সিনেমা মুক্তির আগেই প্রথম শোয়ের দুইশ টিকেট কিনে নিয়েছেন এক দর্শক।
Published : 26 Jan 2023, 02:53 PM
গণ অর্থায়নে নির্মিত সিনেমা সাঁতাও প্রদর্শন নিয়ে সঙ্কট আপাতত কেটেছে, শুক্রবার এ সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে পাঁচটি হলে।
ঢাকার বসুন্ধরা সিটিতে স্টার সিনেপ্লেক্স, যমুনা ফিউচার পার্কের ব্লকবাস্টার সিনেমাস, রংপুরের শাপলা সিনেমা হল, চট্টগ্রামের সুগন্ধা ও সিলভার স্ক্রিনে এ সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে বলে জানিয়েছেন এর নির্মাতা।
রংপুর অঞ্চলের সুরেলা জনগোষ্ঠির যাপিত জীবন ও প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের রসায়ন নিয়ে ‘সাঁতাও’ নির্মাণ করেছেন খন্দকার সুমন। গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন আইনুন পুতুল, ফজলুল হক ও আব্দুল্লাহ আল সেন্টু।
খন্দকার সুমন গ্লিটজকে বলেন, “সাঁতাও নিয়ে দর্শক ও সিনেমা সংশ্লিষ্টদের ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করেছে, ঋণী করেছে। সবাই যেভাবে এসে সাঁতাওয়ের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, সিনেমাটি নিজেদের মনে করে প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছেন, আমার মনে হচ্ছে তারা সবাই সিনেমাটির অবিভাবক।
“এভাবে সবাই মিলে যখন একটা সিনেমার জন্য কাজ করা হয়, তখন শুধু সেই সিনেমাটাই জিতে যায় না। জিতে যায় চলচ্চিত্র। সাঁতাও প্রমাণ করেছে বাংলাদেশে কোনো চলচ্চিত্র নির্মাতা নিঃসঙ্গ না, একা না। আমরা সবাই মিলে চলচ্চিত্রের লোক।”
ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশ প্যানারোমা বিভাগে সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কারজয়ী সিনেমাটির মুক্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল হল মালিকদের দ্বিধার কারণে। এখন মুক্তি নিশ্চিত হওয়ায় চলচ্চিত্রাঙ্গণের অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন।
সিনেমার পোস্টার ফেইসবুকে শেয়ার করে পূনর্জন্মের নির্মাতা ভিকি জায়েদ লিখেছেন, “সাঁতাও নির্মাতা খন্দকার সুমন ভাইয়ের স্বপ্ন। এই স্বপ্ন বাস্তবতায় রূপান্তরিত হতে যাচ্ছে আগামীকাল (২৭ জানুয়ারী)।… চলুন আমরা সবাই সিনেমা হলে সাঁতাও দেখি এবং নির্মাতাকে আমাদের অনুভূতি জানাই। সুমন ভাই আপনার জন্য অনেক শুভকামনা ও ভালোবাসা।”
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির নেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রযোজক অপূর্ব রানা লিখেছেন, “খন্দকার সুমন একজন চলচ্চিত্র যোদ্ধা। চলচ্চিত্রের প্রতি আপনার মায়া, ভালবাসা, আবেগ, অনুভূতি অনেক সম্মানের। আপনাকে চলচ্চিত্রের আকাশে স্বাগত।
“সাঁতাও প্রত্যেকটা চলচ্চিত্রপ্রেমির কাছে পৌঁছে যাক এটাই চাই। দোয়া করি আপনার ও আপনার টিমের অমানবিক পরিশ্রম সার্থক হোক। যারা চলচ্চিত্রকে ভালবাসেন, চলুন সিনেমা হলে সাঁতাও দেখে আসি দলে বলে।”
আলোচিত অভিনেতা নাসির উদ্দিন খান লিখেছেন, “রংপুরের ভাষায় গণঅর্থায়নে নির্মিত সিনেমা সাঁতাও মুক্তি পাচ্ছে ২৭ জানুয়ারী। চলবে দেশের কয়েকটি সিনেমা হলসহ চট্টগ্রামের সিলভার স্ক্রিন এবং সুগন্ধায়। সাঁতাও এর জন্য অনেক অনেক শুভ কামনা রইল।”
রংপুর অঞ্চলের গল্প ও আঞ্চলিক ভাষায় নির্মিত এ সিনেমা নিয়ে রংপুরে ‘গণজোয়ার’ সৃষ্টি হয়েছে মন্তব্য করে সুমন বলেন, “রংপুরে শাপলা সিনেমা হলে টিকিটের প্রিসেল শুরু হয়েছে। নাসরিন আক্তার রানু নামের এক বন্ধু প্রথম শোয়ের দুইশ টিকেট কিনে নিয়েছে। একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা এমন ভালোবাসা পেলে তার আর কী লাগে?”
রংপুর ছাড়াও ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামের দুটি হলে মুক্তি পাচ্ছে সাঁতাও। এ বিষয়ে সুমন বলেন, “চট্টগ্রামের মানুষের মধ্যে একটা বড় গুণ আছে। তারা যেমন নিজেদের শিকড় ভালবাসে, তেমনি অন্যের শিকড়কেও সম্মান করে।
“সাঁতাও চট্টগ্রামে সম্মানিত হবে। কারণ ‘সাঁতাও’ শিকাড়ের গল্প বলে। পৃথিবীর যে কোন দেশের মানুষ ‘সাঁতাও’ দেখে পছন্দ করবে, কারণ ‘সাঁতাও’ সবাইকে তার নিজ শিকড়ের কথা মনে করিয়ে দেয়।”
উজানের বাঁধে মরুভূমিতে রূপ নেওয়া ভাটি অঞ্চলের কৃষকের হাত-পা বাঁধা প্রকৃতি আর এলাকার প্রভাবশালীদের কাছে। সেইসব কৃষকদের যাপিত জীবনের যন্ত্রণা আর সংগ্রাম নিয়ে নির্মিত সিনেমা ‘সাঁতাও’।
নির্মাতা জানান, টানা কয়েকদিনের অবিরাম বর্ষণকে রংপুর অঞ্চলে বলে ‘সাঁতাও’। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন যাপনের চিত্রায়নের প্রয়াস থেকে তার এ সিনেমার কাজে হাত দেওয়া।
“শৈশবে সাঁতাওয়ের কবলে ঘরে বন্দি থাকার অনুভূতি নিয়ে আমার সিনেমা। এতে তুলে ধরা হয়েছে প্রকৃতি তথা মাটি, প্রাণী ও মানুষের সম্পর্কের গল্প। আছে মাতৃত্বের সার্বজনীন রূপ এবং সুরেলা জনগোষ্ঠীর সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না।”
সুমন বলেন, ওই এলাকায় এমন জনগোষ্ঠী আছেন, তারা গান গেয়ে মাতম করেন, গান গেয়ে আনন্দ করেন। তাদের সুখ দুঃখ সবকিছু প্রকাশ ঘটে সংগীতে। তাদেরই ‘সুরেলা জনগোষ্ঠী’ বা মিউজিক্যাল কমিউনিটি বলা হচ্ছে।
সুমন জানান, রংপুরের তিস্তা তীরবর্তী চর গগুন্দা নামের যে গ্রামে সাঁতাওয়ের শুটিং হয়েছিল, সেই গ্রামটি তিস্তার ভাঙনে এখন নদীগর্ভে।
“আমাদের সিনেমায় একটি তালগাছ আছে। এখন সেই তালগাছটা নদীর মাঝে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে।”
তিনি বলেন, নানা প্রকল্পের নাম করে নদীর উপর একের পর এক বাঁধ নির্মিত হয়েছে। উজানে বাঁধের কারণে ভাটি অঞ্চল পরিণত হচ্ছে মরুভূমিতে। কৃত্রিম সেচে চাষাবাদ হচ্ছে, কিন্তু তার নিয়ন্ত্রণ থাকছে গ্রামের প্রভাবশালীদের হাতে। সাধারণ কৃষক সেখানে অসহায়। আবার ভরা বর্ষায় বাঁধ খুলে দেওয়ায় কৃষকের ফসল ও গ্রাম তলিয়ে যাচ্ছে নদীগর্ভে।
“কৃষকের এই অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে রমরমা ব্যবসা করছে দাদন ব্যবসায়ী এবং ক্ষুদ্র ঋণদাতা সংস্থাগুলো। এক দিকে ক্ষুদ্র ঋণের কিস্তির চাপ, অন্য দিকে কৃষির জন্য বৈরী পরিবেশ। গ্রাম ছেড়ে কৃষক শহরে যাচ্ছে, হাত দিচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে। হয়ত দুর্ঘটনায় লাশ হয়ে ফিরে আসছে গ্রামে।”
এমন সব চলমান ঘটনার বিপরীতে থাকা একজন সাধারণ কৃষক ফজলু। মা-বাবাহীন ফজলু বিয়ে করে উজানের গ্রামের মেয়ে পুতুলকে। পুতুলের একাকীত্ব দূর করতে তাদের পরিবারে নতুন সদস্য হয়ে আসে একটি গরু। ফজলু, পুতুল আর তাদের গরুকে ঘিরে এগোতে থাকে সাঁতাওয়ের গল্প।
প্রকৃতি ও ঋতুচক্রের প্রভাব সঠিকভাবে তুলে ধরতে মোট ছয় লটে এর শুটিং হয় জানিয়ে সুমন বলেন, যে জমির ধান লাগানোর দৃশ্য ধারণ হয়েছে সেই জমিরই ধান কাটার সময় আবার শুটিং হয়েছে।
গণঅর্থায়নে সিনেমা বানানোর কারণ জানতে চাইলে খন্দকার সুমন বলেন, “আমরা শুরুতে সিনেমার গল্প নিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠানের কাছে গিয়েছি। বাণিজ্যিক উপাদান না থাকায় তারা এই সিনেমার পেছনে লগ্নী করতে আগ্রহ দেখাননি। পরে ১৫৫৯ জন মানুষের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করা হয়। ১০০ টাকা থেকে শুরু করে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত দিয়েছেন একেকজন। ৩৭৫ জন প্রকাশ্য অনুদানের মাধ্যমে এই সিনেমার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। বাকিরা নাম প্রকাশে অনিচ্ছার কথা জানিয়েছেন।”
সিনেমাটি নিয়ে প্রত্যাশার কথা জানিয়ে সুমন বলেন, “আমার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা। এর আগে আমার স্বল্পদৈর্ঘ্য পৌনঃপুনিক যারা দেখেছেন প্রশংসা করেছেন। আমি আশা করি গণমানুষের এই সিনেমাটা গণমানুষ দেখবেন।”
নেপাল আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক প্যানারোমা বিভাগে দুটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্বাচিত হয়েছে। এই তালিকায় নূর ইমরানের পাতাল ঘরের সঙ্গে আছে সাঁতাও।