অন্তর্বতীকালীন সরকারের উপদেষ্টা আসিফ নজরুলও এসেছিলেন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে।
Published : 01 Nov 2024, 10:29 PM
হেমন্তের বিকেল গড়িয়ে যখন সন্ধ্যা নামল, তখন ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চের সামনের গ্যালারিতে তিল ধারণের ঠাঁই নেই; হাজারো মানুষ ভিড় জমিয়েছেন যাত্রাপালার আসরে।
অন্তর্বতীকালীন সরকারের উপদেষ্টা আসিফ নজরুলও এসেছিলেন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। নিরাপত্তাসঙ্গীদের দূরে রেখেই দর্শক সারিতে বসে উপভোগ করেছেন প্রথম দিনের পরিবেশনা ‘নিহত গোলাপ’।
‘যদি তুমি ভয় পাও, তবে তুমি শেষ। যদি তুমি রুখে দাঁড়াও তবে তুমি বাংলাদেশ’ প্রতিপাদ্যে শুক্রবার শুরু হয়েছে সপ্তাহব্যাপি এ ‘যাত্রা উৎসব’। অনেকেই যাত্রা দেখতে এসেছেন জীবনে প্রথমবার।
গ্রামীণ সংস্কৃতির উৎসব-পার্বণের সঙ্গে গণমানুষের সংস্কৃতি হিসেবে জড়িয়ে থাকা ঐতিহ্যবাহী যাত্রাপালার এই আয়োজন সাজিয়েছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। ব্যবস্থাপনায় রয়েছে একাডেমির নাট্যকলা ও চলচ্চিত্র বিভাগ।
শিল্পকলা একাডেমির জনসংযোগ বিভাগ জানিয়েছে, উৎসবে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে নিবন্ধিত সাতটি যাত্রাদল প্রতিদিন একটি করে যাত্রাপালা পরিবেশন করছে, যেগুলো ‘ঐতিহাসিক ও সামাজিক’ ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত।
প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত উৎসব সবার জন্য উন্মুক্ত।
পূর্বনির্ধারিত সময় অনুযায়ী শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টায় শুরু হয় যাত্রা উৎসবের উদ্বোধনী পর্ব। স্বাগত বক্তব্যে একাডেমির নাট্যকলা ও চলচ্চিত্র বিভাগের পরিচালক ফয়েজ জহির বলেন, “সকলের সহযোগিতায় এই উৎসব আমরা সারাদেশে যেন ছড়িয়ে দিতে পারি। যাত্রাশিল্পসহ শিল্পকলার সকল মাধ্যমকে প্রবাহিতভাবে বেগবান করার সময় এসেছে।”
প্রধান অতিথির বক্তব্যে জুলাই গণঅভ্যত্থানে অংশগ্রহণকারী ইসরাফিল মজুমদার বলেন, “বাংলাদেশের সরকার পরিচালনায় যে দলই ক্ষমতায় আসুক, তারা যেন দেশেকে ভালোবাসে এটাই চাওয়া। আর আগে গ্রামে গ্রামে যাত্রাপালা হইত, সেই যাত্রাপালাও যেন হয়।”
বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন যাত্রাশিল্পী অনিমা দে এবং যাত্রাশিল্পী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এম এ মান্নান।
সভাপতির বক্তব্যে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক সৈয়দ জামিল আহমেদ বলেন, “বিদ্যুত চমকের মত দ্রুতবেগে ঘটে যাওয়া এক নির্ভয় অভ্যুত্থানের অগ্নিগর্ভ ছিঁড়ে জন্ম নিয়েছে নতুন এই বাংলাদেশ।”
সংস্কৃতি খাতে বাজেট বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে মহাপরিচালক বলেন, “জাতীয় বাজেট যেখানে প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকা, সেখানে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ কেবল ৭৭৮ কোটি টাকা। সংস্কৃতি খাতে বরাদ্দ বাড়ানো সময়ের দাবি।”
বিপ্লব-উত্তর সময়ে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রাণচাঞ্চল্যতা ফিরিয়ে আনতে এই যাত্রা উৎসব আয়োজন করা হয়েছে মন্তব্য করে সৈয়দ জামিল আহমেদ বলেন, “শিল্পচর্চা জনজীবনের কেন্দ্রে অবস্থিত। শিল্পচর্চার অন্যতম মাধ্যম হিসেবে এবং গ্রামীণ জনসাধারণের বিনোদনের ঐতিহ্য বিবেচনায় আমরা এই যাত্রাপালার আয়োজন করেছি। আমরা চাই, আপনারা সবাই যাত্রা শিল্পীদের পাশে থাকুন।”
উদ্বোধনী আলোচনার পর শুরু হয় প্রথম দিনের যাত্রাপালা ‘নিহত গোলাপ’। সুরুভী অপেরা’র এই পরিবেশনাটির নির্দেশনা দিয়েছেন কবির খান এবং পালাকার ছিলেন আগন্তক।
মাধবপুর জমিদারের চক্রান্তের এক বাস্তব কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে এ যাত্রাপালায়। যেখানে দেখা যায়, চক্রান্তের বলি হয়েছিল রাধারানী কলেজের মেধাবী ছাত্র গোকুল। জমিদারের আত্মীয়কে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করানোর কারণে গোকুলের জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। গোকুলকে কলেজ থেকে বের করে দেয়া হয় ‘নিচু জাতের’ ছেলে বলে। পরবর্তীতে সে সমাজবিরোধী কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে।
অন্যদিকে ভাগ্যের ফেরে তার প্রেমিকা যৌন পল্লিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। কোনো একদিন গোকুল ছিনতায়ের অপরাধে ওই পল্লীতে আশ্রয় নেয়। অবশেষে একদিন সে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে। বিচারে তার সাজা হয়।
ছুটির দিনগুলোতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, টিএসসি এলাকায় অনেকেই আসেন ঘুরে বেড়াতে। তবে এই শুক্রবার সন্ধ্যায় ঘুরে বেড়ানোর ফাঁকেই যাত্রাপালা দেখার অভিজ্ঞতাও হল অনেকের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সামিয়া আনজুম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগে কখনো যাত্রাপালা দেখা হয়নি। ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি যাত্রাপালা অশ্লীল, কিন্তু এখানে দেখে ভালো লাগছে।”
সামিয়ার আরেক বন্ধু রফিক বলেন, “সাউন্ডের একটু সমস্যা ছিল। এমনিতে ভালো লাগছে। গ্রামে গ্রামে যাত্রাপালা ছড়িয়ে দেওয়া উচিত।”
একাডেমির জনসংযোগ বিভাগ জানিয়েছে, এই উৎসবে শনিবার সন্ধ্যায় নিউ শামীম নাট্য সংস্থা পরিবেশন করবে 'আনার কলি'। রোববার থাকবে বঙ্গবাণী অপেরা’র 'মেঘে ঢাকা তারা'।
এছাড়া সোমবার নর-নারায়ণ অপেরা’র 'লালন ফকির, মঙ্গলবার বন্ধু অপেরা’র 'আপন দুলাল', বুধবার শারমিন অপেরা’র 'ফুলন দেবী' এবং বৃহস্পতিবার সমাপনী সন্ধ্যায় যাত্রাবন্ধু অপেরা পরিবেশন করবে 'নবাব সিরাজউদ্দৌলা'।