সন্দীপের মতে, আসল ফেলুদা ছিলেন সত্যজিৎ রায় নিজেই।
Published : 29 Apr 2024, 09:45 AM
কলকাতার অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সব্যচাসী চক্রবর্তী, আবীর চট্টোপাধ্যায়সহ আরও কয়েক অভিনেতা গেল পঞ্চাশ বছরে নানা সময়ে পর্দায় এসেছেন কালজয়ী গোয়েন্দা চরিত্র ‘ফেলুদা’ হয়ে। এই অভিনেতাদের মধ্যে কে কতটা ফেলুদা হয়ে উঠতে পেরেছেন, তা নিয়ে কথা বলেছেন নির্মাতা সন্দীপ রায়।
আনন্দবাজারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সত্যজিৎ রায়ের ছেলে সন্দীপ বলেন, “ফেলুদার কোনো নম্বর হয় না। মানে এই চরিত্রে কাউকে নম্বর দেওয়া যায় না। তবে আসল ফেলুদা ছিলেন সত্যজিৎ নিজে।“
সত্যজিৎ রায় দুই মলাট থেকে ফেলু মিত্তিরকে প্রথম পর্দায় আনেন ১৯৭৪ সালে ‘সোনার কেল্লা’ সিনেমার মধ্য দিয়ে। ফেলুদা হলেন একজন প্রাইভেট ডিটেক্টিভ, পুরো নাম প্রদোষ চন্দ্র মিত্র। ছয় ফুট দীর্ঘ শরীরের ওপর মাথায় ধরেন তীক্ষ্ণ বুদ্ধি। গোয়েন্দিগিরিই তার পেশা এবং নেশা।
তার সহকারী তার খুড়তুতো ভাই তপেস রঞ্জন মিত্র, যাকে ফেলুদা ডাকেন তোপসে বলে। আর সব অ্যাডভেঞ্চারে তাদের সঙ্গী রহস্য-রোমঞ্চ উপন্যাস লেখক লালমোহন গাঙ্গুলি ওরফে জটায়ু।
‘সোনার কেল্লা’ সিনেমায় ফেলুদা হয়েছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।তাকে নিয়ে সন্দীপ বলেন, “তার (সৌমিত্র) উচ্চারণ, কথা বলার ধরন ভীষণ বাঙালি। খুব মানিয়ে যেত।“
সৌমিত্রকে সত্যজিতের পরিচালনায় ১৯৭৯ সালে ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ সিনেমায় ফের তোপসে ও জটায়ুকে সঙ্গে নিয়ে গোয়েন্দাগিরি করতে দেখা যায়। সত্যজিতের নির্মাণে মাত্র দুই সিনেমাতেই বাজিমাত করেন সৌমিত্র।
এরপরে পর্দায় ফেলুদার দীর্ঘ বিরতি। নব্বইয়ের দশকে সন্দীপ রায়ের পরিচালনায় ফেলুদার গল্প নিয়ে বেশ কিছু সিনেমা ও টেলিভিশন সিরিজ দেখেছে দর্শক। সন্দীপের ফেলু মিত্তির হন কলকাতার অভিনেতা সব্যসাচী চক্রবর্তী।
সব্যসাচীকে নিয়ে সন্দীপের ভাষ্য, “বেণুর (সব্যসাচী চক্রবর্তী) সেলুলয়েডে উপস্থাপনা অসাধারণ। মেজাজি চেহারা। বেশ একটা ব্যাপার ছিল। দারুণ বন্দুক চালাতে পারত। সবাই তো তা পারে না। মাঝেমাঝে আমি তো ওকে বলতাম, স্বর একটু নরম করতে। ফেলুদার অনুরাগীরা ভয় পেয়ে যাবে। আমার মনে হয় শরীরটা ঠিক থাকলে বেণু আরও একটা ফেলুদা করতে পারত। উচ্চতাও তো ছিল।“
সব্যসাচীর পর সন্দীপ রায়ের হাত ধরে এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন আবীর চট্টোপাধ্যায়। এই চরিত্রে আবীর কতখানি ‘ফিট’, সেই প্রশ্নে সন্দীপ বলেন, “আবীর তো ফেলুদা করল। আমরা ভালো করেই কাজ করেছি। তবে একজন অভিনেতা একসঙ্গে ফেলুদা আর ব্যোমকেশ করবেন, এটা চাই না।“
এরপরে সন্দীপের ‘হত্যাপুরী’ সিনেমা দিয়ে দর্শকরা ফেলুদা হিসেবে দেখেন ইন্দ্রনীল সেনগুপ্তকে। এই অভিনেতাকে নিয়েই সন্দীপ বানিয়েছেন ‘নয়ন রহস্য’; যা মুক্তি পাবে আগামী ১০ মে।
সন্দীপ বলেন, “ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত আমাকে নিজে এসে বলেছিলেন, ও ফেলুদা করতে চায়, সেটা খুব সম্ভবত ২০১৬ সাল। প্রথম বার যখন দেখা করতে আসে, তখন কথা বলার সময় লক্ষ করেছিলাম, ও বেশি ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করছে। অস্বস্তি হয়েছিল। বেশ কিছু দিন পরে যখন আমরা ফেলুদা খুঁজছি, তখন ও আবার এল, তখন ওই ইংরেজির বিষয়টা ছিল না। ‘হত্যাপুরী’র পরে ওকে দর্শক পছন্দ করল।
“দেখুন, সবাইকে তুষ্ট করতে কেউ পারে না। বহুসংখ্যক মানুষ নতুন ফেলুদা, তোপসে, জটায়ুকে গ্রহণ করেছে। আর ইন্দ্রনীলের অভিনয় নিয়ে কোনোদিন কোনো সংশয় ছিল না আমার। ‘হত্যাপুরী’ ছবির শেষে একটা বড় বিষয় ছিল যখন শুধু ফেলুদাই কথা বলে। সেই সংলাপকে ইন্দ্রনীল যেভাবে আয়ত্ত করেছিল, সেটা দেখে খুব ভাল লেগেছিল।“
ইন্দ্রনীলের মধ্যে ‘প্রেমিক’ ছাপ বেশি কী না– এমন প্রশ্নে সন্দীপের সোজাসুজি উত্তর, “সৌমিত্রবাবু কি কম প্রেমিক নাকি!”
.
কলকাতার অভিনেতা টোটা রায়চৌধুরীকে ফেলুদার চরিত্রে এনে ওয়েব সিরিজ বানিয়েছেন নির্মাতা সৃজিত চট্টোপাধ্যায়।
ফেলুদা হিসেবে টোটা কেমন জানতে চাইলে সন্দীপ বলেন, “সৃজিতের ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’ দেখেছি। ভাল লেগেছে টোটার ফেলুদা। ও অভিনেতা হিসেবে খুবই ভাল। তবে আমার মনে হয়েছে, টোটাকে আরও যদি একটু ছেড়ে রাখা যেত, তা হলে ফেলুদার ম্যাজিকটা আরও বেরিয়ে আসত।”
আনন্দবাজারের সঙ্গে কথায় কথায় সন্দীপ জানালেন, তার প্রপিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, পিতামহ সুকুমার রায় এবং বাবা সত্যজিৎ রায়ের যাবতীয় লেখার কাজ সংরক্ষণ করা হচ্ছে।
“তাদের লেখাপত্র সংরক্ষণ করা এটা এখন বিরাট কাজ। বাবার সিনেমা মোটামুটি নব্বই ভাগ সংরক্ষণ করা হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে যখন সংরক্ষণের কথা বলছি, ইতালিতে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ সংরক্ষণের কাজ হচ্ছে। কিন্তু রায় পরিবারের সবার লেখাপত্র, কাগজ সংরক্ষণ খুব জরুরি হয়ে পড়েছে।
“পরের প্রজন্মের কাছে, বিশেষ করে যারা গবেষণা করছেন, তাদের কাছে এই লেখাগুলি খুব জরুরি। এখানেও সৌরদীপের (সন্দীপের পুত্র) বড় ভূমিকা আছে। এত খারাপ আবহাওয়া, আমাদের কাগজ সংরক্ষণ বেশ কঠিন হয়ে পড়ছে। আমি রায় পরিবারের ঐতিহ্য ঠিকঠাক রাখতে চাই।“
‘নয়ন রহস্য’ সিনেমায় সন্দীপের সহকারী নির্মাতা হিসেবে ছেলে সৌরদীপ রায় কাজ করেছেন।
ছেলের কাজ নিয়ে সন্দীপের মতামত, “দেখলাম, খুব যত্ন করে কাজ করছে। ও নতুন প্রজন্মের মানুষ। ওর থেকেও এই সময়ের উপযোগী নানান মতামত পাই। এখন চিত্রনাট্য ওকে শোনাই। ভিএফএক্সের কাজও ভালো বোঝে ও। তবে এখনও সিনেমা করার কথা বলেনি। আমি যদিও এক-দুবার তাড়া দিয়েছি। বলেছি, দেরি হয়ে যাচ্ছে। তো, দেখা যাক।“
বড় পর্দায় এখনও ফেলুদার স্বত্ব কাউকে দেওয়া হয়নি জানিয়ে সন্দীপ বলেছেন, যদি আগামীতে তার ছেলে ফেলুদাকে নিয়ে সিনেমা করতে আগ্রহী হয়, সেই কাজে তার সমর্থন ও সহযোগিতা থাকবে।