নতুন সহস্রাব্দের প্রথমভাগে অশ্লীলতার দাপট আর সৃজনশীলতার অভাবে যখন বড়পর্দা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত দর্শকশ্রেণি, ঠিক সেই সময়েই মুক্তি পায় ‘মনপুরা’। বাংলার চিরায়ত প্রেমের গল্পে নির্মিত এই সিনেমা দিয়ে গিয়াসউদ্দিন সেলিম আবারও হলমুখী করেছিলেন অভিমানী দর্শকদের। বাংলাদেশের সর্বকালের অন্যতম ব্যবসাসফল এই সিনেমা নির্মাণের পেছনের গল্প এবার গ্লিটজকে শোনালেন তিনি।
Published : 14 Feb 2017, 05:05 PM
ছোটপর্দা ও মঞ্চে দীর্ঘদিন কাজ করার পর বড়পর্দায় ‘মনপুরা’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে অভিষেক ঘটে নির্মাতা গিয়াস উদ্দিন সেলিমের। সম্পূর্ণ গ্রামবাংলার পটভূমিতে নির্মিত, পারিবারিক ও প্রেমের গল্পের এই ছবিটি ২০০৯সালে মুক্তি পায়। তবে, এটি মুক্তির আগেই অ্যালবাম আকারে মুক্তি দেওয়া হয় এর গানগুলো। অর্ণবের সংগীতায়োজনে ‘নিথুয়া পাথারে’, ‘আগে যদি জানতাম রে’ বন্ধু ‘কিংবা যাও পাখি বলো তারে’ গানগুলো রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সব স্তরের মানুষের কাছে। তারপর একদিন বড়পর্দায় দর্শক দেখতে পান গল্পে আর অভিনয়ে গানগুলোর দৃশ্যায়ণ।
হলে হলে তখন সিনেমাবিমুখ মানুষেরও ভীড়। সব শ্রেণির দর্শকের কাছে ‘মনপুরা’ পৌঁছে যায় নিমেষেই। কী ছিলো এর পেছনের কারণ? কেউ কেউ বলে থাকেন, চলচ্চিত্রটি দর্শকের মনে জায়গা করে নিতে গানগুলোর একটা বড় ভূমিকা ছিলো।
মনপুরার ক্ষেত্রেও মিউজিককে এমনই অপরিহার্য ভেবেছেন নির্মাতা। কিন্তু কেন?
‘আমরা জাতি হিসেবে অনেক গীতল জাতি। দেখেন, দুইশ তিনশ বছর আগে তো গদ্য ছিলো না। সব পদ্যে (গীতিকবিতা) লেখা হতো, দলিল দস্তাবেজও পদ্যে লেখা হতো। যতো পারফর্মিং আর্টস আছে সবই কিন্তু গাননির্ভর। গানের বাইরে সুরের বাইরে কিচ্ছু নাই। সিনেমাতো আমাদের এখানে আসছে একশ বছরের কিছু বেশি সময় হয়তো। সে প্রেক্ষিতে আমাদের সিনেমা তো আমাদের মতোই হবে। আমরা তো আর ইওরোপের সিনেমা বানাবো না। আমরা আমাদের জল-হাওয়া যেরকম, মাটি যেরকম, আমাদের কৃষ্টি যেরকম, আমরা ওইরকম করে সিনেমাটা বানাবো। আমরা যদিদুই আড়াই ঘন্টার একটা গল্প বলতে চাই, একটা সহজ-সরল অথবা জটিল গল্প বলতে যাই তাহলে গান ছাড়া এটাকে কল্পনা করতে পারি না।”
যোগ করলেন, “মনপুরা এই দেশের সিনেমা, এই মাটির সিনেমা, প্রেমের ছবি। গান ছাড়া মনপুরা কল্পনা করা যায় না। কিন্তু গানগুলো সিনেমাকে ছাড়িয়ে গেছে, আমি এটা বলবো না। আবার ছবিও যে গানগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে তাও আমি বলবো না। এই ছবিটার জন্য এই গানগুলো।”
কেমন করে এই মর্মস্পর্শী গল্প লিখলেন নির্মাতা গিয়াস উদ্দিন সেলিম? তার পেছনের গল্পটাও বেশ মজার।
সেই গল্প বলতে গিয়ে গিয়াসউদ্দিন সেলিম হারালেন স্মৃতিতে- “আমি যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, তখন যমুনা ব্রিজ ছিলো না। আমাদের ফেরী করে পার হতে হতো। ফেরী পারাপারের সময় নদীতে বিদ্যুতের বড় বড় ন্যাশনাল গ্রীড চোখে পড়তো। এসব ন্যাশনাল গ্রীডে রাতে পাহারাদার বসে থাকতো। একদিন রাতে আসার সময় দেখলাম এরকম একজন পাহারাদার একা একা বসে আছে। মিটমিট আলো জ্বলছে।পুরো একটা নদীতে একা একজন মানুষ। তখন আমার মনে হল, এখন তার যদি গার্লফ্রেন্ড আসতো। ওদের যদি এখন প্রেম ট্রেম হয়।”
দৃশ্যগুলো স্মৃতিতে ধরে রাখেন সেলিম। পরের অংশটার সঙ্গে নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন জড়িত।
গ্রীক পুরানের লিয়ান্ডারের মশাল জ্বেলে অপেক্ষার দৃশ্য পরবর্তীতে সত্যিই উঠে আসে ‘মনপুরা’র পরীর হাত ধরে। নির্মাতার স্মৃতিতে নদীতে একলা আলো জ্বেলে বসে থাকা বিদ্যুতের খুঁটির সেই পাহারাদারের চলচ্চিত্রে হয়ে যায় সোনাই। এভাবেই নির্মিত হয়েছে জনপ্রিয় প্রেম-উপখ্যান ‘মনপুরা’।
গিয়াস উদ্দিন সেলিমের মতে, “চলচ্চিত্র শুধু পরিচালকের মাধ্যম -এটা আমি মনে করি না। এটা একটা দলগত কাজ। নির্মাতার কাজ শুধু স্বপ্নটা ছড়িয়ে দেয়া। সবাই সেই স্বপ্নেরবাস্তবায়নটুকু করে।”
‘মনপুরা’ও এভাবেই নির্মিত হয়েছে। নির্মাতার কল্পিত দৃশ্যগুলো পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন চঞ্চল চৌধুরী, ফারহানামিলি, ফজলুর রহমান বাবু আর মামুনুর রশিদের মতো শক্তিশালী অভিনয়শিল্পীরা। ২০০৯ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ৫টি বিভাগে পুরস্কার জেতে এই ছবি।
‘মনপুরা’ মুক্তির প্রায় একদশক পর এ নির্মাতার হাতে নির্মিত হচ্ছে তার দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘স্বপ্নজাল’। আসছে অক্টোবরেই চলচ্চিত্রটি মুক্তির আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন গিয়াস উদ্দিন সেলিম।