চলে গেলেন পণ্ডিত যশরাজ। রেখে গেছেন ভালোবাসার সুর, সম্পর্কের তাল, গুণমুগ্ধের বন্ধনের লয়!
Published : 19 Aug 2020, 08:47 PM
ছন্দভরা জীবনটা তার থেমে গেলেও থামেনি ভালোবাসার সাতকাহন!
তাই তাকে নিয়ে লিখলেন আরাফাত শান্ত।
পণ্ডিত যশরাজ চলে গেলেন। কোনো অকালপ্রয়াণে নয়, বয়স হয়ে গিয়েছিল। গত এক দেড় বছর ধরে শো করা ছেড়ে দিয়েছিলেন, নিয়মিত ভ্রমন করা কঠিন হয়ে গিয়েছিল, একা একাই থাকতেন। বিভিন্ন শিষ্যরা আসতো মাঝেমধ্যে দেখা করতে, এতটুকুই ছিল তাঁর সামাজিক মেলামেশা। মার্কিন মুল্লুকে করোনা জনিত কারনে লকডাউনে আটকে যান। নিউজার্সিতেই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী যার কন্ঠ শুনে বলেছিলেন, 'আপনি তো পণ্ডিত যশরাজ না, আপনি হলেন 'রসরাজ'।
সুরের রস, কন্ঠের রস, সাধনা ও বাণীর রস- সবই আপনার রাজ করার মতো আছে।' হিন্দুস্থান ক্লাসিকালকে তিনি ইউরোপে আমেরিকায় প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে বিখ্যাত করে তুলেন। বিভিন্ন শহরে তাঁর বানানো স্কুল গুলো অপণ্ত্যডিন্ত বিখ্যাত। অনুরাধা পাড়োয়াল, কালা রমানাথ, সঞ্জীব অবায়ংকর, তৃপ্তি মুখার্জির মতো বরেণ্য শিল্পী তাঁর সরাসরি ছাত্র ছাত্রী। পন্ডিত যশরাজ ঢাকাকেও খুব ভালোবাসতেন। শিল্পকলায় এক শো করতে এসে বলেছিলেন, 'এরকম আতিথেয়তা খুব কম জায়গাতেই পাই।'
পন্ডিত যশরাজের জীবনে কিছুই সহজে আসেনি। মাত্র তিন বছর বয়সে তাঁর বাবা মারা যান। হরিয়ানায় তাঁর জন্ম। তাঁর জন্মস্থানে এখন তাঁর নামে স্কুল আছে, বৃত্তি দেয়া হয়, তাঁর বাবার নামে লাইব্রেরী আছে। পিতার মৃত্যুর কিছুদিন আগেই তিনি সেই বাচ্চা বয়সেই তালিম নেয়া শুরু করেন। পরে সংসারে অভাব। শিশুকালেই তিনি তবলা বাজানো শিখে তাঁর ভাইয়ের সাথে বাজাতেন। হায়দ্রাবাদে থাকতেন তখন। স্কুলে যেতে যেতে একদিন বেগম আখতারের এক গজল এক রেস্তোরাঁয় শুনে তাঁর মাথা নষ্ট। তিনি ভাবলেন, তাঁর গানই গাইতে হবে। কিন্তু চাইলেই তো আর শেখা যায় না। তাঁর ভাইয়ের সাধনা দেখতেন। কুমার গান্ধর্বের সাথে এক রেডিও প্রোগ্রামে তবলা বাজানোর পর একজনের সাথে একটা কথা নিয়ে মন খারাপ হয় তার। তিনি তবলা বাজানো ছেড়ে দিলেন ভাইকে বলে। তার ভ্রাতাই তাকে প্রস্তুত করার দায়িত্ব নিলেন। শুরু হলো সাধনা। তার ছিল অসম্ভব জেদ। সাত বছর তিনি চুল কাটেন নাই। যতদিন স্বীকৃতি না পান ততদিন চুল কাটাবেন না বলে ব্রত নিয়েছিলেন।
বেশি সময় নেননি।
১৯৫২ সাল থেকেই তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে। আকাশবানী রেডিওর এক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান। ক্লাসিকাল সম্মেলন হত, বড় বড় ওস্তাদরা আসতেন ও গাইতো। সেখান থেকেই তাঁর যাত্রা শুরু। পণ্ডিত ভীমসেন যোশী তাঁকে অপথ্য স্নেহ করতেন। ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খাঁ সাহেব তাঁকে শিষ্য বানাতে চেয়েছিলেন। এত বড় ভাগ্যের ব্যাপারে তিনি বিনীত ভাবে প্রত্যখান করেন। কারন তাঁর লক্ষ্য ছিল, তাঁর বাবা যে ঘরানায় ছিলেন সেটাই তিনি বিখ্যাত করবেন আরো। সেই ঘরানা, 'মেওয়াতি' ঘরানা। ওস্তাদ ওয়াহিদ খান আর ওস্তাদ নাজির খান ইন্দোরে এ ঘরানার প্রবর্তক। পন্ডিত যশরাজের কারনে এই ঘরানা এখন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য, দুদিকেই পরিচিত।
রাগ সংগীতে তিনি নমস্য ব্যক্তিত্ব।
তারুণ্যে তার পারফর্মেন্স দেখলে রাজা জমিদাররা বলতো, 'এ তো সাক্ষাৎ কৃষ্ণ'। জয়পুরে একবার এক শো করতে গিয়ে উপস্থিত দর্শকদের উপর বিরক্ত হয়ে উনি এমন কালীর ভক্তি বন্দনা গেয়েছিলেন টানা দেড় ঘণ্টা। লোকজন পিনপতন নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। গান শেষ করার দু তিন মিনিট পরে সবাই বুঝলো আর গাইবে না। সবাই দাঁড়িয়ে করতালি করতালিতে ভরিয়ে তুললো।
ভক্তিমূলক সেমিক্লাসিকাল গানে তিনি জগৎ বিখ্যাত।
তিনি 'হাভেলী সংগীত' গেয়েছেন, যা সাধারণত মন্দিরে মন্দিরে গাওয়া হয়। ব্যক্তিজীবনে তিনি দারুণ অসাম্পদ্রায়িক এক মানুষ। তাঁর এক গান আছে, 'আল্লাহ ওম'। শুনলেই আপনার ভেতরে আধাত্মিকতা ভর করবে। সত্তর আশি বছর বয়সেও তাঁর গলা ছিল তরুণদের মতন। লোকজন মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতো তাঁকে বিভিন্ন শো তে।
১৯৭৫ সালেই তিনি ভারতীয় রাষ্ট্রীয় সম্মান, পদশ্রীতে ভূষিত হন। ১৯৯০ সালে পদ্মভূষণ ও ২০০০ সালে পেয়ে যান পদ্মবিভূষণ।
তাঁর শিষ্য প্লেব্যাক শিল্পী সাধনা সারগাম বলেছিলেন, 'তিনি জীবনের গুরু, সবকিছু নিয়েই শেখার আছে তার থেকে।' ২০১৭ সালে তাঁর সংগীত জীবনের ৮০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে, দিল্লীতে বিশাল এক সংগীত সন্ধ্যার আয়োজন হয়। হাজার হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে তাঁকে অভিবাদন দেন। এরকম পন্ডিত ব্যক্তিরা পপুলার কালচার একটু কম পছন্দ করেন। তিনি ব্যতিক্রম। তিনি লতা মুঙ্গেশকারের বড় ভক্ত। সবসময় বলতেন, 'দশকের পর দশক এত মানুষের পছন্দের গায়িকা হওয়া সহজ নয়।' তাঁর মতো বিচক্ষন শাস্ত্রীয় সংগীতের গুরু কমই ছিলেন দুনিয়ায়। মৃত্যুর সাথে সাথে চলে গেলেন এক শাস্ত্রীয় সংগীতের কিংবদন্তী।