তাকে বলা হয় ভারতের অন্যতম সেরা অভিনেতা। শুধু রুপালি পর্দা নয়, মঞ্চ ও টেলিভিশনেও সমান সফল তিনি। অভিনয়ের দক্ষতার স্বীকৃতি হিসেবে ভারতের বাইরেও তার ডাক পড়ে, অভিনয় করেছেন হলিউডের ‘মেইন স্ট্রিম’ সিনেমাতেও। তবে সম্ভবত তার ক্যারিয়ারে ‘ইনডিয়ান প্যারালাল সিনেমা’র অবদানই সবচেয়ে বেশি। তিনি আর কেউ নন, উপমহাদেশের কিংবদন্তী অভিনয়শিল্পী নাসিরুদ্দিন শাহ।
Published : 19 Jul 2022, 11:18 PM
বর্ষীয়ান এই তারকা জীবনের ৭২ বছর পূর্ণ করছেন বুধবার। সদ্য স্বাধীন ভারতে ১৯৫০ সালের ২০ জুলাই উত্তর প্রদেশের নবাব পরিবারে জন্ম হয় তার। ভারতের সিনেমা জগতে সম্ভবত তার মতো অভিনয় শিল্পে শিক্ষিত অভিনেতা খুব কমই মিলবে।
প্রতিভাধর এই অভিনেতা সম্পর্কে ২০১৬ সালে এক সাক্ষাৎকারে ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত পরিচালক সুধীর মিশ্র বলেছিলেন, “নাসিরুদ্দিন শাহ না থাকলে ভারতের প্যারালাল সিনেমা সম্ভব হত না। এদের মতো ব্যক্তিদের বাদ দিয়ে ১৯৭০ ও ’৮০-র দশকের ভারতীয় সিনেমাকে আপনি সংজ্ঞায়িত করতে পারবেন না।”
নাসিরুদ্দিন শাহর স্কুল জীবন শুরু সেন্ট আনসেমস আজমের স্কুলে। এরপর সেন্ট জোসেফ কলেজ, নৈনিতাল, ইউনিভার্সিটি ছিল আলীগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি। তিনি দিল্লীর ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামার গ্রাজুয়েট। এরপর পুনের ন্যাশনাল ফিল্ম ইনস্টিটিউটেও দুই বছরের ডিগ্রি সম্পন্ন করেন।
অভিনয়ের প্রতি নিজের একাগ্রতা প্রকাশ করতে গিয়ে সাক্ষাৎকারে একাধিকবার শাহ জানিয়েছেন, বাবার সঙ্গে খুব সদ্ভাব ছিল না তার। বিশেষ করে তিনি যখন ক্যারিয়ার হিসেবে অভিনয় বেছে নিয়েছিলেন, তার বাবা খুবই হতাশ হয়েছিলেন।
নাসিরুদ্দিন শাহ চলচ্চিত্রের পর্দায় আবির্ভূত হন ১৯৬৭ সালে আমান সিনেমার মাধ্যমে। একটি ছোট চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি। বলিউডে মূলধারার সিনেমায় অভিষেক ঘটে ১৯৮০ সালে ‘হাম পাঁচ’ সিনেমার মাধ্যমে। ১৯৮২ সালে নায়িকা রাখির বিপরীতে কাজ করেন ‘দিল আখির দিল হ্যায়’ সিনেমাতে।
ক্যারিয়ারের শুরুর দিকেই ভালো অভিনয়ের স্বীকৃতি মেলে নাসিরের। ১৯৮০ সালে মুক্তি পাওয়া ‘স্পর্শ’ সিনেমায় অভিনয় করে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান তিনি। সাই পারাঞ্জপাই পরিচালিত এই সিনেমায় নাসিরের বিপরীতে ছিলেন আরেক খ্যাতনামা অভিনয়শিল্পী শাবানা আজমী।
তার ক্যারিয়ারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ এবং উল্লেখযোগ্য সিনেমা ‘মাসুম’ মুক্তি পায় ১৯৮৩ সালে যেখানে তিনি আবারও শাবানা আজমীর বিপরীতে অভিনয় করেন। এই সিনেমাটির শুটিং হয় নৈনিতালের সেন্ট জোসেফ কলেজে, তিনি যেখানে একসময় ছাত্র ছিলেন।
১৯৮৪ সালে গৌতম ঘোষ পরিচালিত ‘পার’ সিনেমায় অনবদ্য অভিনয়ের জন্য আবারও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জেতেন এই অভিনেতা। এছাড়া ২০০৬ সালে ‘ইকবাল’ সিনেমায় সেরা পার্শ্ব অভিনেতা হিসেবে আরও একবার এই পুরস্কার পান নাসির। যেখানে তিনি একটি বোবা ও বধির ছেলের মদ্যপ ক্রিকেট কোচের ভূমিকায় ছিলেন।
নাসিরউদ্দিন শাহর অভিনয় প্রতিভার প্রশংসা করতে গিয়ে ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা কেতন মেহতা কয়েক বছর আগে বলেছিলেন, “আমার বিনীত ও সৎ মতামত হচ্ছে, আমি আসলেই বিশ্বাস করি নাসির হচ্ছেন ভারতীয় সিনেমার প্রথম সত্যিকারের আধুনিক অভিনেতা। ... আমার মনে হয় আমরা তাকে যথেষ্ট স্বীকৃতি দিতে পারিনি।”
অবশ্য ভারতীয় চলচ্চিত্রে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ভারত সরকার নাসিরউদ্দিনকে ১৯৮৭ ও ২০০৩ সালে যথাক্রমে পদ্মশ্রী ও পদ্মভূষণ পুরস্কারে ভূষিত করে।
অভিনেত্রী রত্না পাঠক শাহকে নিয়ে এখন নাসিরুদ্দিনের সংসার। এক সঙ্গে অভিনয়ের সূত্রে প্রেম করে ১৯৮২ সালে তাদের বিয়ে। আগে একটি বিয়ে করেছিলেন নাসিরুদ্দিন শাহ, তবে তা টেকেনি। নাসিরুদ্দিন শাহর দুই ছেলে ইমাদ ও বিভান, এক মেয়ে হিভা।
বলিউডে নাসিরুদ্দিন শাহ
ভারতীয় মূলধারার সিনেমায় নাসিরের বড় মাইলফলক ১৯৮৬ সালে ‘করমা’ সিনেমা। এই তারকাবহুল সিনেমায় তিনি ভারতের কিংবদন্তি অভিনেতা দিলীপ কুমারের সঙ্গে অভিনয় করেন। এরপর ১৯৮৭, ১৯৮৮ ও ১৯৮৯-সালে ধারাবাহিকভাবে মুক্তি পায় তার ‘ইযাজাত’, ‘জালওয়া’ এবং ‘হিরো হিরালাল’ সিনেমা।
এইচ আর এফ কিটিং-এর নভেল ‘মার্চেন্ট আইভরির’ ইংরেজি ভাষার চলচ্চিত্র ‘দ্য পারফেক্ট মার্ডার’-এ কাল্পনিক গোয়েন্দার আদলে ইন্সপেক্টর ঘোটে হিসেবে তিনি তার স্ত্রী রত্না পাঠকের বিপরীতে অভিনয় করেন। তারপর বেশ কিছু মাল্টি-স্টার বলিউড সিনেমা ‘গুলামি’, ‘ত্রিবেদ’ এবং ‘বিশ্বাত্মা’ সিনেমাতেও অভিনয় করেন তিনি।
১৯৯৪ সালে তার শততম সিনেমা ‘মোহরা’-তে খলনায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে প্রমাণ করেন অভিনয় জগতে তিনি একজন ‘অলরাউন্ডার’।
ভক্তকূলকে মোহিত করে তার ‘সারফারোশ’ সিনেমায় অভিনিত গজল গায়ক-কাম-সন্ত্রাসী মাস্টারমাইন্ড গুলফাম হাসানের খলচরিত্রটি। তার অভিনয়ের পারদর্শিতার ঝলক দেখা যায় ‘আ ওয়েন্সডে’ সিনেমাটিতেও।
২০১১ সালে ‘দ্য ডার্টি পিকচার’ –এ তার অভিনয় সমাদৃত হয় সমলোচক মহলে।
১৯৯৪ সালে টি ভি চন্দ্রনের ‘পন্থন মাদা’-এর মাধ্যমে মালায়ালাম সিনেমায় আত্মপ্রকাশ করেন নাসির। সিনেমাটিতে একজন সামন্ততান্ত্রিক দাস এবং একজন ঐপনিবেশিক জমিদারের বন্ধনকে ফুটিয়ে তোলা হয়। এই সিনেমায় তার সহঅভিনেতা ছিলেন দক্ষিণের সুপারস্টার মামুট্টি।
২০০০ সালে কমল হাসানের ‘হে রাম’ ছবিতে তিনি মহাত্মা গান্ধীর চরিত্রে অনবদ্য অভিনয়ের মাধ্যমে সাড়া ফেলেন।
ভারতের বাইরে শাহের সাফল্য
নাসিরুদ্দিন শাহ বেশ কিছু বিদেশি সিনেমায় কাজ করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ২০০১ সালের ‘মনসুন ওয়েডিং’, ২০০৩ সালে ‘দ্য লিগ অফ এক্সট্রাঅর্ডিনারি জেন্টলম্যানস’-এর হলিউড অভিযোজন, যেখানে তার চরিত্র ছিল ক্যাপ্টেন নিমো। ২০০৩ সালে বিশাল ভরদ্বাজের শেক্সপিয়ারস ম্যাকবেথের ভারতীয় অভিযোজন ‘মকবুল’সহ দারুণ কিছু সিনেমা।
শাহ শোয়েব মনসুরের ‘খুদা কে লিয়ে’ সিনেমায় একটি ছোট ক্যামিও চরিত্রের মাধ্যমে পাকিস্তানি সিনেমায় তার আত্মপ্রকাশ ঘটে। তার দ্বিতীয় পাকিস্তানি সিনেমা ‘জিন্দা ভাগ’ সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র পুরস্কারের জন্য ৮৬তম একাডেমি পুরস্কারে দেশের অফিসিয়াল এন্ট্রি হিসাবে নির্বাচিত হয়।
২০১৭ সালে গুণী এই শিল্পী শেকসপিয়ারের অভিযোজন ‘দ্য হাংরি’-তে অভিনয় করে চলচ্চিত্রে ফিরে আসেন, যা টরন্টো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ২০১৭ এ বিশেষ উপস্থাপনার অধীনে প্রদর্শিত হয়।
মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র পরিচালনা
১৯৭৭ সালে ‘মোল্টে প্রডাকশন’ নামে থিয়েটর গ্রুপ খোলেন নাসিরুদ্দিন।
টেলিভিশনে তার অনবদ্য অভিনয় ছিলো মির্জা গালিব চরিত্রে। তিনি ১৯৮৮ সালে গুলজার পরিচালিত বিখ্যাত এই টেলিভিশন সিরিজে অভিনয় করেন। ১৯৮৯ সালে তিনি জওহরলাল নেহেরুর ‘দ্য ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া’ বইয়ের উপর ভিত্তি করে আরেকটি বিখ্যাত টেলিভিশন সিরিজ ‘ভারত এক খোঁজ’-এ মারাঠা রাজা শিবাজি চরিত্র রূপায়ন করেন।
১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি টেলিভিশনে ম্যাগাজিন শো ‘টার্নিং পয়েন্টের’ কিছু পর্বও উপস্থাপনা করেন তিনি।
২০০৬ সালে চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে এই গুণী শিল্পীর।
এছাড়াও বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে রয়েছে তার অজস্র প্রশংসনীয় কাজের সম্ভার।
নাসিরউদ্দিন শাহের স্বীকৃতি
এখন অব্দি ক্যারিয়ারে তিনবার ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয় ছাড়াও ১৯৮১, ১৯৮২ ও ১৯৮৪ সালে ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ডস, ২০০০ সালে আইফা অ্যাওয়ার্ড, ১৯৮৬ ও ২০০৬ সালে বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্টস অ্যাসোসিয়েশন অ্যাওয়ার্ডস এবং ১৯৯৪ সালে ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভাল অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছেন নাসিরুদ্দিন।
বিতর্কিত-আলোচিত-সমালোচিত
অভিনয়ের বাইরেও নাসিরুদ্দিন শাহ সবসময়ই একজন রাজনৈতিক সচেতন নাগরিক। চলচ্চিত্র, রাজনীতি, সংস্কৃতি- সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে অকপট মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়া জানানোয় বর্ষীয়ান এই অভিনেতা বিভিন্ন সময় জড়িয়েছেন বিতর্কে।
ভারত সরকারের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনকে সমর্থন করে মতামত দেওয়ার জন্য তিনি সহকর্মী অনুপম খেরের সমালোচনায় পিছপা হননি। মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে বিজেপি নেতাদের কটাক্ষ ও অবমাননাকর মন্তব্যের বিরুদ্ধে আমির খান, শাহরুখ খান ও সালমান খানের মৌনতারও সমালোচনা করেন।
আবার মুঘলদের ‘রিফিউজি’ সম্বোধন করায় নেটিজেনদের রেষের মুখেও পড়েন।
শারীরিক অসুস্থতা
প্রবীণ এই অভিনেতা সম্প্রতি টাইমস অব ইন্ডিয়াকে জানিয়েছেন, তিনি ওনোমাটোম্যানিয়া নামে বিরল রোগে ভুগছেন।
অনোম্যাটোম্যানিয়া হল এমন একটি অবস্থা, যেখানে একজন ব্যক্তি ক্রমাগত কিছু শব্দ, বাক্য, লাইন নিয়ে আওড়াতে থাকেন। প্রায়ই, একটি নির্দিষ্ট শব্দ বা বাক্য মনে না থাকলেও, তারা প্রায়শই এটি সম্পর্কে ভাবেন।
নাসিরুদ্দিন শাহ বলেন, “আমি সব সময় এটি করি, তাই আমি কখনই পুরোপুরিভাবে বিশ্রাম নিতে পারি না। এমনকি যখন আমি ঘুমাচ্ছি, তখনও আমি আমার পছন্দের কিছু কোনো কাজ করছি।”