সিলেট অঞ্চলের বিয়ের গান ‘আইলো রে নয়া দামান’ নিয়ে ফেইসবুকে ঝড় চলছে। এর মধ্যে গানটির গীতিকার ও সুরকার হিসেবে লোককবি দিব্যময়ী দাশের নাম সামনে এনেছে তার পরিবার। তবে বিষয়টি নিয়ে এখনই চূড়ান্ত কোনও সিদ্ধান্তে আসা ‘কঠিন’ বলে জানিয়েছেন লোকসংগীত গবেষকরা।
Published : 05 May 2021, 10:36 PM
সিলেটের দুই তরুণ শিল্পী মুজা ও তসিবা বেগমের কণ্ঠে গানটি মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। গানের তালে এক তরুণীর বিয়ের নাচ এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তিন চিকিৎসকের নাচের ভিডিও সম্প্রতি ‘ভাইরাল’ হয়েছে ফেইসবুকে।
তবে কোথাও গানের গীতিকার কিংবা সুরকারের নাম উল্লেখ ছিল না। ফলে গানের গীতিকার ও সুরকার কে, প্রথম কোথায় গাওয়া হয়েছিল-তা নিয়ে শ্রোতাদের মধ্যে বিভ্রান্তি দেখা দেয়।
এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক থেকে সংগীতশিল্পী কাবেরী দাশ এক ভিডিও বার্তায় দাবি করেন, ১৯৬৫ সালের দিকে তার ঠাকুরমা লোককবি দিব্যময়ী দাশ গানটি রচনা করেন।
রচনার পর বিভিন্ন গ্রামের আসরে তা পরিবেশন করে সঙ্গী ও শ্রোতাদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বলে কাবেরীর ভাষ্য।
একুশে পদকপ্রাপ্ত দুই লোকসংগীতশিল্পী রাম কানাই দাশ ও সুষমা দাশের মা দিব্যময়ী দাশ; তিনি লোককবি রসিকলাল দাশের স্ত্রী। মুখে মুখে কীর্তন, বিয়ের গান রচনা করতেন সিলেটের মেয়ে দিব্যময়ী।
জীবদ্দশায় বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকাসহ বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রাম কানাই দাশ এ গানের গীতিকার ও সুরকার হিসেবে মা দিব্যময়ীর নাম উল্লেখ করে গেছেন।
লোকসংগীত গবেষক সুমন কুমার দাশ রচিত ‘রাম কানাই দাশের নন্দনভূবন’ বইয়েও রাম কানাই দাশের বয়ানে গানটির গীতিকার হিসেবে দিব্যময়ী দাশের নাম এসেছে।
বইয়ে রাম কানাই দাশ বলছেন, ‘আইলা রে নয়া জামাই’ ছাড়াও ‘তোরা শুনছনি গো রাই/কাইল যে আইছে নুয়া জামাই/বলদ নাকি গাই’ শিরোনামে আরেকটি বিয়ের গানও রচনা করেছেন তার মা।
প্রয়াত শিল্পী রাম কানাই দাশের মেয়ে কাবেরী দাশ বলেন, “আমরা তখন সিলেটের টিলাগড়ে থাকতাম। শিল্পী ইয়ারুন্নেসা খানম মায়ের কাছে গান শিখতে আসতেন। ১৯৭২-৭৩ সালের দিকে গানটি মায়ের কাছ থেকে নিয়ে প্রথমবারের মতো সিলেট বেতারে পরিবেশন করেছিলেন ইয়ারুন্নেসা।”
সিলেট বেতারের আঞ্চলিক পরিচালক আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তারিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “১৯৭২-৭৩ সালে সিলেট বেতারে গানটি প্রচারের কথা শুনলেও তা নিয়ে আমাদের কাছে কোনও তথ্য নেই। তবে আশির দশকের গানটি আরেকবার রেকর্ডিং হয়েছিল। সেখানে গীতিকারের নাম ‘অজ্ঞাত’ লেখা ছিল; সুরকার হিসেবে আলী আকবরের নাম আছে।”
বিষয়টি নিয়ে কাবেরী দাশ বলছেন, “দিব্যময়ী দাশ বেতারের এনলিস্টেড গীতিকার ছিলেন না বলে তার নামটি ‘অজ্ঞাত’ বলে উল্লেখ করা ছিল। কিন্তু গানটি উনিই লিখেছেন। বেতারে পরিবেশনের আগে গ্রামের আসরে গেয়েছেন, তার সঙ্গী-সাথীরা তা শিখেছেন। পরে গানের কথা বদলালে সেটা দিব্যময়ীর দোষ না।”
সিলেট বেতারে পরিবেশনের সময় গানের ‘বাজায় বাঁশি জয় রাধা বলিয়া’ থেকে বেতার কর্তৃপক্ষ ‘রাধা’ শব্দটি ফেলে দিয়েছিলে বলে জানান কাবেরী; পাশাপাশি আরও বেশ কয়েকটি শব্দ ফেলে দেওয়া হয়েছিল এমনটি বাবার মুখে শুনেছিলেন বলে জানান তিনি।
দিব্যময়ীর লেখা ‘নয়া জামাই’ থেকেই বিভিন্ন সময়ে তা বদলে তা ‘নয়া দামান’ হয়েছে বলে দাবি কাবেরীর।
দিব্যময়ীর লেখা ও তার ভণিতা পদসহ মূল গানটিই ২০০৫ সালের বেঙ্গল ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত লোকগানের একক অ্যালবাম ‘অসময়ে ধরলাম পাড়ি’-তে রেকর্ড করেন তার ছেলে রাম কানাই দাশ। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তিনি গানের গীতিকার হিসেবে মায়ের নাম বলে এলেও নিজের অ্যালবামে তা উল্লেখ করেননি।
সেই অ্যালবামে ‘আইলো রে নুয়া জামাই’ গানের গীতিকার ও সুরকার হিসেবে কারও নাম নেই জানিয়ে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা জাহিদুল হক দিপু বলেন, অ্যালবামে ও ইউটিউবে চ্যানেলে গানটিকে ‘সংগৃহীত’ বলে উল্লেখ করা হয়েছিল।
সিদ্ধান্তে আসা ‘কঠিন’
লোকসংগীত গবেষক সুমন কুমার দাশ তার বইয়ে রাম কানাই দাশের বয়ানে এ গানের গীতিকার হিসেবে দিব্যময়ী দাশের নাম উল্লেখ করলেও এখন তিনি বলছেন, ২০১৩ সালে রাম কানাই দাশ তাকে বিষয়টি জানালেও পরবর্তীতে আরও অনুসন্ধান করেছেন তিনি।
সুমন কুমার দাশ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, সিলেট অঞ্চলে মুসলিম বিয়েতে ‘আইলো রে নয়া দামান’ ও হিন্দু বিয়েতে ‘আইলো রে নয়া জামাই’ শিরোনামে দুটি উৎসমুখ দিব্যময়ীর গানটি প্রকাশের আগে থেকেই বিয়ের গীত হিসেবে প্রচলিত ছিল।
“পরে সেখান থেকে ষোল ধরনের অন্তরা পাওয়া যাচ্ছে। লোকগীতি লোকের মুখে মুখে প্রচারিত হয়। প্রচারিত হওয়ার সময় কথার পরিবর্তন হয়ে যায়। ফলে গানটা যে দিব্যময়ী দাশ লিখেন নাই, সেটাও জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না; আবার গানটা যে উনারই লেখা, সেটাও বলা যাচ্ছে না।”
“গানটি আগে থেকেই কিছু কিছু এলাকায় যেমন শোনা গেছে তেমনি এমন সংগীত পরিবারের কথাও উড়ে দেওয়া যায় না। ফলে বিষয়টি নিয়ে কোনও সিদ্ধান্তে আসা কঠিন,” বলেন এই গবেষক।
দিব্যময়ী দাশের পরিবার বলছেন, গানটি রচনার পর গ্রামের আসরে তিনি পরিবেশন করেছেন। ফলে রেডিওতে প্রচারের আগেই সেটি মুখে মুখে ছড়ানোর সম্ভাবনা আছে কি না?
গবেষক সুমন বলেন, “উনি (দিব্যময়ী দাশ) যেই এলাকায় থাকতেন, সেই সময়ে গানটা মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়া খুব কঠিন। রেডিওতে প্রচারের পরও মুখে মুখে ছড়ানোটা কঠিন। তখন তো প্রত্যেক গ্রামে গ্রামে রেডিও ছিল না।”
দিব্যময়ী দাশ ছাড়াও গানটির গীতিকার হিসেবে সিলেটের গীতিকার গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, সিদ্দিকুর রহমানের নাম এসেছে ফেইসবুকে। তবে সুমন বলছেন, গানটির তাদের হওয়ার কোনো সম্ভবনা নেই।
সিলেটের বিয়ের গান সংগ্রহ করে নিজের সম্পাদনায় ২০১৩ সালে শুদ্ধস্বর প্রকাশনী থেকে ‘সিলেটের বিয়ের গীত’ নামে একটি বই প্রকাশ করেছেন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক জফির সেতু।
তার বইয়েও এ গানের গীতিকার ও সুরকার হিসেবে দিব্যময়ী দাশের নাম উল্লেখ নেই; এটিকে বলা হয়েছে প্রচলিত লোকসংগীত।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নের জবাবে জফির সেতু বলেন, ছাতক, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জসহ চারটি অঞ্চল থেকে তিনি গানটি সংগ্রহ করেছেন। কোথাও দিব্যময়ী দাশের ভণিতা পদ না পাওয়ায় তিনি সেটিকে সংগৃহীত বলে উল্লেখ করেছেন।
দিব্যময়ী দাশের নাম সামনে আসার পর বাংলার এ অধ্যাপক বলছেন, “বিষয়টি নিয়ে আমাদের আরও ভাবতে হবে। কারণ অজ্ঞাত গানকে কারও নামের সঙ্গে যুক্ত করা …. এটা সত্যিই যদি ওই ব্যক্তি না হয়, তাহলে তো একটা ব্যাপার; আর যদি হয়ও, সেটাও একটা ব্যাপার।
“গানটার মধ্যে যে ভাষাতাত্ত্বিক, সমাজতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট আছে সেগুলো দিব্যময়ী দাশের মধ্যে কতটুকু ক্রিয়াশীল থাকা সম্ভব, সেটা বিবেচনা করতে হবে। গানটা উনার কিনা সেটা জানতে এটা কাজে দেবে। উনার অন্যান্য গান থাকলে সেগুলোও বিবেচনায় নিতে হবে। বাকি গানের সঙ্গে মিলে গেলে গানটির গীতিকার তিনি কি না সে বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসা সহজতর হবে।”
কী বলছে কপিরাইট অফিস
বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস বলছে, এখনও কেউ গানটির স্বত্ব চেয়ে আবেদন করেনি; ফলে স্বত্ব দেওয়াও হয়নি। গানটি নিয়ে কোনো অভিযোগও জমা পড়েনি।