১৯৭৬ সালে ১৩৪ মিনিট দৈর্ঘ্যের এই সিনেমাটির গল্প আবর্তিত হয়েছে দুগ্ধ সমবায় আন্দোলনের সূচনাকে কেন্দ্র করে।
Published : 19 May 2024, 01:28 PM
সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা, ভারতীয় পরিচালক শ্যাম বেনেগাল একটি সিনেমা বানাবেন, কিন্তু পর্যাপ্ত টাকার যোগান নেই। নির্মাতা সিদ্ধান্ত নিলেন গণঅর্থায়নে পর্দায় গল্প বুনবেন তিনি। এই খবরে এগিয়ে আসলেন গুজরাট রাজ্যের পাঁচ লাখ দুগ্ধ খামারি, তারা প্রত্যেকে দুই রুপি করে চাঁদা দিলেন। তৈরি হল ‘মন্থন’ নামের একটি সিনেমা।
১৯৭৬ সালে ১৩৪ মিনিট দৈর্ঘ্যের এই সিনেমাটির গল্প আবর্তিত হয়েছে দুগ্ধ সমবায় আন্দোলনের সূচনাকে কেন্দ্র করে। নির্মাণের প্রায় ৫০ বছর পর কান চলচ্চিত্র উৎসবে ধ্রুপদি চলচ্চিত্রের বিভাগ 'কান ক্লাসিক' এ শুক্রবার সিনেমাটির প্রদর্শনী হয়।
গত দুই দশক ধরে কানের এই বিভাগে কালজয়ী সিনেমাগুলোর পুনরুদ্ধার করা প্রিন্ট ও কিংবদন্তিদের নিয়ে নির্মিত প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী হয়।
পরিচালকের পাশাপাশি প্রদর্শনীতে উপস্থিত ছিলেন চলচ্চিত্রটির অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহ, অভিনেত্রী স্মিতা পাতিলের পরিবার, ভার্গিস কুরিয়েনের কন্যা, প্রযোজক এবং ভারতের ফিল্ম হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের পরিচালক শিবেন্দ্র সিং দুঙ্গারপুর।
সিনেমা প্রদর্শনীর পর উপস্থিত দর্শকরা উঠে দাঁড়িয়ে অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহকে সম্মান জানান।
বিবিসি লিখেছে, ‘মন্থন’ ভারতের গণঅর্থায়নে নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র। এই সিনেমায় দুগ্ধ সমবায় আন্দোলন তুলে ধরেছিলেন শ্যাম বেনেগাল। আর সিনেমার গল্প থেকে পাওয়া বার্তা নিয়ে দুধের ঘাটতিতে থাকা ভারত শীর্ষস্থানীয় দুধ উৎপাদনকারী দেশে পরিণত হয়।
এই সিনেমার অনুপ্রেরণা নেওয়া হয়েছে ভারতের ভার্গিস কুরিয়েনের জীবন থেকে। দুগ্ধ বিপ্লবকারী এই মানুষটিকে বলা হয় ‘মিল্কম্যান অব ইন্ডিয়া’। তিননি গুজরাটের গোয়ালা সম্প্রদায়ের মানুষদের ঐক্যবদ্ধ করার মত কঠিন একটি কাজ করেছিলেন একা হাতে। ওই গোয়ালাদের মিলিত প্রচেষ্টাতেই গড়ে ওঠে দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র।
কান চলচ্চিত্র উৎসবে জাঁ-লুক গদার, আকিরা কুরোসাওয়া ও উইম ওয়েন্ডারসের ক্লাসিক চলচ্চিত্রের সঙ্গে ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ারের জন্য ‘মন্থন’ সিনেমাটির মূল প্রিন্ট ‘রিস্টোর’ করা হয়। উৎসবে ‘মন্থন’র নতুন প্রিন্ট দেখানো হয়।
তবে প্রিন্ট মেরামতের কাজটি সহজ হয়নি। কারণ ‘মন্থন’র দুটি প্রিন্ট পাওয়া যায়, দুটোই ছিল বিবর্ণ। আর পাওয়া যায় একটি নেগেটিভ। ছত্রাক পড়ে ওই নেগেটিভ অনেকখানিও নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। নষ্ট হয়ে গিয়েছিল সাউন্ড নেগেটিভও।
ওই নেগেটিভ এবং বিবর্ণ হয়ে যাওয়া প্রিন্ট নিয়ে ‘মন্থন’ পুনরুদ্ধারের কাজটি করেছে 'ফিল্ম হেরিটেজ ফাউন্ডেশন'। প্রিন্ট থেকে সাউন্ড নিয়ে সেটি ডিজিটাইজ করে ফিল্মটি সংস্কার করা হয়। স্ক্যানিং ও ডিজিটাল ক্লিন-আপ করা হয় চেন্নাইয়ের একটি ল্যাবে, ইতালির বোলোনিয়াভিত্তিক বিখ্যাত এক ফিল্ম রিস্টোরেশন ল্যাবের তত্ত্বাবধানে। আর পুরো কাজের তত্ত্বাবধানে ছিলেন শ্যাম বেনেগাল নিজে এবং তার দীর্ঘ সময়ের সিনেমাটোগ্রাফার গোবিন্দ নিহালানি।
প্রায় ১৭ মাস ধরে কাজের পর পুনর্জন্ম হয় ‘মন্থন’ এর।
সিনেমার পরিচালক শ্যাম বেনেগাল বলেছেন, ‘মন্থন’ তার মনের মত কাজগুলোর একটি।
৮৯ বছর বয়সী এই সিনেমা নির্মাতা বলেন, “প্রিন্ট রিস্টোর করার পর চোখের সামনে চলচ্চিত্রটিকে জীবন্ত হয়ে উঠতে দেখলাম, যেন গতকালই বানানো হয়েছে। এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা বলতে পারেন।”
অতীত স্মৃতি হাতড়ে বেনেগাল জানিয়েছেন, তিনি কুরিয়েনের কাজে দারুণ অনুপ্রাণিত হয়ে ‘অপারেশন ফ্লাড’সহ (ভারতের দুগ্ধ বিপ্লব) এবং গ্রামীণ বিপণন উদ্যোগের ওপর বেশ কয়েকটি তথ্যচিত্র বানিয়েছিলেন।
কিন্তু কেবল তথ্যচিত্র বানিয়ে মনের আশ মেটেনি তখন তার। চাইছিলেন কুরিয়েনের কাজের ধারণা বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে।
“তখন আমি কুরিয়েনকে একটি পূর্ণাঙ্গ ফিচার ফিল্ম নির্মাণের প্রস্তাব দেই। তিনিও রাজি হয়ে যান। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় টাকা। এত টাকা কোথায় পাব! অর্থাভাবের কথাও কুরিয়েনকে জানাই। কুরিয়েনের মাথায় দারুণ একটা আইডিয়া খেলে যায়। তিনি গুজরাটের সংগ্রহকেন্দ্রের কৃষকদের কথা আমাকে জানান।”
সমবায় সমিতির আওতায় গুজরাটের ক্ষুদ্র দুগ্ধ খামারিরা সেখাকার একটি সংগ্রহকেন্দ্রে সকাল-সন্ধ্যায় দুধ বিক্রি করতেন। মাখন এবং অন্যান্য দুগ্ধজাত পণ্য তৈরির জন্য ওই দুধ সংগ্রহকেন্দ্র থেকে পাঠানো হত ডেইরি ফার্মে।
বেনেগাল বলেন, “একদিন বিকেলে বৈঠক করে দুগ্ধ খামারিদের কুরিয়েন জানালেন, খামারিরা যদি ৮ রুপির পরিবর্তে ৬ রুপিতে দুধ বিক্রি করতে রাজি থাকেন, তা হলে সেখান থেকে সিনেমার খরচ উঠে আসতে পারে। এতে খামারিরাই হয়ে যাবেন সিনেমার প্রযোজক। খামারিরাও কুরিয়েনের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান এবং তাদের আমার সিনেমার গল্পটা শোনাই। বলা যায় রাতারাতি পাঁচ লাখ দুগ্ধ খামারির সহযোগিতায় উঠে আসে ১০ লাখ রুপি।”
এত বছর পরও সিনেমাটি প্রাসঙ্গিকতা জানিয়ে বেনেগাল বলেন, “হিন্দি ভাষায় নির্মিত ২ ঘণ্টা ১৪ মিনিটের ‘মন্থন’ দেখিয়েছে চলচ্চিত্র সমাজে কতটা পরিবর্তন আনতে পারে। কারণ এতে এমন সব বিষয়, সমস্যা বা সীমাবদ্ধতা উঠে এসেছে যা বর্তমান ভারতেরও সঙ্গী।”
বেনেগালের কথায় জানা গেল, ‘মন্থন’র সাফল্যে কুরিয়েনের কাজেরও বিস্তৃতি ঘটেছিল। দুগ্ধ বিপ্লব ছড়িয়ে তিনি গ্রামে গ্রামে প্রেক্ষাগৃহে এই সিনেমার প্রিন্ট বিলি করেছিলেন। কৃষকদেরকে নিজস্ব সমবায় প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছিলেন। সিনেমার মত বাস্তবেও তিনি খামারিদের কাছে পশুচিকিৎসক, একজন দুগ্ধ প্রযুক্তিবিদ ও পশুখাদ্য বিশেষজ্ঞের একটি দল পাঠিয়েছিলেন।
‘মন্থন’ সিনেমায় অভিনয় করেন গিরিশ কারর্নাড, স্মিতা পাতিল, নাসিরুদ্দিন শাহ, অমরিশ পুরি, কুলভূষণ খারবান্দা ও মোহন আগাশে। নাট্যকার বিজয় টেন্ডুলকার কয়েকটি চিত্রনাট্য তৈরি করেছিলেন। এর মধ্য থেকে একটি চিত্রনাট্য বেছে নেন বেনেগাল। সিনেমার সংগীত পরিচালনা করেন প্রখ্যাত সুরকার বনরাজ ভাটিয়া।
চিত্রনাট্যে দেখানো হয়েছে, শহর থেকে একজন সরকারি পশুচিকিৎসক ও তার দল দুগ্ধ সমবায় শুরু করার পরিকল্পনা নিয়ে গুজরাটের এক গ্রামে আসেন। কিন্তু গ্রামবাসীরা তাদের উদ্দেশ্যকে ভালোভাবে নিতে পারেনা।
ওই চিকিৎসক এবং তার দল কাজ শুরু করার পর গ্রামের রাজনীতির মারপ্যাঁচে পড়ে যান। সেই সঙ্গে গ্রামের একটি ডেইরি ফার্মের মালিক, গ্রামপ্রধান ও স্থানীয় এক দুধওয়ালার তাদেরকে পদে পদে কাজে বাধা দেয়।
বক্স অফিসে খুব একটা সুবিধা করতে না পারলেও ১৯৭৭ সালে ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র এবং সেরা চিত্রনাট্যকারের পুরস্কার জিতে নেয় ‘মন্থন’।
ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই নিজে সোভিয়েত ইউনিয়নে সিনেমাটির প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেছিলেন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদেও সিনেমাটি দেখানো হয়েছিল মুক্তির বছরে।