জীবন বদলে দিয়েছে ‘মাটির ময়না’: রোকেয়া প্রাচী

“তারেক ভাই, ক্যাথরিনের সাথে পরিচয় হওয়ার পর জীবনবোধ সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে শিখেছি,” বলেন ‘মাটির ময়না’র অভিনেত্রী।

পাভেল রহমানগ্লিটজ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 August 2022, 01:08 PM
Updated : 12 August 2022, 01:09 PM

যে সিনেমায় অভিনয়ের সুবাদে কান চলচ্চিত্র উৎসবের আমন্ত্রণ মিলেছিল, সেই ‘মাটির ময়না’ আর তার নির্মাতা তারেক মাসুদের কাছ থেকে ‘জীবনবোধের নতুন পাঠ’ পেয়েছিলেন অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচী।

চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদের একাদশ মৃত্যুবার্ষিকীর আগে গ্লিটজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি স্মরণ করেছেন প্রিয় ‘তারেক ভাই’ আর মাটির ময়নার সেই অভিযাত্রার কথা।

সিনেমাটির অভিনেত্রী হিসাবে রোকেয়া প্রাচী আমন্ত্রিত হয়েছিলেন কান চলচ্চিত্র উৎসবে। সেই স্মৃতিচারণ করে তিনি বলছিলেন, “তারেক ভাই ও ক্যাথরিন এমন একটা সময়ে আমাকে সিনেমাটিতে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন, যখন আমার জীবনের খুবই বিপর্যস্ত সময় পার করছিলাম। এই সিনেমাটি আমার জীবনকে বদলে দিয়েছে।”

তারেক মাসুদ ১৯৮২ সালে শিল্পী এস এম সুলতানের ওপর তথ্যচিত্র ‘আদম সুরত’ নির্মাণ শুরু করেন, যেটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৮৯ সালে। সেই তথ্যচিত্র নির্মাণকালে আহমদ ছফার মাধ্যমে ক্যাথরিন মাসুদের সঙ্গে পরিচয় ঘটে তারেকের।

এরপর বন্ধুত্ব, প্রণয়; ক্যাথরিন হয়ে ওঠেন তারেকের শিল্পসঙ্গী। এই জুটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র ‘মুক্তির গান’ ও ‘মুক্তির কথা’ এবং পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘রানওয়ে’ ও ‘অন্তর্যাত্রা’ নির্মাণ করে আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসা কুড়ান।

তারেক মাসুদেরই আরেক সৃষ্টি ‘মাটির ময়না’ কান উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছিল ২০০২ সালে। যদিও সিনেমাটিকে হাঁটতে হয়েছিল বন্ধুর পথে, ছাড়পত্রের খড়গে পড়ে ক্যাথরিন প্রযোজিত সিনেমাটি। কান উৎসবে আমন্ত্রিত হয়েও ‘সরকারের রোষানলে’ সেখানে অংশ নেওয়া অনিশ্চিত হয়েছিল রোকেয়া প্রাচীর।

সেই স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে আবেগাল্পুত এ অভিনেত্রী বলেন, “তখন বিএনপি সরকার ক্ষমতায় ছিল, ‘মাটির ময়না’ চলচ্চিত্রটি সেন্সর বোর্ড থেকে আটকে দেওয়া হয়। এর ফলে বাংলাদেশে ছবিটি মুক্তি দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। তখনই কান উৎসবের আমন্ত্রণটি আসে।

“অভিনেত্রী হিসাবে আমাকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমি তখন শিল্পকলা একাডেমিতে চাকরি করি। বিদেশ সফরের জন্য আমাকে শিল্পকলা থেকে ছাড়পত্র নিতে হবে, কিন্তু তারা আমাকে ছাড়পত্র দেবে না। নানা রকম অসম্মানজনক আচরণ করছিল।”

‘মাটির ময়না’ প্রথম বাংলাদেশি চলচ্চিত্র, যেটি কান চলচ্চিত্র উৎসবের ডিরেক্টরস ফোর্টনাইট ইভেন্ট ডে‘তে আমন্ত্রিত হয়েছিল, পেয়েছিল পুরস্কার। কান উৎসবের রীতি অনুযায়ী পুরস্কারপ্রাপ্ত সিনেমার অভিনেত্রী হিসাবে ডিরেক্টরস ফোর্টনাইট পর্বটি উদ্বোধন করেছিলেন রোকেয়া প্রাচী। সেই সফরে অভিনেতা জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, তারেক মাসুদ, ক্যাথরিন মাসুদ ও রোকেয়া প্রাচী অংশ নেন।

সিনেমাটিতে অভিনয়ের কারণে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ কাজে সম্পৃক্ত হওয়ার অভিযোগ আনা হয় জানিয়ে রোকেয়া প্রাচী বলেন, “এজন্য আমাকে মুচলেকা দিতে বলা হয়েছিল। তাছাড়া আমার উপর তাদের রাগের আরেকটি কারণ ছিল শিল্পকলায় আমার চাকরিটা হয়েছিল তৎকালীন (১৯৯৬-২০০১) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে।

“এজন্য পরবর্তীতে বিএনপিপন্থি যারা শিল্পকলায় চাকরি করতেন, তারা আমার সঙ্গে খুবই অসম্মানজনক আচরণ করছিলেন।”

কান উৎসবে অংশ নেওয়ার আগে দেশে ‘হয়রানির শিকার’ হতে হয়েছিল জানিয়ে ‘মাটির ময়না’ অভিনেত্রী বলেন, “সরকারি চাকরিতে বিদেশ সফরের জন্য ছাড়পত্র নিতে হলে মুচলেকা দেওয়ার কোনো বিধি ছিল না।

“কিন্তু তারা আমাকে মুচলেকা দিতে বলেছিল, সেখানে লেখা ছিল- বিদেশে গিয়ে আমি কোনো রাষ্ট্রবিরোধী কাজ করব না। এটা একজন শিল্পী হিসাবে আমার জন্য খুবই অসম্মানের ছিল।”

মুচলেকা দিয়েই পরে কানে অংশ নিয়েছিলেন জানিয়ে সেই বেদনার কথা বর্ণনা করলেন রোকেয়া প্রাচী।

তার কথায়, “এত বড় একটা আয়োজনে অংশ নেওয়া ছিল দেশের জন্য গৌরবের, সেটা চিন্তা করে মুচলেকা দিয়েই ছাড়পত্র নিয়েছিলাম।

“কিন্তু কান উৎসব থেকে ফেরার পর এই মুচলেকা দেওয়ার ব্যাপারটি আমাকে ভীষণ পীড়া দিচ্ছিল। এজন্য শিল্পকলার চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলাম।”

আশির দশকে আরণ্যক নাট্যদলের হয়ে মঞ্চে অভিনয় শুরু রোকেয়া প্রাচীর। ১৯৯৭ সালে মোরশেদুল ইসলামের পরিচালনায় ‘দুখাই’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। এর কয়েক বছর পর তারেক-ক্যাথরিন জুটির সঙ্গে পরিচয় হলে তারা ‘মাটির ময়না’য় অভিনয়ের প্রস্তাব দেন।

রোকেয়া প্রাচী বলেন, “আমার মেয়ে রিমঝিমও সিনেমাটিতে অভিনয় করেছে। তারেক ভাইয়ের পরিচালনায় অভিনয় করতে গিয়ে কখনোই মনে হয়নি আমি পরিবারের বাইরে আছি। ‘মাটির ময়না’র পুরো ইউনিট আমার পরিবারের অংশ হয়ে উঠেছিল।”

যুক্তরাজ্যে মূলধারায় মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম বাংলাদেশি চলচ্চিত্রও ‘মাটির ময়না’। ২০০৩ সালের ৪ জুলাই জেনেসিস, আইসিএ ও বারবিকান সেন্টারসহ লন্ডনের অন্যান্য প্রেক্ষাগৃহে সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিল।

সেই সিনেমার শুটিংয়ের অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে অভিনেত্রী রোকেয়া বললেন, “তারেক ভাই, ক্যাথরিনের সাথে পরিচয় হওয়ার পর জীবনবোধ সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে শিখেছি।

“তারেক ভাই আমাদের টিমকে এত চমৎকার করে মোটিভেট করতে পারতেন, তখন কাজে কোনো ক্লান্তি আসত না। শুটিংয়ের সময় তিনি বলতেন, অভিনয় না করে আমি যেমন- তেমনটাই যেন করি। সারাক্ষণ মাতিয়ে রাখতেন শুটিং সেট!”

সবশেষ ‘কাগজের ফুল’ নামে একটি চলচ্চিত্রের পরিকল্পনা করছিলেন তারেক মাসুদ। সেই চলচ্চিত্রের শুটিং লোকেশন দেখে ফেরার পথে ২০১১ সালের ১৩ অগাস্ট সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান তারেক মাসুদ, চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনীরসহ আরও তিনজন। ক্যাথরিনও আহত হন সেই দুর্ঘটনায়।