লগ্নিকারীর অভাবে নাটকের শুটিং কম হওয়া, বিজ্ঞাপন কমে যাওয়াসহ নানামুখী সংকটে বছরটা ‘ভালো কাটেনি’ ছোট পর্দার মানুষদের।
Published : 29 Dec 2024, 03:28 PM
দেশের রাজনৈতিক পটপরির্তনের প্রেক্ষাপটে নাট্যাঙ্গনে শুটিং বন্ধ হয়ে যে স্থবিরতা তৈরি হয়েছিল বছরের সপ্তম ও অষ্টম মাসে, সেই ‘নাজুক’ দশা কাটেনি। মন্দা দশার রেশ থেকে গেছে শেষ প্রান্তে এসেও।
অভিনয়শিল্পী, পরিচালক ও প্রযোজকরা জানিয়েছেন, অর্থ লগ্নিকারীর অভাবে নাটকের শুটিং কম হওয়া, বিজ্ঞাপন কমে যাওয়াসহ নানামুখী সংকটে বছরটা ‘ভালো কাটেনি’ ছোট পর্দার মানুষদের।
ঈদের আগ পর্যন্ত ‘ভালো সময়’ পার করেছেন বলে ভাষ্য শিল্পী-নির্মাতা-প্রযোজকদের। কিন্তু জুলাই অগাস্টের পর থেকে ‘বিনিয়োগকারীর অভাবে’ নাটকের শুটিং অন্য সময়ের তুলনায় ‘৫০ শতাংশের চেয়েও কম হয়েছে’।
গত চারমাসে টেলিভিশনের কিছু ধারাবাহিকের শুটিং চললেও, কমেছে একক নাটকের শুটিং।
কাজ কমে যাওয়ায় অর্থ সংকট পাড়ি দিতে হচ্ছে প্রোডাকশনকর্মীদের।শুটিং না থাকায় জীবিকা নির্বাহের জন্য ‘অন্য পেশাও’ বেছে নিচ্ছেন অনেকে।
এসব নিয়ে নির্মাতা রাফাত মজুমদার রিংকুর সঙ্গে গ্লিটজের সঙ্গে কথা।
তিনি বলেন, "কোরবানির ঈদ পর্যন্ত ভালোই ছিল, ঈদের পর থেকে কাজ কম হচ্ছে। জুলাই- অগাস্টের আন্দোলন, সরকার পতনসহ সব মিলিয়ে প্রায় দেড় থেকে দুই মাস শুটিং একদম বন্ধ ছিল। কিছু টেলিভিশন ধারাবাহিকের শুটিং হয়েছে, তাছাড়া সব বন্ধ ছিল।
"ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় ইউটিউবে ওই সময় নতুন নাটক আপলোড করা যায়নি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে শুটিং চালু হলেও মার্কেটে ব্র্যান্ডিং আগের মত মিলছে না, স্পন্সর পাওয়া যাচ্ছে না। এখন যেসব নাটকের শুটিং হচ্ছে সেগুলো ভালোবাসা দিবস বা আগামী বছরের ঈদকে কেন্দ্র করে। রেগুলার নাটকের শুটিং কমে গেছে।"
নাটকের দুটি মাধ্যম টেলিভিশন ও ইউটিউব চ্যানেল। এর মধ্যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নাটকের ইউটিউব চ্যানেলগুলো। এগুলোর মধ্যে আছে সিএমভি, পিকক ফান, দুরবিন, জাগো এন্টারটেইনমেন্ট, সিনেমাওয়ালা।
সিনেমাওয়ালা ইউটিউব চ্যানেলের পরিচালক ও প্রযোজক মোস্তফা কামাল রাজ গ্লিটজকে বলেন, "সিনেমাওয়ালা চ্যানেলে এ বছর ২৭টি সিঙ্গেল নাটক এবং ২টি ধারাবাহিক নাটক গিয়েছে। বছরের শুরু থেকে নাটকের সাড়া অনেক ভালো পেয়েছি আমরা। অনেকগুলো নাটক হিট হয়েছিল এবং ঈদেও আমরা ভালো সাড়া পেয়েছিলাম। যেমন কোরবানির ঈদে 'চাঁদের হাট' নাটকটি এখন পর্যন্ত ২০ মিলিয়নেরও বেশি দর্শক দেখেছেন।
"তবে জুলাইয়ের অভ্যুত্থানের পর দেশের পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে এবং তা নাটকের উপর প্রভাব ফেলে। শুটিং বন্ধ ছিল, নাটক আপলোড করেও আগের মত দর্শক পাচ্ছি না। যার জন্য গত বছরের তুলনায় এই বছর নাটকের সংখ্যা কমে গিয়েছে।"
এই পরিস্থিতি নিয়ে একই কথা বলেছেন ডিরেক্টর গিল্ডের অন্তবর্তী সংস্কার কমিটির আহ্বায়ক ও পরিচালক সৈয়দ শাকিল।
নির্মাতাদের এই নেতার ভাষ্য, "নাটকের মার্কেটের সাইজ ছোট হয়েছে, কারণ বিনিয়োগকারী কমে গিয়েছে। একটা রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে প্রত্যক্ষ, পরোক্ষভাবে বিনিয়োগের উপর একটা প্রভাব পড়ে, সেটা অন্য সব সেক্টরের সঙ্গে নাটকের উপরও পড়েছে। দেশের পরিস্থিতি যেহেতু স্বাভাবিক হচ্ছে হয়ত নতুন বিনিয়োগকারী আসলে এটা ঠিক হয়ে যাবে।"
আয় কমে বেড়েছে খরচ
নাটক প্রযোজনা পেশার সঙ্গে ৩০ বছর ধরে যুক্ত আছেন প্রযোজক আলি বাসীর।
হঠাৎ করে বিনিয়োগকারী কমে যাওয়ার কারণ কী প্রশ্নে এই প্রযোজক বলেছেন বিজ্ঞাপন কমে যাওযার কথা।
তিনি বলেন, "কোরবানির পর এমনিতেই নাটকের মর্কেটটা একটু খারাপ থাকে। তবে এবার দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি থেকে শুরু করে সমস্ত লোকাল কোম্পানি বা বিজ্ঞাপনসংস্থাগুলো বিজ্ঞাপন কমিয়ে দিয়েছে।
"তারা ডিজিটাল ব্র্যান্ডিং, টিভি ব্র্যান্ডিং থেকে কিছুটা পিছনের দিকে চলে গেছে। সেজন্য নাটকের মার্কেট এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। কারণ আমাদের বিনিয়োগের বেশির ভাগ টাকা আসে ডিজিটাল মার্কেটিং থেকে। টিভি চ্যানেল থেকেও ডিজিটাল মার্কেটিংর মূল্যটা ৪ বা ৫ গুণ বেশি। ডিজিটাল ব্র্যান্ডিংটা যখন বন্ধ হয়ে গিয়েছে বলে অনেকেই নাটক প্রচার করা বন্ধ রেখেছেন।"
যে বাজেটে নাটক নির্মাণ হচ্ছে তার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সমান মূল্য পাওয়া যাচ্ছে, লাভের পরিমাণ কমে গেছে বলেও জানিয়েছেন প্রযোজক বাসীর।
“খরচ বেড়ে গেছে, কিন্তু সেই খরচ তোলার মত পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে না।“
তিনি বলেন, "যেসব শিল্পীদের দর্শকপ্রিয়তা আছে শুধু তাদেরই কাজ হচ্ছে, তারা কাজ করতে গিয়ে কিন্তু নিজেদের রেমুনারেশন কমাচ্ছে না৷ একজন ডিরেক্টরের কোনো টাকা কমেনি, প্রোডাকশনের টাকা কমেনি, শুটিং হাউসের ভাড়া কমেনি, প্রপসের (নাটকের সরঞ্জাম) টাকা কমেনি। ট্রান্সপোর্টের খরচ বেড়েছে, খাবার দাবারের দাম বেড়েছে। কিন্তু সেই তুলনায় নাটকের প্রযোজকের আয় কমে গেছে। আমরা নাটকের কোয়ালিটি ধরে রাখতে পারছি না। তাই বিনিয়োগ কমিয়ে দিয়েছি।"
নাটকের অবস্থা ‘তুলনামূলক খারাপ’ জানিয়ে টেলিভিশন প্রোগ্রাম প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টেলিপ্যাব) সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাজু মুনতাসীর বলেন, “গত চার মাসে শুটিং কমেছে ৩৫ শতাংশেরও কম।“
প্রযোজকদের এই নেতা বলেন, "বিগত সরকারের সময় অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা নাটকে বিনিয়োগ করতেন, কিন্তু সরকার পতনের পর সেটা কমে গিয়েছে। আর নাটকের ব্যবসা হয় ইউটিউবকেন্দ্রিক। কিন্তু রাজনৈতিক এবং দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির কারণে মানুষ মানসিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে একটা অস্থিরতার মধ্যে আছে।
“মানুষের নিউজ, টকশো, সাম্প্রতিক বিষয়গুলোর উপর আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। বিনোদনের প্রতি আগ্রহ কমে গেছে। যার কারণে নাটকের ভিউ কমে গিয়েছে।"
টেলিভিশন ও ইউটিউব নাটকের নিয়মিত দর্শকপ্রিয় মুখ হলেন অভিনেতা মোশাররফ করিম, জিয়াউল ফারুক অপূর্ব, মেহজাবীন চৌধুরী, তাসনিয়া ফারিণ, তৌসিফ মাহবুব, মুশফিক আর ফারহান, তানজিন তিশা, সাবিলা নূর, সাফা কবির, ফারহান আহমেদ জোভান, নাজিয়া হক অর্ষা, তানিয়া বৃষ্টি, মনোজ প্রামাণিক, সোহেল মন্ডল, নিলয় আলমগীর, জান্নাতুল ফেরদৌস হিমি, ইয়াশ রোহান, সাদিয়া আয়মান, তটিনীসহ একগুচ্ছ অভিনয়শিল্পী।
বছরজুড়ে নাটকের শিল্পীদের কী অবস্থা কেটেছে তা জানতে কথা হয় অভিনয় শিল্পী সংঘের সভাপতি আহসান হাবিব নাসিমের সঙ্গে।
তিনি বলেন, "এই বছরটায় ঈদের আগ পর্যন্ত একটা সুদিন ছিল, কিন্তু এরপরের চিত্রটা পাল্টে গিয়েছে। গত বছরের তুলনায় শুটিং কমেছে ৫০ শতাংশ। জুলাই, অগাস্ট, সেপ্টেম্বরে শুটিং একদমই বন্ধ ছিল। নভেম্বর, ডিসেম্বরে কিছুটা শুটিং হচ্ছে।
"তবে পুরো বছর জুড়ে আমাদের নাটকের যত শিল্পী আছে, অর্থাৎ এটাকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন, এই সমস্ত শিল্পী কলাকুশলীদের জন্য যতটুকু প্রোডাকশন দরকার, সেটা হয়নি। যে কারণে কেউ সাময়িকভাবে ভালো থেকেছে, আবার কেউ খারাপ। সব শিল্পী নিয়মিত অভিনয় করে যাবে সেই জায়গাটা আমাদের এখানে নেই। তাই সুদিন দুর্দিন মিলিয়েই কেটেছে বছর।"
জীবন-জীবিকা নিয়ে বেড়েছে অনিশ্চয়তা
শুটিংয়ের কাজে স্থবিরতা থাকায় সংগ্রাম করে জীবন পার করতে হচ্ছে ‘প্রোডাকশন বয়’দের।
‘বাংলাদেশ টেলিভিশন মিডিয়া প্রোডাকশন ম্যানেজার অ্যাসোসিয়েশন’র সভাপতি মো. আবু জাফর অপুর তথ্যমতে, সংগঠনটির ৭১৩ জন কর্মীর মধ্যে ৭০-৮০ জন নিয়মিত কাজ করছেন, বাকিদের বেশির ভাগই এখন বেকার। রোজগার এবং সংসার চালানোর জন্য তাদের ভিড়তে হচ্ছে অন্য পেশায়।
অপু বলেন, "শুটিং হলে আমাদের কাজ থাকে, না হলে বেকার থাকি। এই পেশায় থাকতে পারব কী না সেটা নিয়ে অনিশ্চয়তায় আছি আমরা। কেউ সবজি বিক্রি করছে, কেউ মোটরসাইকেল চালানোর কাজ করছে, কেউ গ্রামের বাড়িতে চলে গিয়েছে। অসহায়ত্বের সাথে আমরা জীবনযাপন করছি।
“এই পেশায় জীবন-জীবিকা অনিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে। বছরের শেষ শুটিং নেই, ছেলেমেয়েদের নতুন বছরের ভর্তি, আমাদের রোজগার বন্ধ। সব মিলিয়ে প্রোডাকশন কর্মীদের অবস্থা খারাপ।"
ভিন্ন চিত্র ওটিটিতে
২০১৩ সালে বাংলাদেশে সাবস্ক্রিপশনভিত্তিক ওটিটি হিসেবে প্রথম যাত্রা শুরু করে ‘বঙ্গ’। প্ল্যাটফর্মটি বিদেশি নানা কনটেন্টের পাশাপাশি দেশের নাটক, সিনেমা প্রচার করে।
পরে ২০১৬ সালে গ্রামীণফোন ‘বায়োস্কোপ’ নামে আরেকটি ওটিটি নিয়ে আসে। বাংলালিংক আজিয়াটার ব্যানারে আসে ‘আইফ্লিক্স’।
কোভিড মহামারীর সময়ে লকডাউনে ঘরবন্দি মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম। সেসময় গ্রাহকের সঙ্গে এসব প্ল্যাটফর্মে কনটেন্টেও বাড়ে।
দেশে ওটিটি প্ল্যাটফর্মের মধ্যে বর্তমানে সক্রিয় রয়েছে 'বঙ্গ', 'চরকি', 'আইস্ক্রিন', 'দীপ্ত প্লে', 'বিঞ্জ', 'বায়োস্কোপ', 'হইচই বাংলাদেশ'।
সারাবছর জুড়ে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে যেসব কনটেন্ট প্রচার হয়েছে সেগুলো থেকে ভালো সাড়া পেয়েছেন বলে জানিয়েছে প্ল্যাটফর্ম কর্তৃপক্ষ।
বিঞ্জের হেড অফ কনটেন্ট উম্মে খাইরুন ইসলাম গ্লিটজকে বলেন, "বছরের শুরুতে আমাদের বেশ কিছু কনটেন্ট মুক্তি পায় যেগুলো থেকে দারুণ সাড়া মিলেছে। এর মধ্যে 'আরারাত' অন্যতম। এরপর বছরের মাঝখানে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পরিষেবাও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কিছুটা লস হয়েছিল।
“তারপর আবার 'একটি খোলা জানালা', 'মায়া', 'ফ্রেঞ্জি', 'এপার ওপার' এসব কনটেন্ট ভালো যাচ্ছে। নতুন বছরটাও আমাদের বেশ কিছু ভালো ভালো কনটেন্ট আছে যেগুলো দর্শকের ফ্লো আবার বাড়িয়ে দিবে। সব মিলিয়ে খারাপ কাটেনি বছরটা।"
পরিস্থিতির ‘উন্নতি হয়েছে’ বলে জানিয়েছেন চরকির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রেদওয়ান রনি।
তিনি বলেন, "বছরের শুরুতে দর্শকের ভি টা ভালো ছিল, আমাদের 'কাছের মানুষ দূরে থুইয়া' একটা হিট কনটেন্ট ছিল। তারপর আন্দোলনের সময় একটা ধাক্কা ছিল। এরপর নতুন করে শুরু হয়েছে আমরা পরপর অনেকগুলো কনটেন্ট মুক্তি দিয়েছি। কিন্তু বছরের শুরুর সেই দর্শক টানতে হয়ত একটু সময় লাগছে।“
পরিস্থিতির উন্নতিতে সামনের বছর আরও ‘ভালো যাবে’ বলে প্রত্যাশা রেখেছেন রনি।