় অনেক বড় বড় প্রযোজক, নির্মাতা ছিলেন। তারা সুন্দর সুন্দর সিনেমা বানিয়েছেন। সেসব সিনেমায় সুন্দর সুন্দর গান থাকত। এখন এসব খুব একটা হচ্ছে না।”

রুনা লায়লা ক্যারিয়ার জুড়ে পেয়েছেন নানা পুরস্কার। তার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ থেকে ছয় বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার। এছাড়া ভারত থেকে পেয়েছেন সায়গল পুরস্কার। পাকিস্তান থেকে অর্জন করেছেন নিগার, ক্রিটিক্স, গ্র্যাজুয়েটস পুরস্কারসহ জাতীয় সংগীত পরিষদ স্বর্ণপদক।

পুরনো দিনের কথা মনে করে তিনি বলেন, “তখন সময় নিয়ে কাজ করা হত। আমরা একটা গানের জন্য দুদিন রিহার্সাল করতাম। তারপর মিউজিকের সঙ্গে রিহার্সাল করে লাইভে রেকর্ড হত। অনেক সময় দেখা গেছে, বিকালে রেকর্ড শুরু হয়ে পরের দিন সকালে গিয়ে শেষ হচ্ছে।

“লাইভ রেকর্ডিং হত। কেউ একটু ভুল করলে আবার প্রথম থেকে শুরু হত। ফলে পুরো গানটায় আবেগের একটা ফ্লো থাকত। এখন এক লাইন দুই লাইন করে রেকর্ড হয়। ওইটাই কাট পেস্ট করে লাগিয়ে দেয়। এখন গাওয়ার প্রতি ফিলিংস, ইমোশন ও ইনভলভমেন্টটা কমে গেছে। তারপরও কিছু তরুণ ভালো কাজ করছে।”

সংকট উত্তরণের উপায় নিয়ে ‘দামা দম মাস্ত কালান্দার’খ্যাত শিল্পী বলেন, “প্রডিউসার, ডিরেক্টররা যদি ভালো গান করার সুযোগ করে দেয়, সেভাবে সময় দেয়, ভালো পারিশ্রমিক দেয়, তাহলে নিশ্চয় হবে। আমাদের দেশে প্রচুর মেধাবী শিল্পী আছে। কিন্তু তারা নিজেকে মেলে ধরার সুযোগটা পাচ্ছে না। তাদের সুযোগ করে দিতে হবে।”

উপমহাদেশের আরেক কিংবদন্তী শিল্পী প্রয়াত লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল রুনা লায়লার। জন্মদিনে লতাজির প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “প্রতি বছর আমার জন্মদিনে তিনি আমাকে শাড়ি উপহার দিতেন। গত বছর বললেন, সামনের ১৭ তারিখ তো আপনার জন্মদিন। এবারের উপহারটা কী পাঠিয়ে দেব? বললাম, আমি তো থাকছি না। লন্ডন যাচ্ছি। তিনি বললেন, ঠিক আছে ঘুরে আসেন। তারপর পাঠাব। কিন্তু তা আর হল না।”