Published : 03 May 2025, 01:38 AM
সংস্কৃতি উপদেষ্টার হস্তক্ষেপের অভিযোগসহ আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কথা বলে সৈয়দ জামিল আহমেদ সেই যে মহাপরিচালকের পদ ছাড়লেন, তারপর থেকে দুই মাস ধরে অভিভাবকহীন শিল্পকলা একাডেমি
এই সময়ে পরিষদের কোনো সভা শিল্পকলায় হয়নি। শিল্পকলা একাডেমির সচিব মোহাম্মদ ওয়ারেছ হোসেনকে ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। শিল্পকলা চলছে মূলত সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে।
তাতে শিল্পকলার কর্মকাণ্ড হয়ত বন্ধ হয়ে যায়নি, কিন্তু স্থবিরতা তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন বর্তমান পরিষদের সদস্য অভিনেতা ও নাট্যনির্দেশক আজাদ আবুল কালাম।
তবে সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলছেন, শিল্পকলার কর্মকাণ্ড থেমে নেই। শিল্পকলাকে ‘অভিভাবকহীন’ মানতেও তিনি রাজি নন।
গত ৯ এপ্রিল শিল্পকলার বর্ষবরণের অনুষ্ঠান নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে ফারুকী বলেছিলেন, “অভিভাবকহীন হলে শিল্পকলা একাডেমি এতগুলো প্রোগ্রাম করতে পারত না। অভিভাবকহীন একটা শিল্পকলা একাডেমি এ ধরনের প্রোগ্রাম করতে পারে না। তারা যথেষ্ট সক্ষমতার পরিচয় দিচ্ছে।”
শিল্পকলা একাডেমির আইন অনুযায়ী পরিচালনা পরিষদ থেকে কর্মপরিকল্পনা তৈরি হয়ে আসার কথা। পরিষদই একাডেমির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী সভা। কিন্তু মহাপরিচালক না থাকায় এখন শিল্পকলা কী করবে তা নির্ধারণ করে দিচ্ছে মন্ত্রণালয়।
একাডেমির কার্যাবলী পরিষদ সভায় অনুমোদিত হওয়ার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু শিল্পকলার পরিচালনা পরিষদকে রাখা হয়েছে নিষ্ক্রিয় করে।
প্রতি তিন মাস পর পর পরিষদের সভা করার নিয়ম থাকলেও জুলাইয়ের পটপরিবর্তনের পর পরিষদের সদস্য বদল হয়েছে এবং নতুন সদস্যদের নিয়ে সভা হয়েছে মাত্র একবার।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ও নিয়মিত পরিষদের সভা করেননি সেই সময়ের মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ এক বছর শিল্পকলায় পরিষদের কোনো সভা হয়নি।
মূলত ‘নানা রকম অনিয়ম করার জন্যই’ পরিষদের তোয়াক্কা করতেন না লাকী– এমন অভিযোগ সেই সময়কার পরিষদ সদস্যরা এনেছিলেন ।
কিন্তু জুলাইয়ের পট পরিবর্তনের পরের বাস্তবতায় শিল্পকলায় পরিষদের সভা নিয়মিত না হওয়াটা কাম্য নয় বলে মনে করেন সদস্যরা।
শিল্পকলার পরিচালনা পরিষদের তিনজন সদস্যের সঙ্গে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এ বিসয়ে কথা বলেছে। তারা বলছেন, সভা না হলে পরিষদের সদস্যদের কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। ওই তিন সদস্যের একজন পদত্যাগ করার কথাও ভাবছেন।
কেন সভা হচ্ছে না?
শিল্পকলা একাডেমির আইন অনুযায়ী পরিচালনা পরিষদের বৈঠক ডাকার কথা সভাপতির এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীই পরিষদের সভাপতি থাকেন।
একাডেমির মহাপরিচালক পরিষদের সদস্য-সচিবের দায়িত্ব পালন করেন এবং পরিষদে গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নই মহাপরিচালকের কাজ।
শিল্পকলার আইন অনুযায়ী বিশেষ পরিস্থিতিতে পরিষদের সভাপতি যে কোনো সময় পরিষদের সভা আহ্বান করতে পারেন। কিন্তু সৈয়দ জামিল আহমেদ গত ২৮ ফেব্রুয়ারি মহাপরিচালকের পদ ছাড়ার পর কোনো সভা আহ্বান করা হয়নি।
পরবর্তী সভা কবে হবে, পরিষদের সদস্যরা তা জানেন না।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে শিল্পকলা একাডেমির ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ ওয়ারেছ হোসেন বলেন, এটা তার জানা নেই।
এ ব্যাপারে কিছু জানতে চাইলে সংস্কৃতি উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি।
সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে ১৭ এপ্রিল থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত অন্তত ১৫ বার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। সর্বশেষ ২৬ এপ্রিল বিকাল ৫টায় হোয়াটসঅ্যাপে সুনির্দিষ্ট দুটি প্রশ্ন পাঠিয়েও তার সাড়া পাওয়া যায়নি।
শিল্পকলার বর্তমান পরিষদের সদস্য এবং অভিনয় শিল্পী সংঘের সভাপতি আজাদ আবুল কালাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা যারা পরিষদের সদস্য হিসেবে আছি, আমাদের তো কথা বলার জায়গা হল পরিষদ সভা। সেই সভা না হলে তো আমাদের কথা বলার সুযোগও নাই। ফলে শিল্পকলার ব্যাপারে এখন আমরা খুব বেশি জানি না। আপনি যেমনটা দেখছেন, আমিও তা-ই দেখছি।”
পরিষদের আরেক সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা নিত্রা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি পরিষদের সদস্য হওয়ার পর একটা মাত্র সভা হয়েছে। সেই সভায় আমরা কিছু পরিকল্পনা করেছিলাম। এরপর তো আর সভা হয়নি। পরবর্তী সভা হলে বুঝতে পারব আমাদের পরিকল্পনার বাস্তবায়ন কতদূর হয়েছে। আশা করছি পরের সভা দ্রুতই হবে। তবে কবে হবে, তা এখনও জানি না।”
পরিষদ কী নিষ্ক্রিয়?
সবশেষ গত অক্টোবরে শিল্পকলা একাডেমির পরিচালনা পরিষদ পুনর্গঠন করা হয়। পরিষদের সদস্য মনোনীত হন লেখক-গবেষক আলতাফ পারভেজ; ছায়ানটের সংগীত শিক্ষক লায়েকা বশীর; নৃত্যশিল্পী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃত্যকলা বিভাগের শিক্ষক র্যাচেল অ্যাগনেস প্যারিস; নাট্যাভিনেত্রী, নাট্যকার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা নিত্রা।
এছাড়া ঢাকা বিভাগ থেকে আজাদ আবুল কালাম, চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে জয়দেব রোয়াজা, রাজশাহী বিভাগ থেকে আসাদুজ্জামান দুলাল, খুলনা বিভাগ থেকে শিপন, বরিশাল বিভাগ থেকে দেবাশীষ চক্রবর্তী, সিলেট বিভাগ থেকে শামসুল বাসিত শেরো, রংপুর বিভাগ থেকে ইফতেখারুল আলম রাজ ও ময়মনসিংহ বিভাগ থেকে কমল কান্তিকে সদস্য মনোনীত করা হয়।
আজাদ আবুল কালাম বলেন, “সৈয়দ জামিল আহমেদ মহাপরিচালক থাকার সময় যে পরিষদ সভা হয়েছিল, সেখানে আমরা সারা দেশে কাজের ব্যাপারে বেশ কিছু পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। সেগুলো তো এখন থেমে আছে।”
শিল্পকলার মত প্রতিষ্ঠানে মহাপরিচালক না থাকলে কাজে গতি আসবে না বলেও মনে করেন তিনি।
“শিল্পকলার কাজের ব্যাপ্তি সারা দেশে। এরকম একটা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘ সময় মহাপরিচালকহীন থাকলে কাজ থেমে থাকবে। দ্রুত মহাপরিচালকে নিয়োগ দেওয়া উচিত এবং সেই সাথে পরিষদের সভাও নিয়মিত হওয়া উচিত।”
পরিষদের আরেক সদস্য আলতাফ পারভেজ বলছেন, তিনি শিল্পকলার পরিষদ থেকে পদত্যাগের কথা ভাবছেন।
“বর্তমান পরিষদ গঠিত হওয়ার পর একটি সভা হয়েছে, সেই সভাতে আমি ব্যক্তিগত কারণে উপস্থিত থাকতে পারিনি। এরপর তো আর সভা হয়নি। আমি পদত্যাগের চিঠি ড্রাফট করে রেখেছি। সেটি এখনো পাঠানো হয়নি। শিগগিরই পাঠিয়ে দেব।”
পরিষদকে তোয়াক্কা করতেন না লাকীও
শিল্পকলা একাডেমির পরিচালনা পরিষদকে তোয়াক্কা না করে বিগত মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী নানা অনিয়ম করেছেন এবং সেসব নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদও প্রকাশ হয়েছে।
লাকীর মেয়াদে পরিষদের সদস্য ছিলেন, এমন তিনজন সদস্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, লিয়াকত লাকী পরিষদকে না জানিয়েই নানা রকম সিদ্ধান্ত নিতেন। তারা সেসব বিষয়ে অভিযোগও করেছেন, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।
‘পরিচালনা পরিষদ কেবল নামেই, শিল্পকলায় লাকীই সব?’ শিরোনামে ২০২৩ সালের ২১ জুন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
লাকির আমলে শিল্পকলা একাডেমির পরিচালনা পরিষদের সবশেষ সভা হয়েছিল ২০২৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর। জুলাইয়ের পটপরিবর্তনের পর গত ১৮ ডিসেম্বর পরিষদ সভা হয়েছে।
গত বছর ৫ অগাস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে মহাপরিচালকের পদ ছাড়েন লিয়াকত আলী লাকী। পরে ৯ সেপ্টেম্বর মহাপরিচালক পদে নাট্যনির্দেশক ও গবেষক অধ্যাপক সৈয়দ জামিল আহমেদকে দুই বছরের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়। পুনর্গঠন করা হয় শিল্পকলা একাডেমির পরিষদ।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে হঠাৎ নিজের পদত্যাগের ঘোষণা দেন সৈয়দ জামিল আহমেদ। পরে পদত্যাগের কারণ তুলে ধরে সংবাদমাধ্যমে লিখিত বক্তব্যও দেন।
জামিল আহমেদ পদত্যাগের পর বলেছিলেন, তার মেয়াদে যে একমাত্র সভাটি করা হয়েছিল, তার অনুমোদন সই করতেই মন্ত্রণালয় এক মাস সময় নিয়েছিল। পরের সভা তিন মাসের মধ্যে করা যাবে কিনা, তা তিনি জানেন না।
জুলাই পরিবর্তনের পর কী করছে শিল্পকলা?
৫ অগাস্ট পরবর্তী সময়ে দেশের অন্তত ২২টি জেলা ও উপজেলা শিল্পকলা একাডেমিতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এতে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ে শিল্পকলা একাডেমি।
বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় দায়িত্বরত কালচারাল অফিসারদের মনোবল ভেঙে পড়ে। তবে মহাপরিচালক সৈয়দ জামিল আহমেদ দ্রুতই তাদের মনোবল চাঙ্গা করতে পেরেছিলেন।
গত ডিসেম্বরে সারা দেশে একযোগে জাতীয় যন্ত্রসংগীত উৎসব, কাওয়ালি সন্ধ্যা, গণ-অভ্যুত্থানের গান, আদিবাসী সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠান, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে নিয়ে আলোকচিত্র প্রশিক্ষণ, সাপ্তাহিক বাহাস সিরিজ, ভ্রাম্যমাণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, জেলায় জেলায় শিল্পীদের জন্য গবেষণা বৃত্তি ঘোষণা ও প্রস্তাব আহ্বান, ৬৪ জেলায় জাতীয় নাট্যকর্মশালা, ভাওয়াইয়া গানের অনুষ্ঠান, রাজধানীর বাইরে নাট্য প্রদর্শনী, লোকসাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নতুন ওয়েব জার্নাল প্রকাশসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করে শিল্পকলা একাডেমি।
জানুয়ারি মাসে শিল্পকলা একাডেমি আয়োজন করে ‘তারুণ্যের উৎসব ২০২৫’। বিভাগ, জেলা ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে এসব কর্মসূচি হয়। ৫০টি জেলায় তিন দিনব্যাপী নৃত্যানুষ্ঠান, রাজশাহীতে দুই দিনব্যাপী রাজোয়াড় জাতিগোষ্ঠীর আল্পনাচিত্র প্রদর্শনী এবং ১৩টি জাতিগোষ্ঠীর নৃত্য-গীত ও নাট্যানুষ্ঠান করে একাডেমি।
ওই মাসেই ‘দেশব্যাপী অ্যাক্রবেটিক প্রদর্শনী’, ‘ষষ্ঠ জাতীয় ভাস্কর্য প্রদর্শনী’, ‘দেবাশিস চক্রবর্তীর পোস্টারে জুলাই অভ্যুত্থান’ শীর্ষক প্রদর্শনী ছিল আলোচিত অনুষ্ঠান।
সমুদ্রসৈকতে দুই দিনব্যাপী রাখাইন ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর সম্প্রীতি সমারোহ, ছয় জেলায় ব্যান্ডসংগীত, রাজধানীতে ভাববিনিময় সভা, সাধুমেলা প্রভৃতির আয়োজন করা হয়। ‘অষ্টাদশ জাতীয় পিঠা উৎসব ১৪৩১’ জানুয়ারিতে শুরু হয়ে শেষ হয় ৮ ফেব্রুয়ারি।
ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে শিল্পকলা একাডেমি আয়োজন করে ‘বহুভাষিক উৎসব’। উৎসবের অংশ হিসেবে জেলা, বিভাগ ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে বহুভাষিক চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, মনীষী স্মরণ অনুষ্ঠান, ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ভাষা এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিষয়ক লেকচার ওয়ার্কশপ, শিশু-কিশোরদের নিয়ে আলোকচিত্র কর্মশালা, শাস্ত্রীয় সংগীত ও নৃত্য উৎসব, পথনাট্য উৎসব, লোকনাট্য উৎসব এবং ‘মুনীর চৌধুরী প্রথম জাতীয় নাট্যোৎসবে’র আয়োজন করে একাডেমি।
২৮ ফেব্রুয়ারি ‘মুনীর চৌধুরী প্রথম জাতীয় নাট্যোৎসব’-এর সমাপনী অনুষ্ঠানেই সবার সামনে পদত্যাগপত্র হস্তান্তর করেন সৈয়দ জামিল আহমেদ।
সৈয়দ জামিলের পদত্যাগের পর শিল্পকলা গেল ঈদের আগের দিন চাঁদ রাতের অনুষ্ঠান আয়োজন করে। এপ্রিলে বাংলা বর্ষবরণ উপলক্ষে কনসার্ট, ড্রোন শো, সাধুমেলা, লোকনাট্যের আসর আয়োজন করা হয়। এর আগে মার্চ মাসে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানসহ কিছু আয়োজন ছিল।