নারায়ণগঞ্জে সিনেমা হলগুলো ধুঁকছে, ভিড় সিনেস্কোপে

আলোচিত ‘হাওয়া’ সিনেমা যখন নিউ মেট্রোতে দর্শক টানতে পারছে না, সেখানে সিনেস্কোপে টিকেট পাওয়া দুষ্কর।

সৌরভ হোসেন সিয়াম, নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 August 2022, 05:55 PM
Updated : 9 August 2022, 05:55 PM

শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টা। নারায়ণগঞ্জ নগরীর গুলশান সিনেমা হলে রাতের প্রদর্শনী শুরু হলেও দর্শক তেমন নেই। উপর ও নিচতলা মিলিয়ে সাত শতাধিক আসনের প্রায়গুলোই ফাঁকা। একই দশা নিউ মেট্রো সিনেমা হলের। আলোচিত ‘হাওয়া’ সিনেমা দেখতে ৮০০ আসনের হলে টিকেট কেটেছেন মোটে ৫৯ জন।

‘হাওয়া’ দেখতে যেখানে নিউ মেট্রোতে দর্শক নেই, সেখানে সদ্য চালু হওয়া সিনেস্কোপে সেই একই সিনেমার টিকেটের জন্য চলছে হা-পিত্যেস। গত এক সপ্তাহে ‘হাওয়া’র ২৮টি শোর সবগুলোই হাউজফুল।

অথচ এক সময় জৌলুস নিয়েই চলেছে গুলশান কিংবা নিউ মেট্রো প্রেক্ষাগৃহ। দর্শকরা হুমড়ি খেয়ে পড়তেন। টিকেট কাটার জন্য পড়ত লম্বা সারি। টিকেট কালোবাজারিদের হাঁকডাকে মুখরিত ছিল সামনের সড়ক। সেই দিনগুলো এখন কেবল অতীত।

বন্দর ও শিল্প নগরী নারায়ণগঞ্জ শহরটি ছোট হলেও এক দশক আগে এক কিলোমিটারের মধ্যেই ছিল ছয়টি সিনেমা হল। নগরীর দুই নম্বর রেলগেইট এলাকার ‘ডায়মন্ড সিনেমা হল’ এবং মিনাবাজার এলাকার দৃষ্টিনন্দন ‘হংস থিয়েটার’ আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। সেখানে উঠেছে বহুতল বাণিজ্যিক ভবন। বছর তিনেক আগে ভেঙে ফেলা হয় ‘আশা’ ও ‘মাসার’ সিনেমা হল। সেখানে এখন গুদাম।

শহরের অদূরে সিদ্ধিরগঞ্জের চারটি সিনেমা হলও বন্ধ হয়ে গেছে। গোদনাইলের জনপ্রিয় ‘বন্ধু’ সিনেমা হলের জায়গায় এখন কমিউনিটি সেন্টার। আদমজীনগরের ‘মুনলাইট’ ও সিদ্ধিরগঞ্জ হাউজিং এলাকার ‘গোধূলি’ সিনেমা হল দুটিও বন্ধ। এই অঞ্চলের ’রংধনু’ সিনেমা হল ভেঙে এখন খাদ্যগুদাম হিসেবে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। জালকুড়িতে ‘রাজমহল’ প্রেক্ষাগৃহ এখনও চালু থাকলেও সেখানে ‘অশ্লীল’ সিনেমা প্রদর্শনের অভিযোগ রয়েছে।

দর্শক না পেয়ে কয়েক বছর আগে বন্ধ হয়ে গেছে সদর উপজেলার কাশীপুরে ঢাকা-মুন্সিগঞ্জ সড়কের পাশে অবস্থিত ‘সম্রাট’ সিনেমা হলটিও। এটি এখন পোশাক কারখানা। বন্দর উপজেলার ‘রূপালী’ সিনেমা হলের জায়গায় উঠেছে বাণিজ্যিক ভবন। তবে শিল্পনগরী বিসিকের পাশে পঞ্চবটি এলাকায় অবস্থিত ‘বনানী’ সিনেমা হলটি এখনও চালু আছে।

হলমালিক ও সংশ্লিষ্টজনরা বলছেন, আয়তনে ছোট হলেও ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে নারায়ণগঞ্জ শহর দেশের অন্যতম ব্যস্ত শহর। রাজধানীর পর অল্পদূরত্বে এতগুলো সিনেমা হল কেবল এই শহরেই ছিল। তখন বাংলা সিনেমারও ছিল সুদিন। নব্বইয়ের দশকেও আগে সিনেমা মুক্তি দেওয়া নিয়ে প্রতিযোগিতা হত। একই সিনেমা চলত একাধিক হলে। তবে এ শতাব্দী শুরু থেকেই হলগুলো দর্শক হারাতে থাকে।

এর পেছনে নিম্নমানের সিনেমা, অশ্লীল দৃশ্য প্রদর্শন, পাইরেসি, ইন্টারনেটের সহজলভ্যতাকে সামনে আনেন অনেকে। ফলে একের পর এক হল বন্ধ হতে শুরু করে।

শুক্রবার নিউ মেট্রো সিনেমা হলে আলোচিত ‘হাওয়া’ সিনেমার প্রদর্শনী শুরু হয়। সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও আট শতাংশ টিকেট বিক্রি হয়নি।

হলের ব্যবস্থাপক জাহিদ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন তো ছবির বাজার খুব খারাপ। কয়েক সপ্তাহ আগেও সর্বোচ্চ ২৫টা টিকেট বিক্রি করেছি। সেই অনুযায়ী গত দুই সপ্তাহে দর্শক বেড়েছে। তবে এভাবে চললে হল টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।”

এক সময় মেট্রো হলে ২৮ জন কর্মী ছিল। এখন আছেন মাত্র দুজন। তাদেরও বেতন দেওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে বলে জানান ব্যবস্থাপক। প্রায় সময়ই বিদ্যুৎ বিলও তোলা সম্ভব হয় না।

এক সময় দর্শক সামলানো মুশকিল হয়ে পড়ত নারায়ণগঞ্জের হলগুলোতে। শহরে সিনেমা হল বেশি থাকায় চলচ্চিত্রের মুক্তি নিয়ে টানাটানি লেগে যেত। সেই স্মৃতি মনে পড়লে এখনও উত্তেজনায় শরীরে লোম দাঁড়িয়ে যায় পঞ্চাশোর্ধ্ব আনোয়ার হোসেনের। গুলশান সিনেমা হলে লাইটম্যানের কাজ করেন তিনি।

তিনি বলেন, “মানুষের ভিড় দেইখা ভয় পাইয়া যাইতাম। টিকেট না পাইয়া ভাঙচুরও করত। সিনেমা হলে প্লাস্টিকের বোতল কুড়িয়েও দুই-তিনশ’ টাকা রোজগার করা যেত। আর এখন তিনজন দর্শক দিয়াও সিনেমা চালাইতে হয়।”

৩২ বছর গুলশান সিনেমা হলের সঙ্গে যুক্ত তপন দে। তিনি এখন প্রেক্ষাগৃহটির ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে। তার বাবাও আমৃত্যু ছিলেন এই হলের সঙ্গে। হলের ভালোর পাশাপাশি খারাপ দিনগুলোরও সাক্ষী তপন দে’র ভাষ্য, দর্শক না হওয়ার পেছনে বড় কারণ মানসম্মত সিনেমা তৈরি না হওয়া এবং স্মার্টফোন-ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা। পাশাপাশি দর্শক টানতে হলগুলোর অবকাঠামোর উন্নয়ন প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি।

মেট্রো হলে ‘হাওয়া’ সিনেমা দেখতে আসা চিত্রশিল্পী জিয়াউর রহমানও একই কথা বলেন।

প্রায় সাত বছর পর হলে এসেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “এক সময় হলে এসে প্রচুর সিনেমা দেখেছি। শুধু ইন্টারনেট না, হলের পরিবেশ এবং ভালো সিনেমাও একটা ব্যাপার। মানুষ শুধু সিনেমা নয়, হলের পরিবেশও উপভোগ করে। অনেক হলেই সাউন্ড সিস্টেম বা স্ক্রিনিং ভালো হচ্ছে না। এসব দিকে উন্নতির পাশাপাশি মানসম্মত সিনেমা মানুষকে হলে টেনে নিয়ে আসবে।”

সাড়া ‘সিনেস্কোপে’

পুরনো প্রেক্ষাগৃহ যখন দর্শক খরায় ধুঁকছে, তখন নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রথম মিনিপ্লেক্স ‘সিনেস্কোপে’ বিপরীত চিত্র। গত এক সপ্তাহে ‘হাওয়া’ চলচ্চিত্রের ২৮টি প্রদর্শনীর সবগুলো হাউজফুল হয়েছে। আগের দুই সপ্তাহে ‘পরান’ ও ‘দিন দ্য ডে’ও দর্শক পেয়েছে। চলতি সপ্তাহেরও অধিকাংশ টিকেট অগ্রিম বিক্রি হয়ে গেছে।

২০১৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর চলচ্চিত্র উৎসবের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে ৩৫ আসনের এই মিনিপ্লেক্স। শহরের ডিআইটিতে আলী আহাম্মদ চুনকা নগর পাঠাগার ও মিলনায়তনের পরিত্যক্ত পাতাল মেঝেতে সীমিত আসনের আধুনিক একটি প্রেক্ষাগৃহ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন স্থপতি মোহাম্মদ নূরুজ্জামান। তিনি স্বাধীন ধারার চলচ্চিত্র নির্মাতাও। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সঙ্গে যৌথভাবে পরিচালিত শীততাপ নিয়ন্ত্রিত মিনিপ্লেক্সটিতে ফোর-কে সিলভারস্ক্রিনের পাশাপাশি সাত দশমিক এক ডলবি ডিজিটাল অডিও সিস্টেম, থ্রি-ডি সিনেমা দেখার ব্যবস্থা রয়েছে।

সিনেস্কোপের নির্বাহী পরিচালক রবি বলেন, হলের প্রতি মানুষের টান এখনও আছে। মানুষ যাতে পরিবার নিয়ে সুন্দর একটি পরিবেশে সিনেমা দেখতে পারেন, সেই চিন্তা থেকে সিনেস্কোপের যাত্রা শুরু হয়েছে।

তিনি বলেন, “ভালো সিনেমায় ভালো সাড়া পড়ে। পরপর তিনটি সিনেমাতেই দর্শকদের ব্যাপক আগ্রহ ছিল। এর আগেও কয়েকটি সিনেমা ভালো চলেছে। দর্শকদের বড় একটি অংশ নারী। আগেও তেমন ছিল। নারীরা কিন্তু একা আসেন না, দলবেঁধে সিনেমা দেখতে আসেন। যে সিনেমা নারীরা দেখবেন সেই সিনেমাই ব্যবসা-সফল হয়। নারীবান্ধব সিনেমা হলের খুবই অভাব এখন এই শহরে।”

তবে সিনেস্কোপের যাত্রার শুরুটা ভালো হলেও ধাক্কা খেতে হয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে দুই দফায় ১৪ মাস বন্ধ রাখতে হয়েছে প্রদর্শনী। দর্শকদের একটি বড় অংশকে আবার হলমুখী করতে চেষ্টা করতে হয়েছে। প্রচারের জন্য সিনেস্কোপের লোকজন ইন্টারনেটকে বেছে নিয়েছেন। তাদের এক হাজার জন সদস্য রয়েছেন। তারা নিয়মিত সিনেমা দেখেন।

সিনেস্কোপের উদ্যোক্তা মোহাম্মদ নূরুজ্জামান বলেন, সিনেমার দর্শক আছে। তবে দর্শক সিনেমা হলে না আসার পেছনে কতগুলো কারণ আছে। সিনেমা হলের পরিবেশ, প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে হলমালিকরা চিন্তা করছেন না। সবকিছু থাকার পরও ভালো সিনেমা থাকতে হবে।

তিনি বলেন, “বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে কখনও চিন্তা করিনি। এটি সাংস্কৃতিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতা। নিজের আয়ে যেন চলতে পারি, সেই চিন্তা করেছি। কোভিড-১৯ এর কারণে টানা ১৪ মাস হল বন্ধ ছিল। গত কয়েকটি সিনেমায় ভালো সাড়া পেয়েছি।”

সিনেস্কোপের পরিধি উপজেলা পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার ভাবনার কথা জানান নূরুজ্জামান।

এদিকে নিউ মেট্রো সিনেমা ও সিনেস্কোপে একই সিনেমা চললেও একটিতে হাউজফুল অন্যটিতে দর্শক না পাওয়া প্রসঙ্গে চিত্রশিল্পী জিয়াউর রহমান বলেন, “আমিও সিনেস্কোপেই ‘হাওয়া’ দেখতে গিয়েছিলাম। সেখানে টিকেট ২০০ টাকা। কিন্তু টিকেট না পেয়ে এখানে ১০০ টাকা দিয়ে দেখতে হয়েছে। পার্থক্যটা তাই হলের পরিবেশে রয়েছে।”

এ সময় কাঠামোগত উন্নয়নও জরুরি বলে মত দেন জিয়াউর রহমান।

এ বিষয়ে একমত হয়ে নিউ মেট্রোর ব্যবস্থাপক বলেন, হলটি কয়েক বছর আগেই বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। হলের সামগ্রিক পরিবেশ উন্নতকরণের প্রক্রিয়া চলমান থাকলেও অনেক কারণেই তা হয়ে উঠছে না। তাছাড়া অবকাঠামোগত উন্নয়নের পরেও হলগুলো চলবে বা দর্শক টানতে পারবে, সেই নিশ্চয়তাও নেই। সামগ্রিক বিবেচনায় তাই এসব ‍উন্নয়নে কেউই তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না।

মানসম্মত সিনেমা তৈরি এবং হলে উন্নত পরিবেশ থাকলে মানুষ আবারও হলমুখী হবে বলে বিশ্বাস নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের সহসভাপতি ধীমান সাহা জুয়েলের।

তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জ শহর, ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জ, বন্দরে অনেকগুলো সিনেমা হল ছিল। এসব সিনেমা হল বন্ধের পেছনে ইন্টারনেট সংস্কৃতি, মানসম্মত সিনেমা না হওয়া, হলগুলোর মান ভালো না থাকা বড় কারণ। দেশের অনেক সিনেমা হল আছে যেগুলো ভালো চলছে। সিনেমা হল হচ্ছে নগর সংস্কৃতি।

তিনি আরও বলেন, শহরের মানুষের বিনোদনের জায়গা খুব কম। সিনেমা হলই তাদের কাছে সহজলভ্য বিনোদনকেন্দ্র। এটি একই সঙ্গে শক্তিশালী গণমাধ্যম। ভালো কনটেন্ট থাকলে সেই বার্তাও সমাজে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। সিনেমা হলে আবেগের বিনিময় হয়। এই কারণেও সিনেমা হল থাকা জরুরি।