ভারতের আরআরআরে কেন মজল পশ্চিমারা?

সমালোচকদের চোখে সিনেমাটি মাঝারি মানের, তাই মাত করেছে পশ্চিমা দুনিয়া; নাটু নাটু গানের সঙ্গে নাচতে নেমেছেন আমেরিকান দর্শকরাও।

গ্লিটজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Jan 2023, 07:02 AM
Updated : 26 Jan 2023, 07:02 AM

আরআরআর মুক্তি পেয়েছে ১০ মাস হয়ে গেল, তবে এর জয়রথ এখনও চলছে। নানা আলোচনায় এখনও সদর্প উপস্থিতি ভারতের এই সিনেমার। কিছুদিন আগে সিনেমাটির ‘নাটু নাটু’ গানটি গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার জিতেছে। অস্কারেও সংক্ষিপ্ত তালিকায় মনোনীত হয়ে গেছে গানটি। বলিউডেরও নয়, দক্ষিণ ভারতের এই সিনেমা নিয়ে কেন এত শোরগোল, তার কারণ খুঁজেছেন বিবিসির মেরিল সেবাস্টিয়ান।

নির্মাতা এস এস রাজামৌলি আগেই বলেছেন, ভারতীয় দর্শকদের কথা মাথায় রেখেই আরআরআর বানিয়েছেন তিনি। তবে মুক্তির পর দেখা গেল, ভৌগলিক সীমানা ছাড়িয়েছে সিনেমাটির জনপ্রিয়তা, যেখানে তেলুগু ভাষার তারকা রাম চরণ এবং এনটিআর জুনিয়র ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে দুই উদ্যমী যুবকের লড়াইয়ের গল্প রূপায়ন করেছেন।

আরআরআর বিশ্বব্যাপী ইতোমধ্যে ১২০০ কোটি রুপি আয় করেছে, জাপানেও বক্স-অফিসে সমস্ত রেকর্ড ভাঙতে চলছে ভারতের সিনেমাটি। যুক্তরাষ্ট্রে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্সে শীর্ষ ১০ এ ছিল পুরো এক সপ্তাহ। ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল বোর্ড অফ রিভিউসহ সেরা চলচ্চিত্রের বেশ কয়েকটি খেতাবও জিতেছে সিনেমাটি।

Also Read: ‘ক্রিটিকস চয়েসে’ জোড়া পুরস্কার জিতল ‘আরআরআর’

Also Read: গোল্ডেন গ্লোবে সেরা গান ‘আরআরআর’ সিনেমার ‘নাটু নাটু’

Also Read: অস্কারেও মনোনয়ন পেল ‘নাটু নাটু’

নিজের সিনেমার এমন সাফল্যে রাজামৌলি যেমন আনন্দিত, তেমনই বিস্মিত, যা তিনি নানা সাক্ষাৎকারে বলেছেন।

তিনি সম্প্রতি মার্কিন টক শো ‘লেট নাইট উইথ সেথ মেয়ার্স’ এ রসিকতা করে বলেছেন, “যখন আমরা পশ্চিম থেকে প্রশংসা পেতে শুরু করি, তখন ভেবেছিলাম, ভারতীয়দের বন্ধুরাই হয়ত এই সিনেমা দেখতে গেছে।”

‘নিউ ইয়র্ক ফিল্ম ক্রিটিক সার্কেল’র সদস্য সিদ্ধান্ত আদলাখা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তির শুরুর দিকে অন্যান্য মূলধারার ভারতীয় সিনেমা থেকে ‘আরআরআর’র তেমন কোনো ফারাক ছিল না।

“ছুটির দিনে যত দর্শক ছিল, তার বেশিরভাগই ছিল ভারতীয়। তবে পরবর্তী কয়েক সপ্তাহের ভেতর দর্শকদের ধরন সম্পূর্ণভাবে বদলাতে শুরু করে।”

যুক্তরাষ্ট্রের এই চলচ্চিত্র সমালোচক বলেন, জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকলে সিনেমাটি নিয়ে সমালোচকেরা রিভিউ লিখতে শুরু করে দেয়। অ্যান্থনি এবং জো রুশো, এডগার রাইট, স্কট ডেরিকসন ও জেমস গানের মতো হলিউড নির্মাতারাও প্রশংসা করেন সিনেমাটির। আমেরিকার অনেক প্রেক্ষাগৃহ শুধু দর্শক চাহিদার জন্যই সিনেমাটি প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত নেয়।

আদলাখা বলেন, “প্রেক্ষাগৃহ থেকে শুরু করে সোশাল মিডিয়ায় ‘আরআরআর’ নিয়ে দর্শকদের ছিল প্রবল উচ্ছ্বাস। সম্প্রতি অন্য কোনো ভারতীয় সিনেমা নিয়ে এতটা মাতামাতি হতে দেখা যায়নি।”

সোশাল মিডিয়ায় নানা ভিডিওতে সিনেমা দেখে বেরিয়ে আসা দর্শককে হর্ষধ্বনি দিতে দেখা গেছে। ভারতীয় সিনেমার সুপারস্টারদের নিয়ে এমন উচ্ছ্বাস দেখা গেলেও আমেরিকায় তা বিরল। একটি শোতে তো দর্শকদের ‘নাটু নাটু’ (নাচো নাচো) নাচতে মঞ্চে উঠে পড়তে দেখা যায়।

আদলেখা বলেন, “দর্শকদের পাশাপাশি চলচ্চিত্র নির্মাতাদেরও ভিন্ন ধরনের সিনেমা দেখার সংস্কৃতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে আরআরআর। হয়ত এতে তারা অভ্যস্ত নয়। সম্ভবত এ কারণেই কিছু হলিউড চলচ্চিত্র নির্মাতাও আকৃষ্ট হয়েছে সিনেমাটির প্রতি।”

বিনোদন সংবাদমাধ্যম লেইনিগসিপের প্রতিষ্ঠাতা ও টিভি সঞ্চালক এলেন লুইয়ের চোখে আরআরআর প্রবল বেপরোয়া ও সেরা একটি সিনেমা। তিনি বলেন, আরআরআর হচ্ছে সেই সিনেমা, যা হলে গিয়ে দেখবে বলে দর্শকেরা অপেক্ষা করেছে। এমনকি ঘরে বসে নেটফ্লিক্সের জন্যও।

ভারতে যদিও অস্কারের জন্য বাছাই পর্বে গুজরাটি সিনেমা ‘চেলো শো’র কাছে পিছিয়ে পড়েছিল আরআরআর, তবে ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা, হলিউড নির্মাতা ও তারকাদের সমর্থনেই শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী সাফল্য এনে দিয়েছে সিনেমাটিকে।

লুই মনে করেন, “শিল্পে গুঞ্জন একটি বড় ব্যাপার, আজকাল কথোপকথনের অংশ হয়ে উঠেছে আরআরআর। ছুটির দিন হোক কিংবা পার্টি, সবাই এখন বলছে- আপনি কি আরআরআর দেখেছেন?”

গত কয়েকবছরে মার্কিন বক্স অফিসে ‘মার্ভেল সিনেমাটিক ইউনিভার্স’ এবং ‘ফাস্ট অ্যান্ড ফিউরিয়াস’র মতো ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর আধিপত্যের কারণে পাশ্চাত্যের অনেকেই আরআরআরকে নতুন ঘরানার এক উত্তেজনাপূর্ণ সিনেমা মনে করতে শুরু করেছে বলে লুইয়ের ভাষ্য।

বলিউড এবং টলিউড (তেলেগু) সিনেমাগুলোকে প্রতিনিধিত্ব করছে আরআরআর। অন্য ভাষাভাষীর দর্শকরা এবার ভারতীয় সিনেমাগুলো থেকে দুর্দান্ত দৃশ্য, জনসমাগম, অ্যাকশন, উচ্চাকাঙ্ক্ষার পাশাপাশি গতানুগতিক নয় এমন সিনেমাই প্রত্যাশা করবে বলে মনে করছেন লুই।

ভ্যারাইটি ম্যাগাজিনের মতে, সেরা চলচ্চিত্র, সেরা পরিচালক, সেরা চিত্রনাট্য এবং সেরা মৌলিক গান বিভাগে মনোনীত হওয়ার সামর্থ্য রাখে ‘আরআরআর’।

এদিকে নির্মাতাদের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র বিভাগে সিনেমাটি জমা না দেওয়ার সিদ্ধান্তের পরও হলিউডের সফল সিনেমাদের টেক্কা দেওয়ার ঘটনাটি দর্শকদের ভিন্নভাবে ভাবতে বাধ্য করেছে বলে মনে করেন আদলাখা।

আদলাখা হালের মার্কিন ব্লকবাস্টার সিনেমাগুলোকে একরৈখিক মনে করেন, যেগুলো তৈরি হয় কারখানার পণ্যের মতো করে। সে বিবেচনায় ‘আন্তরিক ও সাবলীল’ আরআরআর সেসব সিনেমাকে ছাপিয়ে যেতে পারেই।

আদলাখা বলেন, “রাজামৌলির আরআরআরে একাধিক অসামান্য সেট পিস, দুর্দান্ত দৃশ্য ও কাল্পনিক এক গল্প এক অনন্য অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করে।

“আমেরিকান দর্শকরা সাধারণত এই ধরনে অভ্যস্ত নয়। তবে সিনেমায় সমস্ত কিছুর মাঝে নিখুঁত সংযোগ ঘটেছে, ফলে যে কোনো সংস্কৃতির দর্শকেরা নিজের সঙ্গে সিনেমাটিকে মেলাতে পারবে।”

এ সমালোচকের বিবেচনায় সিনেমাটিতে নায়কদের প্রথম সাক্ষাতের দৃশ্যটি অসামান্য কিছু একটা। আগুনে আটকা পড়া একটি শিশুকে উদ্ধার করার আগে সেতুর উপর ঘোড়া ও মোটরবাইকে চড়া অবস্থায় যখন দেখা হয় দুজনের।

বেশ কয়েকজন সমালোচক সিনেমাটিকে মাঝারি মানেরই ভেবেছিলেন; সিনেমাটিতে রাজনীতিকরণ, দেবমূর্তির ব্যবহার এবং আদিবাসী সংস্কৃতির দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন তারা।

লেখক ও চলচ্চিত্র সমালোচক সৌম্য রাজেন্দ্রন বলেন, “ভারতে সিনেমার মধ্যে রাজনীতি ঢুকে পড়েছে। সিনেমায় দুই রিয়েল-লাইফ হিরো আদিবাসীদের অধিকারের জন্য ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন, সেখানে আবার তাদের হিন্দু পৌরাণিক নায়কের মতো করে দেখানো হল, এই বিষয়টি আরও তীক্ষ্ণ নজরে দেখার দাবি রাখে।

“যদিও পশ্চিমা দর্শকরা সিনেমাটিকে উপনিবেশবিরোধী একটি আখ্যান হিসাবেই দেখেছে, কারণ সেই রাজনীতিটাই তাদের মাথায় আগে আসে।”

যুক্তরাষ্ট্রে গুটিকয়েক বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করছে। তবে সিনেমাটিকে ঘিরে সমস্ত সমালোচনা শেষতক আলোচনারই অংশ হয়ে উঠছে বলে আদলাখা মনে করেছেন।

সমালোচনা যাই হোক না কেন, এটা মানতে হবে রাজামৌলি এমন একটি সিনেমা বানিয়েছেন, যা শুধু দক্ষিণ ভারতের সীমানাই ছাড়ায়নি, ছাড়িয়েছে আন্তর্জাতিক সীমানাও।

আর তা ভারতীয় এই নির্মাতার হলিউডি সিনেমা বানানোর স্বপ্নেও বসত দিচ্ছে; তার ভাষায়, যা বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তের চলচ্চিত্র নির্মাতারই স্বপ্ন।