গানের স্বত্বাধিকার নিয়ে কপিরাইট আইনে জটিলতা তৈরি হওয়ায় এন্ড্রু কিশোরের গাওয়া চলচ্চিত্রের গানের ‘রয়্যালিটি’ পাচ্ছেন না এই শিল্পীর পরিবার।
Published : 04 Nov 2024, 04:52 PM
বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অনুষ্ঠান, টেলিভেশনের পর্দা অথবা গানের কোনো আয়োজনে প্রয়াত গায়ক এন্ড্রু কিশোর তার শিল্পী পরিচয় তুলে ধরলেও, চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার সুবাদে তিনি হয়েছিলেন ‘প্লেব্যাক সম্রাট’।
কিন্তু মৃত্যুর পর চলচ্চিত্রের গানগুলো থেকে তেমন কোনো ‘রয়্যালিটি’ মিলছে না বলে জানিয়েছেন কিশোরের স্ত্রী লিপিকা এন্ড্রু।
সোমবার গায়কের ৬৯তম জন্মবার্ষিকীতে গ্লিটজের সঙ্গে আলাপচারিতায় লিপিকা বলেছেন, কপিরাইট আইন নিয়ে ‘জটিলতা তৈরি হওয়ায়’ এই শিল্পীর গাওয়া চলচ্চিত্রের গানের অধিকার পাওয়া যাচ্ছে না।
লিপিকা বলেন, “কিশোর চলচ্চিত্রের গানই তো বেশি করেছে। গানগুলোতে রয়্যালিটি দাবি করেও আমরা কিছু পাচ্ছি না। তবে ক্যাসেটের গানগুলোর পাচ্ছি। তার অনেক ক্যাসেট সংগীতা কোম্পানি থেকে বের হয়েছে। সেগুলোর মালিক সংগীতা হলেও এন্ড্রু কিশোরের স্বত্বাধিকার তারা দিচ্ছে।”
জটিলতা কোথায় প্রশ্নে তিনি বলেন, “সে সময় সিনেমা মুক্তির আগে শিল্পীকে এককালীন রেম্যুনারেশন দিয়ে ক্যাসেট আকারে গানগুলো বিক্রি করে দিত। এখন চলচ্চিত্রের প্রোডিউসাররা বলছে, গানগুলো তাদের।”
কপিরাইট আইন জানতে গ্লিটজের কথা হয় সাবেক রেজিস্ট্রার অব কপিরাইটস ও কপিরাইট আপিল বোর্ডের সদস্য জাফর রাজা চৌধুরীর সঙ্গে।
তিনি বলেন, “গানের কপিরাইট দুই ধরনের। মোর্যাল রাইট ও কমার্শিয়াল রাইট। সিনেমার গান কমার্শিয়াল রাইটের মধ্যে পড়ে। যেটা মালিকানায় একটু পার্থক্য আছে। সিনেমার গানগুলো যেহেতু নির্দিষ্ট সিনেমার জন্য ব্যবহার করা হয় তাই এটার গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে একটি চুক্তিপত্রে যুক্ত হন। কিন্তু মালিকানা থাকে প্রযোজকের।
“২০০০ সালে প্রণয়ন করা কপিরাইট আইন অনুযায়ী চলচ্চিত্রের গানের ক্ষেত্রে একমাত্র মালিক প্রোডিউসারকে দেওয়া হয়।”
তবে গানের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে প্রচার এবং শিল্পীদের দাবির প্রেক্ষিতে এই আইন সংশোধন করা হয়েছে বলে জানান জাফর রাজা চৌধুরী।
তিনি বলেন, “কপিরাইট আইন, ২০২৩ (সংশোধিত) এ বলা আছে সম্পূর্ণ রয়্যালিটি পরিহার করে কোনো চুক্তি গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী প্রযোজকের সঙ্গে করবেন না। একটা গান সিনেমায় ব্যবহার করা হলে সেটার পুরো রয়্যালিটি প্রযোজক পেলেন। এই গানটা যখন সিনেমার সাথে বাজবে তখন এটা নিয়ে কেউ অভিযোগ জানাতে পারবেন না।
“এই গানটা যখন সামাজিক মাধ্যম বা ডিজিটালে ব্যবহার করা হবে তখন ৫০ শতাংশ পাবে প্রযোজক। আর বাকি ৫০ শতাংশের এক তৃতীয়াংশ করে পাবে গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী।”
নতুন আইনে এন্ড্রু কিশোরের গানের রয়্যালিটি তার পরিবার পাবেন কি না এমন প্রশ্নে রাজা চৌধুরী বলেন, “সংশোধিত আইনটা পাস হয়েছে ২০২৩ সালে। সেদিন থেকেই কার্যকর হবে। এর আগে আইন অনুযায়ী চলচ্চিত্রের গানের মালিক প্রযোজক।
“এন্ড্রু কিশোরের গানগুলো যেহেতু ২০২৩ এর আগে অর্থাৎ নতুন আইন প্রণয়নের আগের, সেক্ষেত্রে উনি অভিযোগ করলেই গানগুলোর রয়্যালিটি পাবেন না। তবে উনারা পেতে পারেন যদি আইনের ধারা অনুসারে হাই কোর্টে রিট করেন তাহলে। অর্থাৎ আইনের ব্যাখ্যা দিয়ে আইনের আশ্রয় নিয়ে গানের রয়্যালিটি নিতে হবে।”
সচেতনতার অভাবে দেশের সংগীতাঙ্গনে কপিরাইট আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন হয়নি বলে মনে করছেন লিপিকা।
এন্ড্রু কিশোরের সব গান সংরক্ষণে ‘রাখা যাচ্ছে না’ বলেও অভিযোগ তার।
“পরবর্তী প্রজন্মের কাছে গানগুলো পৌঁছানো, নামটা পৌঁছানোর জন্য যে আর্কাইভ তৈরি করে রাখব তা হচ্ছে না, কপিরাইট আইনে গিয়ে এগুলো আটকে যাচ্ছে। কপিরাইট আইনে এই গানগুলোর স্বত্বাধিকার কে, মালিক কে এটা নিয়ে সমস্যা তৈরি হচ্ছে।”
এন্ড্রু কিশোরের জন্ম ১৯৫৫ সালের ৪ নভেম্বর রাজশাহীতে; সেখানেই কেটেছে তার শৈশব ও কৈশোর। ছোট বেলা থেকেই সঙ্গীতে অনুরক্ত ছিলেন তিনি। প্রাথমিকভাবে সংগীতের পাঠ শুরু করেন রাজশাহীর আবদুল আজিজ বাচ্চুর কাছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনায় পড়লেও গানই ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত, আধুনিক গান, লোকগান ও দেশাত্মবোধক গানে রাজশাহী বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী হন।
একসময় গানের নেশায় এন্ড্রু কিশোর ছুটে আসেন রাজধানী ঢাকায়। চলচ্চিত্রে গান গাওয়া শুরু হয়েছিল ১৯৭৭ সালে; ‘মেইল ট্রেন’ এ আলম খানের সুরে ‘অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তার কেউ’ গানের মধ্য দিয়ে। এরপর বাদল রহমানের ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’তেও কণ্ঠ দেন তিনি।
১৯৭৯ সালে প্রতিজ্ঞা চলচ্চিত্রের ‘এক চোর যায় চলে’ গান গাওয়ার পর আর পেছনে ফিরতে হয়নি তাকে। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিক পর্যন্ত চলচ্চিত্রের গানে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল তার।
লিপিকা বলেছেন, শিল্পীদের কপিরাইট অধিকার নিশ্চিত করার জন্য কাজ করছিলেন গায়ক, ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার কারণে সেটিকে এগিয়ে নিতে পারেননি।
“শিল্পীদের গানের কপিরাইট অধিকার বা আইন তৈরি করে যাওয়া, যেটাকে কাজে লাগিয়ে শিল্পীরা সারাজীবন চলতে পারবে। শিল্পীদের গানের যে প্রাপ্যতা, ডিজিটাল মাধ্যমে গান যেভাবে আসছে সেটার প্রাপ্য টাকা পাওয়া, শিল্পীদের উপযুক্ত স্বত্বাধিকার নিশ্চিত করে দেওয়ার কাজটি সে শুরু করেছিল।”
কাজটি শেষ করতে না পারার জন্য মৃত্যুর আগেও কিশোর মেয়ের কাছে ‘আফসোস করেছিলেন’ বলে জানিয়েন লিপিকা।
লিপিকার বলেছেন, ‘দুস্থ শিল্পী’ শব্দটা থেকে শিল্পীদের মুক্ত করার জন্য তার স্বামী ওই করার জন্য এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর।
তিনি বলেন, “শিল্পীদের নিজস্ব একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরির চেষ্টা করেছিলেন, যেখান থেকে শিল্পীরা সাহায্য পাবেন, তাদের প্রয়োজন পূরণ হবে। অসুস্থতায় সরকারের কাছে শিল্পীদের যেন হাত পাততে না হয়।“
কাজটি কীভাবে তিনি করছিলেন জানতে চাইলে লিপিকা বলেন, “প্রথমে এনসিএস (নো কপিরাইট সাউন্ড) তৈরি হল, তারপর এলসিএস গিল্ড তৈরি করেছিল, কপিরাইট আইন হল, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে আইন পাস হল, কপিরাইট অফিসও হল। কিন্তু এই প্রক্রিয়াটা উনি শেষ করে যেতে পারেননি। এখনো কপিরাইট আইন লঙ্ঘিত হচ্ছে, কপিরাইট অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তার অনেক গান,” বলেন শিল্পীর স্ত্রী।
এন্ড্রু কিশোরের গাওয়া সিনেমার গানগুলোর মধ্যে ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘ভালোবেসে গেলাম শুধু’, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘ডাক দিয়েছেন দয়াল আমারে’, ‘সবাই তো ভালবাসা চায়’, ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’, ‘সবাই তো ভালবাসা চায়’, ‘আমার বুকের মধ্যেখানে’, ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান’, ‘ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা’, ‘আমি চিরকাল প্রেমেরও কাঙাল’, ‘বেদের মেয়ে জোছনা আমায় কথা দিয়েছে’- এমন অনেক গান এখনও মানুষের মুখে ফেরে। গান গেয়ে আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জেতেন তিনি।
লিপিকা বলেছেন কপিরাইট আইন হচ্ছে, বিধিমালা হচ্ছে, সংশোধন হচ্ছে কিন্তু অগ্রগতি হচ্ছে না।
“গত তিন বছরে এটা নিয়ে সব শিল্পীরা সম্মিলিত হয়েছে, মিটিং হয়েছে আমিও কয়েকবার গিয়েছি। খুব একটা অগ্রগতি হয়নি। কিছুদিন আগে গানের রয়্যালিটি নিয়ে সিসাক নামের আন্তর্জাতিক কোম্পানির সঙ্গে একটা এগ্রিমেন্ট করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটার দায়িত্বে আছে বিএলসিপিএস সভাপতি হামিন আহমেদ। তবে এগুলোও খুব মন্থর প্রক্রিয়া।”
এন্ড্রু কিশোরকে নিয়ে ‘স্টার গ্যালারি’ তৈরির ইচ্ছে আছে লিপিকার। যেখানে তার গান, স্মৃতি সংরক্ষণ থাকবে, মানুষ তার সম্পর্কে জানতে পারবে বলে জানিয়েছেন লিপিকা।
মৃত্যুর পর এন্ড্রু কিশোরকে যথাযথভাবে স্মরণ করা হচ্ছে না বলেও আক্ষেপ করেছেন গায়কের স্ত্রী।
“দেশে এতো এতো চ্যানেল, সংগঠন আছে উনাকে নিয়ে কেউ কিছু করে না। জন্মবার্ষিকী বা মৃত্যুবার্ষিকীতে তাকে নিয়ে কোনো আলোচনা, স্মৃতিচারণ, গানের অনুষ্ঠান হয় না। বিশেষ দিনগুলোতে তার কৃতিত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয় না। এগুলো আমাদের খুব পীড়া দেয়।”
ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে নয় মাস ধরে ভুগছিলেন এই গায়ক। চিকিৎসা নিতে গিয়েছিলেন বিদেশেও। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। কোভিড মহামারীর বছর ২০২০ সালে ৬ জুলাই রাজশাহীতে ৬৪ বছর বয়সে চলে যান এন্ড্রু কিশোর।
আরও পড়ুন
এন্ড্রু কিশোরের জনপ্রিয় ১০ গান
বলিউডে গেলে 'এক নম্বর থাকতেন' এন্ড্রু কিশোর
এন্ড্রু কিশোরের কষ্টের শেষ দিনগুলো