গীতিকার অঞ্জন আইচের প্রথম সিনেমা আগামীকাল। দুই নারীর অতীত প্রেম ও পারস্পরিক দোষারোপের বর্তমান গল্পের নাম ‘আগামীকাল’।
Published : 09 Jun 2022, 03:04 PM
হারিয়ে যাওয়া একজন প্রেমিক ও অন্য এক ব্যবসায়ীর খুনকে ঘিরে থ্রিলার, সাইকো থ্রিলার কিংবা গোয়েন্দা ধাঁচের পুলিশি গল্পের নাম-আগামীকাল। সিনেমার খুঁটিনাটি অনেক কিছুর আয়োজনবিহীন এক সিনেমাটিক গল্পের প্রশ্নবিদ্ধ সমাধানের নাম আগামীকাল। একই সঙ্গে বাংলা সিনেমার বাঁকবদলের চেষ্টাকালীন ইচ্ছে ও সর্বোচ্চ চেষ্টাময় এক ছবির নাম আগামীকাল।
নারী প্রধান এই সিনেমার প্রধান দুই নায়িকা একে অন্যকে সন্দেহ করে। একজন জেল খাটে, জেল থেকে বেরিয়ে আবারও জেলে যায়, অন্যজন হয়ে যায় পুলিশ অফিসার। এই দুই নায়িকা একসময় এক জমিদার গিন্নির বাসায় থাকত। কারণ, একজন জমিদার কন্যা অবন্তী আর অন্যজন জমিদার গিন্নির বান্ধবীর মেয়ে রূপা যার আর কেউ নেই পৃথিবীতে। জমিদার গিন্নিই তাকে আশ্রয় দিয়েছিল। দুজন ভালোবাসতো ডাক্তারি পড়ুয়া শাফায়াতকে। দুজনের এই সমান্তরাল ভালোবাসার কথা কেউ জানত না। জানার পর সবকিছু যেন ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। জমিদার গিন্নি এই ঘটনা জানার পর রূপাকে বাসা থেকে বের করে দেন। রূপার তখন কেউ কোথাও নেই অবস্থা। গল্প শুরু সেখান থেকেই যেন।
এরপর প্রথম জানা যায় শাফায়াতকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করে অবন্তী, সে দেখা করে খুনি কাদেরের সঙ্গে। কাদেরের ছোড়া গুলি শাফায়াতের পায়ে বিদ্ধ হয় কিন্তু তাকে আর পাওয়া যায় না, সে একরকম গুম হয়ে যায়।
এসব জানা যায় ছদ্মবেশি পুলিশ অফিসার সাইক্রিয়াটিস্ট কবির এর কাছে দেওয়া রূপার কথোপকথন থেকে। আরও জানা যায় ঘটনার পর জেলে যায় রূপা, জেল থেকে বেরিয়ে সে দেখে তাকে নিতে এসেছে মাদক ব্যবসায়ী ও নারী পাচারকারী টুটুল চৌধুরী। তার সঙ্গে বিয়ে হয় রূপার, রূপা বিয়ের পর জানতে পারে টুটুলের জীবনের সব অন্ধকার দিক।
এদিকে পুলিশ অফিসার হওয়া অবন্তীও রূপার পিছু ছাড়ে না। সে শাফায়াতের হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে খুন মনে করে এবং দায়ী করে রূপাকেই। রূপা যেন এক ঘোরের ভেতরে থাকে। তার সঙ্গে কথা বলতে আসে তার প্রেমিক শাফায়াত এবং তার স্বামী টুটুল চৌধুরী যে কিনা নিজেও খুন হয় এবং এই খুনের জন্যও দায়ী করা হয় রূপাকে। রূপা জানায় টুটুলকে সে খুন করে নি বরং টুটুল মদ খেয়ে পাহাড়ের উচু থেকে নীচে পরে মারা গিয়েছে।
অন্যদিকে সাইক্রিয়াটিস্ট কবির কথা বলে অবন্তীর সঙ্গেও। অবন্তী জানায় খুনি কাদেরের সঙ্গে যোগাযোগ করে রূপা এবং সে খুন করতে চায় শাফায়াতকে। এরপর সে পায়ে গুলিবিদ্ধ শাফায়াতকে উদ্ধার করে তার মঞ্চ অভিনেতা মামার বাসায় নিয়ে যায় এবং সেখানে সে কয়েক মাস থাকে। শাফায়াতকে সে শুশ্রষা দিয়ে সারিয়ে তুললেও শাফায়াত গা ঢাকা দেয়, তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। পুলিশে যোগ দেওয়ার পর ফর্মুলা ছবির ‘গৎ’ অনুসারে অবন্তী নিজেই শাফায়ত এর হাওয়া হয়ে যাওয়া ঘটনার তদন্তে নামে। রূপা যে বাসায় থাকে সেখানে শাফায়াত ও টুটুল চৌধুরী দেখা করতে এলেও পুলিশ বা অবন্তী একজন খোঁড়া মানুষকে ধরতে পারে না!
তাই এই সিনেমা দেখলে কিছু প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। বাবা মা হারা একজন তরুণী রূপা, প্রেমিককে হারিয়ে চরিত্রহীন ও মদ্যপ স্বামীর অত্যাচারে যদি সে পাগলের মতো হয়ে যায় তাহলে হয়তো সে ঘোরের ভেতর চলে যেতে পারে। যদি সে সুস্থ থাকে তাহলে সে ঘোরের ভেতরে কী ভাবে যায়?
শাফায়াত বেঁচে আছে, সে আসে রাতের আধারে রূপার সঙ্গে কথা বলতে, সেটা হয়তো সম্ভব। তাহলে টুটুল চৌধুরী যে মারা গেছে তার ফিরে এসে রূপার সঙ্গে কথা বলতে চাওয়াটা কেমন? কুহক বা ভ্রম?
দর্শকদের ধাঁধাঁর ভেতর রাখার জন্য প্রথম জানানো হয় খুনি কাদেরের সঙ্গে প্রথম যোগাযোগ করে অবন্তী। এরপর জানা যায় কাদেরের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল আসলে রূপা। একদম শেষে জানা যায় খুনি কাদেরের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল টুটুল চৌধুরীও! তাহলে? কার ইন্ধনে কিংবা আসলে কার টাকায় খুনি কাদের ঘটনাটা ঘটিয়েছিল? তিনজনই যদি প্রায় একই রকম উদ্দেশ্য নিয়ে খুনি কাদেরের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাহলে তিনজনেরই তো শাস্তি হওয়ার কথা! সেক্ষেত্রে অবন্তীর শাস্তি না হওয়া কিংবা পুলিশের চাকরিতে বহাল থাকা কীভাবে সম্ভব?
সিনেমার শেষে আরেক নাটকীয় ঘটনার দেখা মেলে। আসল সাইক্রিয়াটিস্ট ডা.কবিরকে তুলে নিয়ে আটকে রাখা হয় এবং তার জায়গায় পুলিশ অফিসার ডাক্তার সেজে রূপা ও অবন্তীর সঙ্গে কথা বলতে যায়। আসল ডাক্তার কবিরকে তুলে নিয়ে আটকে রাখাটা কী সিনেমাটিক ‘গৎ’ অথবা সিনেমাতেও সবকিছু সম্ভব?
‘আগামীকাল’ সারাদেশের ৩০টি হলে মুক্তি পেয়েছে ৩ জুন ২০২২। প্রথমেই বলা হয়েছে অঞ্জন আইচের প্রথম সিনেমা এটা। সর্বোচ্চ চেষ্টা ছিল গল্পের শেষটা যেন দর্শক শেষেই বুঝতে পারে সেই দিকে। গল্প, সংলাপ এবং চিত্রনাট্য লিখেছেন অঞ্জন আইচ নিজেই। সিনেমাটিক আয়োজনের অনেক কিছু না থাকলেও ক্যামেরার চোখ ও ড্রোন ব্যবহারে পরিচালক অঞ্জন আইচ ও চিত্রগ্রাহক কমলের পরিমিতি বোধ ভালো লেগেছে। ভালো লেগেছে দর্শকের টেনশান তৈরির কারিশমা এবং সাবলীল অভিনয়ে চরিত্রগুলোকে বিকশিত হতে দেয়ার ইচ্ছেকে।
প্রথম সিনেমা হিসেবে আগামীকালের সাফল্য কামনা করি। সাফল্য কামনা করি অঞ্জন আইচের পরবর্তী দুটি সিনেমার। আশা করবো নাটকের মতো তিনি চলচ্চিত্রেও থিতু হবেন এবং আগামীকাল দেখবে অগণিত দর্শক।
খল চরিত্রে নিজ নামে অভিনয় করেছেন টুটুল চৌধুরী নিজেই এবং এটাও তার অভিনীত প্রথম ছবি। শাফায়াতের ভূমিকায় ইমন, পুলিশ অফিসার কাম সাইক্রিয়াটিস্ট এর ভূমিকায় শতাব্দী ওয়াদুদ, আসল ডা.কবিরের ভূমিকায় ফারুক আহমেদ, অবন্তীর ভূমিকায় সূচনা আজাদ, রূপার ভূমিকায় জাকিয়া বারী মম, পুলিশ ইন্সপেক্টরের ভূমিকায় তারিক স্বপন, জমিদার গিন্নির ভূমিকায় সাবেরি আলম, হোটেল ম্যানেজারের ভূমিকায় সুজাত শিমুল, টুটুল চৌধুরীর সহযোগীর ভূমিকায় ইকবাল এবং খুনি কাদেরের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন আশীষ খন্দকার।
খুনির চরিত্রে অসাধারণ অভিনেতা আশীষ খন্দকারকে ‘ঘোর লাগা খুনী’ মনে হয়েছে! জাকিয়া বারী মম, শতাব্দী ওয়াদুদ এবং ফারুক আহমেদের অভিনয় ভালো লেগেছে। প্রথম সিনেমা হিসেবে সূচনা আজাদ ও টুটুল চৌধুরীর প্রতি শুভকামনা রইলো, তাদের সিনেমায় অংশগ্রহণ আরও বাড়ুক। টুটুল চৌধুরী ভালো অভিনয় করেছেন এই সিনেমায়।
ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন ইমন সাহা। ছবিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুটি গান ছাড়া বাকি তিনটে গানের কথা লিখেছেন অঞ্জন আইচ নিজেই।
পরিচালক অঞ্জন আইচের মতো গীতিকার অঞ্জন আইচকেও স্বাগত জানাই। গানগুলো জনপ্রিয় হতে পারে।
জয় হোক বাংলা সিনেমার।