পরমব্রতর নাম মনে আসলেই কীভাবে যেন গোয়েন্দা চরিত্রগুলো চোখের সামনে চলে আসতে থাকে। সেটা স্বাভাবিকও বটে। তাকে দেখা গেছে ফেলুদার সহকারী তোপসে রূপে। আবার ওয়েব সিরিজে হয়েছেন ফেলুদা। এবার পূজাতে হয়ে গেলেন ব্যোমকেশ।
Published : 30 Oct 2019, 09:34 PM
কেউ একজন বলেই ফেললেন, “এবার সত্যবতী হয়ে যাও,এই বাকী আছে..”- এভাবেই শুরু করলেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। কলকাতায় এবং বাংলাদেশে তিনি ছোট্ট করে পরিচিত পরমব্রত বা শুধুই পরম হিসেবে। কাছের বন্ধুরা তাই বলেন। আর মিশলেই মোটামুটি তার বন্ধু হয়ে যায়, এটাও পরমের আশপাশে থাকা লোকে বলতে দ্বিধা বোধ করেন না।
গ্লিটজকেও পাশে পেয়ে পরম একইভাবে ‘পরম আন্তরিকতায়’ আড্ডার অংশ করে নিলেন।
‘সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ’ আর ‘পাসওয়ার্ড’ যেহেতু এবার পূজার অন্যতম আকর্ষণ ছিল, আলাপটা সেখান থেকেই শুরু হবে- সেটাই স্বাভাবিক।
"আমরা যারা অভিনয় করি, তারা অবশ্যই সাহিত্যভিত্তিক কাজ করতে ভালোবাসি”, –এভাবেই কথা শুরু করলেন পরমব্রত।
একারণেই এবার ব্যোমকেশ হওয়ার অফার আসতেই লুফে নেন তিনি। অকপটে জানালেন ‘লোভ সংবরণ’ করা সম্ভব হয়নি। কারণ কে না চায় নিজেকে সাহিত্যের নায়ক হিসেবে তুলে ধরতে! আর চরিত্রগুলো বাংলাসাহিত্যের জন্য আইকনিকও বটে।
বললেন, “এই চরিত্রগুলো বা সিনেমাগুলো দেখার একটা দর্শকগোষ্ঠী থাকেই।”
তবে এটাকে সুবিধা বলে মানতে নারাজ। কারণটা খুবই সাধারণ।
বললেন, “এই চরিত্রগুলো যারা আগে করেছেন, তাদের কারণেই ওই চরিত্রের একটা ছবি সবার মাথায় গেঁথে গেছে। সেটা যেমনই হোক। ওই ছবিটায় নিজেকে সেট করা কষ্টসাধ্যও বটে।”
ফলে ব্যোমকেশ করার সময় লোভ এবং চ্যালেঞ্জ দুটোই একসঙ্গে কাজ করে যখন তিনি চরিত্রটি করার সায় দেন।
তবে এটাও জানালেন, ব্যোমকেশ করার প্রস্তাব তার কাছে এসেছিল সেই ২০১৪ সালে। তখন ব্যক্তিগত ব্যস্ততার কারণে হয়তো কাজটি করা হয়নি। শুধু অভিনয় নয়, ছবিটি বানানোরও প্রস্তাব ছিল। তাই এবার আর হাত ফসকানোর সুযোগ দেননি তিনি।
তিনি উল্লেখ করেন, বাঙালির বৈশিষ্ট্য হলো একই সঙ্গে মিষ্টভাষী হওয়া আবার প্রয়োজনে কঠোর হাতে পরিস্থিতি সামলে নেওয়া। একটু আয়েশী-প্রেমী আবার ঠিক সময়মতো বুদ্ধি খাটিয়ে সমাধান বের করা জটিলতার। বাঙালি মানেই টকঝাল মিষ্টির একটি মিশেল। এটাই তার ভাষায় ‘বাঙালির জাতীয় চরিত্র’। যা ফেলুদা-ব্যোমকেশ – মিতিন মাসী এইসব গোয়েন্দা চরিত্রগুলো দিয়ে ঠিক ঠিক ফুটে ওঠে।
তবে তার ফেলুদা থেকে ব্যোমকেশ হওয়ার এই যাত্রাটা দর্শকের উপর কোনও প্রভাব ফেলবে কিনা- সেটা নিয়েও ভেবেছেন আগেই।
জানালেন, “ফেলুদা সিরিজটা ছিল ওয়েব প্লাটফর্মের জন্য। সেটার দর্শক আলাদা। ওয়েব সিরিজ যারা দেখেন তারা কিন্তু বড়পর্দার দর্শক অতটা নয়। এর উল্টোটাও আছে কিন্তু। ফলে যখন ব্যোমকেশ হয়েছি তখন আর ওই দ্বন্দ্বটা খুব বেশি প্রকট হওয়ার সম্ভাবনা বোধ করিনি।”
তবে হেসে জানালেন,“দর্শকের মাঝে কথা হয়েছে বটে, সেটা অন্য বিষয় নিয়ে।”
যেমন যারা আগে ফেলুদার চরিত্রে অভিনয় করেছেন, তারা সবাই পরমব্রতের তুলনায় প্রবীন শিল্পী। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সব্যসাচী ফেলুদা হয়েছেন,সেই ধারাবাহিকতায় ফেলুদা হয়েছেন পরমব্রত। কিন্তু ব্যোমকেশ রূপে নিকট অতীতে যাদের দেখা গেছে, তারা সবাই পরমেরই সহকর্মী। একই সময়ের।
“যেমন আবীর, যিশু, ওয়েব স্পেসে অনির্বাণ”- বলেই হেসে দিলেন পরমব্রত।
বিচলিত হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে দর্শকের সারাতে সব দুশ্চিন্তা চলে গেছে। বিশেষ করে প্রথম সপ্তাহের ব্যবসাতে পরমব্রত ঠিকই বুঝতে পেরেছেন যে, সমালোচনা চাপা পড়েছে নতুন ব্যোমকেশের কাঙ্ক্ষিত নির্মাণের কারণে। এর পেছনে তিনি ধন্যবাদ দিলেন দর্শকের ‘সেনসিবিলিটি’ নিয়ে। দর্শকরা ঠিকই নিজেদের জন্য সেরা ‘অপশন’ বেছে নেয়। তাই হয় তো তুলনামূলকভাবে কম প্রচারণার পরেও ব্যোমকেশ ভালো ব্যবসা করেছেন।
‘পাসওয়ার্ড’ সেই তুলনায় কম চলেছে। সেটার কারণ অবশ্য তিনি কস্ট টু রিটার্নের উপর ছেড়ে দিলেন। যেহেতু পাসওয়ার্ডের বাজেট, হলের সংখ্যা অনেক কিছুই ব্যোমকেশের তুলনায় বেশি ছিল, সেই কারণেই ব্যবসার মানদণ্ডে পিছিয়ে গেছে বলে মনে করছেন পরমব্রত।
“বাঙালি বিরক্ত না হওয়া পর্যন্ত গোয়েন্দাভিত্তিক সিনেমা হতে থাকবে..”- এমন একটি কথা বলে বসেন দেব একটি সাক্ষাৎকারে।
এ বিষয়ে প্রথমেই পরমব্রত বললেন, “এটা তার ব্যক্তিগত মতামত।”
তবে তিনি নিজে বলেন, “আমার ব্যক্তিগত মতামত, তিনি কথাটা এভাবে না বললেও পারতেন। এই স্টেটমেন্ট তার জন্য কাউন্টার প্রোডাক্টিভ হয়েছে।”
এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “বাঙালিরা বাটি-খুটি-ঘটি ধরে আকড়ে থাকে। বাংলাদেশে বাংলাই জাতীয় ভাষা। যেখানে আমাদের টিকে থাকতে হয় আরও বত্রিশটা ভাষার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। তাই আমরা নিজেদের ঐতিহ্য নিয়ে খুবই স্পর্শকাতর। নেতাজি সুভাষচন্দ্র, ফুটবল, রবীন্দ্রনাথ, সৌরভ গাঙ্গুলী, গোয়েন্দা গল্প- এগুলো আমাদের ঐতিহ্য। সাধারণত এগুলো নিয়ে কটু কথা আমরা গ্রাহ্য করি না।”
তিনি দেবকে বলেছেনও এই বিষয়টা নিয়ে। বললেন, “দেব হয়তো ওভাবে বলতে চায়নি।” তাদের দুজনের সুসম্পর্কের কারণেই বিষয়টি খোলাশা করতে পারলেন পরমব্রত।
দেবের প্রসঙ্গের সঙ্গে গোয়েন্দা যোগসুত্র আছে বলেই অবধারিতভাবে চলে এলো এবারে মুক্তি পাওয়া মিতিন মাসীর ছবিটির প্রসঙ্গও।
মিতিন মাসী নিয়ে ওয়েবস্পেসে যে সিরিজ তৈরি হচ্ছে সেটার পেছনের কারিগরও পরমব্রত। তাই বিষয়টিকে এমনিতে গুরুত্ব দিলেন তিনি।
আর বড়পর্দার মিতিন মাসী কোয়েল মল্লিকের ব্যাপারে বললেন, “আমি ভিষণ আনন্দিত কোয়েলকে মিতিন মাসী রূপে দেখে। তিনি আমার সবচেয়ে পছন্দের সহকর্মীদের একজনও বটে।”
পরমব্রত তার পরম বন্ধুর মতই বললেন, “একটু বিরতির পর মিতিন মাসী হয়ে ফিরে আসাটা খুবই বিচক্ষণতার কাজ হয়েছে।”
“এর থেকে ভালো আর কিছুই হতে পারতো না ওর জন্য।” হেসে শেষ করলেন তিনি
পূজার ছবি নিয়ে দীর্ঘ আড্ডার পর এবার জানার পালা হালের ব্যস্ততা নিয়ে। যার তালিকা হয়তো নিজেও মনে রাখতে পারছেন না পরমব্রত। নিজের প্রোডাকশন হাউজের কাজ তো আছেই। দুই হাতে কাজ করছেন অন্যদের সঙ্গেও।
দুটো ওয়েব সিরিজ. প্রস্তুতি চলছে আরও। তার করা সাম্প্রতিক ছবি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গল্প ‘বনি’র পোস্ট প্রোডাকশন চলছে,যেখানে তার সহকর্মী কোয়েল মল্লিক। অপর একটি ছবির পোস্ট শেষ, মুক্তির তোড়জোড় চলছে।
তার অভিনীত একটি হিন্দি ছবি ‘২২ নভেম্বর’ মুক্তি পাচ্ছে। সৃজিতের সঙ্গে ছবির শুট শুরু করছেন। পাশাপাশি করছেন বেসরকারী চ্যানেলে একটি কুইজ শো। সেই সঙ্গে জানালেন আরেকবার নিজের পরিচালিত ছবিতে নিজেই অভিনয় করবেন।
নিজের পরিচালনায় নিজেকে ডিরেকশন দিতে কেমন লাগে?
প্রশ্নের উত্তরে পরম হেসে বলেন, “প্রথম প্রথম ফানি লাগলেও এখন সয়ে গেছে।”
বাংলাদেশেও কাজ করছেন সমানতালে। ‘শনিবার বিকেলে’র কাজ শেষ, শবনম ফেরদৌসীর সঙ্গে একটি ছবি করছেন। অল্প কিছু কাজ বাকী আছে। সেটা নভেম্বরে শেষ করতে পারবেন বলে আশাবাদী তিনি।
আড্ডার শেষ বেলায় দুই দেশের শিল্পীদের কাজ নিয়েও বললেন। পরমব্রত মনে করেন, দুই দেশের শিল্পীদের মাঝে কাজ করতে বাধা নয় বরং স্পষ্ট নিয়মাবলী থাকা দরকার। যেটা দুই পক্ষকে সমানভাবে – সমান মানদণ্ডে বিচার করবে।
“কেউ কম পাবে – কেউ বেশি পাবে- এমন নিয়ম আমাদের শিল্পীদের কাছে কাম্য নয়। বরং সবার জন্য সমান, এমন হলেই আমাদের আত্মীক যোগাযোগ বাড়বে এবং শক্ত হবে।” বলেন পরমব্রত।
গ্লিটজের সঙ্গে আলাপের শেষে জানালেন সবচেয়ে বড় চমকটি। তাহলো পরবর্তী সিনেমার জন্য নিজেই গল্প লিখছেন পরমব্রত। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে শুটিং শুরু করবেন বলে জানালেন তিনি।
“গল্পটা বেশ চমকপ্রদ, তবে কি নিয়ে সেটা এখনই বলা যাবে না।”- বলে আবারও ফিক করে হাসলেন পরমব্রত।
পূর্ণিমার চাঁদের সঙ্গে সে বেলা হাসি মিলে রীতিমত ধাঁধার সৃষ্টি করে ফেললো। আবার দেখা হবে সেই প্রত্যাশায় আড্ডার সমাপ্তিও ঘটলো এরপর।