হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় রিয়েলিটি শো ‘বিগ বস’র শুটিংয়ের কাজও সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নায়ক।
Published : 13 Oct 2024, 03:25 PM
মহারাষ্ট্রের সাবেক মন্ত্রী বাবা সিদ্দিকী হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নেতার ঘনিষ্ঠজন বলিউডি নায়ক সালমান খান নিরাপত্তা ‘আতঙ্কে ভুগছেন’ বলে খবর এসেছে।
আনন্দবাজার লিখেছে, এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় রিয়েলিটি শো ‘বিগ বস’র শুটিংয়ের কাজও সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নায়ক।
কারণ বাবা সিদ্দিকী হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেপ্তার দুজন নিজেদেরকে যে সন্ত্রাসী গ্যাংয়ের সদস্য বলে দাবি করছে, সেই লরেন্স বিষ্ণোই দলের নিশানায় সালমান রয়েছেন।
বিষ্ণোই সালমানকে বছরের পর বছর ধরে কেবল লাগাতার খুনের হুমকি দিয়েই চুপ থাকেনি, নায়কের বাড়ির সামনেও কয়েক মাস আগে গুলি ছুড়ে পালিয়েছে তার দলের লোকেরা।
ভাইজানের ‘নীরাপত্তাহীনতা পরিস্থিতির’ খবর দিয়ে আনন্দবাজার লিখেছে, এই পরিস্থিতিতে সালমানের পরিবার অস্বস্তিতে পড়েছে।
গুলিবিদ্ধ নেতাকে লীলাবতী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে শনিবার সেখানে পৌঁছে যান সালমান।
বলিউডি তারকাদের সঙ্গে বাবা সিদ্দিকীর যোগাযোগ ছিল নিবিঢ়। রোজার মাসে তার দেওয়া ইফতার পার্টি পরিণত হয়েছে বলিউড তারকাদের মিলনমেলায়।
একটা সময়ে বিশেষ কারণে সালমান ও শাহরুখ খান একে অপরে এড়িয়ে চলতে শুরু করেছিলেন, পরে ২০১৩ সালে এই নেতার আয়োজন করা ইফতার পার্টিতেই ‘মানভঞ্জন’ হয় দুই খানের।
সালমান-শাহরুকে দু’পাশে নিয়ে তোলা বাবা সিদ্দিকীর সেই ছবি স্মরণীয় হয়ে আছে বলে মনে করেন অনেকেই।
মুম্বাইয়ের শহরতলি বান্দ্রায় শনিবার দশেরার বাজি ফোটানোর সময় তিনবারের বিধায়ক বাবা সিদ্দিকীকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
প্রাথমিক তদন্তের পর পুলিশ বলছে, ভাড়াটে খুনি দিয়ে বাবা সিদ্দিকীকে হত্যা করা হয়েছে, ঘটনা তদন্তে তারা চারটি বিশেষ দল গঠন করেছে।
বাবা সিদ্দিকী হত্যা মামলা দুই দৃষ্টিকোণ থেকে তদন্ত করার কথা জানিয়েছে পুলিশ। একটি বিষ্ণোই গ্যাংয়ের সংশ্লিষ্টতা, অন্যটি বস্তি পুনর্বাসন মামলা সম্পর্কিত।
বলিউড তারকা সালমান খানের সঙ্গে বাবা সিদ্দিকীর ঘনিষ্ঠতার কারণে বিষ্ণোই গ্যাংয়ের সম্পৃক্ততা নিয়ে সন্দেহ করা হচ্ছে।
কয়েক ডজন মামলা মাথায় নিয়ে লরেন্স বিষ্ণোই বর্তমানে গুজরাটের একটি কারাগারে বন্দি আছেন, তবে তার চক্র মুক্তিপণের জন্য ব্যবসায়ীদের ফোন কল দিয়ে সংবাদের শিরোনাম হয়েছে।
সালমানের সঙ্গে বিষ্ণোইয়ে বিরোধ যেখানে
১৯৯৮ সালে কৃষ্ণসার হরিণ শিকারে সালমানের নাম জড়িয়েছিল। এর ‘বদলা নিতে’ ২০১১ সালে ‘রেডি’ সিনেমার শুটিংয়ের মাঝে সালমান খানকে হত্যার হুমকি দিয়ে আলোচনায় এসেছিলেন লরেন্স বিষ্ণোই।
কারণ বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের মানুষ কৃষ্ণসার বা চিংকার হরিণকে পবিত্র বলে মনে করে, বলতে গেলে তারা পূজা করে।
এরপর ২০১৮ সালে সালমানকে হত্যার জন্য বিষ্ণোই তার সহযোগী সম্পত নেহরাকে দায়িত্ব দেন। কিন্তু সে সময় অস্ত্রের জটিলতায় পরিকল্পনা মাফিক কাজ সারতে পারেনি খুনিরা।
ওই ঘটনার পর ২০২২ সালে সকালে হাঁটতে বেরিয়ে হুমকি চিঠি আসে সালমন খানের হাতে। ওই চিঠিতে সালমানের বাবা সেলিম খানকে মেরে ফেলার হুমকি ছিল।
এরপর গত বছরের মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে পুরনো ‘শত্রু’ কানাডাভিত্তিক এক গ্যাংস্টার গোল্ডি ব্রারের কাছ থেকে ই-মেইলে খুনের ‘হুমকি’ আসে সালমানের কাছে।
মোহিত মার্গ নামের এক ব্যক্তির মেইলে লিখেছিলেন, “গোল্ডি ভাই (গোল্ডি ব্রার) আপনার (সালামন) সঙ্গে কথা বলতে চান। এজন্য একটি সময় নির্ধারণ করতে হবে। সামনাসামনি গোল্ডি ভাই কথা বলবেন। হিসাব মেটাতে হবে।“
ওই চিঠিতে বিষ্ণোইয়ের সাক্ষাৎকারটি দেখার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে। তার দুদিন আগে কারাগারে বসে সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে গ্যাংস্টার লরেন্স বিষ্ণোই ফের বলেছিলেন, ক্ষমা না চাইলে সালমান খানকে হত্যার চিন্তাভাবনা থেকে তিনি সরছেন না।
২০২১ সালে থেকে তিহার জেলে বন্দি থাকা বিষ্ণোই সে সময় পুলিশের কাছে সালমানকে হত্যার হুমকির অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন।
এরপর গত বছরে শেষ নাগাদ সালমানকে হত্যায় বিষ্ণোইয়ের ছক বেরিয়ে আসে দিল্লি ও পাঞ্জাব পুলিশের তদন্তে।
সে সময় ভারতের জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ) জানিয়েছিল, জেলবন্দি বিষ্ণোই যে ১০ জনকে ‘খতমের তালিকা’য় রেখেছে, তাদের মধ্যে প্রথমেই রয়েছে সালমনের নাম।
সে সময় পুলিশ জানিয়েছিল, বিষ্ণোইয়ের লোকজন সালমানকে পানভেলে তার খামারবাড়িতে হত্যার পরিকল্পনা এঁটেছিল। সেইমত তারা খামারবাড়িতে নিয়মিত নজরদারি চালাচ্ছিল। কিন্তু পাঞ্জাবি গায়ক সিধু মুসেওয়ালা হত্যায় অন্যতম সন্দেহভাজন কপিল পণ্ডিতকে গ্রেপ্তারের পর তাকে জেরা করে পুলিশ ওই পরিকল্পনা জেনে যায়।
বিষ্ণোইয়ের শাগরেদরা সালমানের বাড়ির ওপর নজরও রাখছিল।
এরপর সালমানের নিরাপত্তা বাড়নো হয়। তা ছাড়াও এই বলিউড তারকাকে ব্যক্তিগত আগ্নেয়াস্ত্র রাখার অনুমতি দেওয়া হয়। কিছু দিন আগেই সালমনা একটি বুলেট প্রতিরোধী গাড়ি কিনেছিলেন।
এরপর চলতি বছরে এপ্রিলের মাঝামাঝি ভোর হতে না হতে সালমান খানের বাড়ি সামনে এক পশলা গুলি চালিয়ে বাইকে করে পালিয়ে যায় দুই ব্যক্তি।
এরপর পুলিশ ভিকি কুমার গুপ্ত, সাগর শিরিযোগেন্দ্র কুমার পাল নামে দুই তরুণকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ জানায়, গুলি ছোড়ার আগে মহারাষ্ট্রের রায়গড় জেলার একটি জায়গা থেকে দুটি বাইক ভাড়া নেন। এরপর সালমানের খামারবাড়ি পানভেল এলাকার ভাড়াবাড়িতে বাইক দুটো এনে রাখেন তারা। ঘটনার দিন ১৪ এপ্রিল ভোরে ওই বাইকে করেই সালমানের গ্যালাক্সি অ্যাপার্টমেন্টের সামনে এসে চার রাউন্ড গুলি ছুড়ে পালিয়ে যান।
এই ঘটনার পাশাপাশি গুলি চালানোর দায় স্বীকার করে নতুন আরেকটি হুমকিও আসে গ্যাংস্টার লরেন্স বিষ্ণোইয়ের কাছ থেকে।
এই গ্যাংস্টারের ভাষ্য, “এরপর গুলি আর বাড়ির সামনে হবে না। এবং সালমান নিজেকে বাঁচাতে আর কোনো সুযোগও পাবেন না।”
গুলির কয়েক ঘণ্টা পর সোশাল মিডিয়ায় লরেন্স বিষ্ণোইয়ের ভাই আনমোল বিষ্ণোই একটি চিঠিও পোস্ট করেন। হুমকির ওই চিঠির নিচে লরেন্স বিষ্ণোই, গোল্ডি ব্রার, রোহিত গোদারা এবং কালা জটরি-এই চারজনের নাম দেওয়া আছে।
হিন্দিতে লেখা চিঠির বাংলা করলে দাঁড়ায়, “আমদের উপর হওয়া অত্যাচারের নিষ্পত্তি চাই। যদি তুমি সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে নামতে চাও, তাই হবে। আজ যা হয়েছে, তা শুধুই একটা ঝলক ছিল সালমান খান। যাতে তুমি বুঝতে পার, আমরা কত দূর যেতে পারি। এটাই ছিল তোমাকে দেওয়া শেষ সুযোগ।
“এরপর গুলিটা তোমার বাড়ির বাইরে চলবে না… দাউদ ও ছোটা শাকিল নামের যে দুজনকে তুমি ভগবান মানো, সেই নামের দুটি কুকুর পুষেছি বাড়িতে। বাকি বেশি কথা বলার লোক আমি নই। জয় শ্রী রাম।’’
এরপর পুলিশ তিনজনকেকে গ্রেপ্তার করে এই মামলায় আদালতে অভিযোগ পত্র দেয়।
গুলির ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া পাঁচ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর নির্দেশ দেয় আদালত। তারা হলেন- ভিকি কুমার গুপ্ত, সাগর শিরিযোগেন্দ্র কুমার পাল, সনু কুমার বিষ্ণোই, অনুজ কুমার থাপন, মহম্মদ রফিক চৌধুরী ও হরপাল সিং।
এর মধ্যে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ হেফাজতে আত্মহত্যা করেন অনুজ কুমার।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, সালমানের বাড়িতে গুলির আগে আনমোল বিষ্ণোইয়ের সঙ্গে ওই বাইকে থাকা ভিকি সাহেব গুপ্ত এবং সাগর শিরিযোগেন্দ্র পালের কথোপকথের অডিও ক্লিপ পুলিশের হাতে এসেছে।
ওই কথাবার্তায় জানা গেছে, ভিকি এবং সাগরকে আনমোলই সালমানের বাড়ি লক্ষ্য করে গুলি চালানোর নির্দেশ দেন।
ওই দুইজনের প্রতি আনমোলের নির্দেশ ছিল তারা যেন ওই ঘটনার সময় সিগারেট খেতে থাকেন একং তাদের মাথায় যেন হেলমেট না থাকে। এর কারণ হিসেবে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার ভিডিওতে ভিকি এবং সাগরকে যাতে যথেষ্ঠ বেপরোয়া হিসেবে চোখে পরে সেটাই আনমোল চেয়েছিলেন।
পুলিশের দেওয়া অভিযোগপত্রে আরো বলা হয়েছে, গুলি করার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত ভিকি এবং সাগরের সঙ্গে আনমোল সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখেছেন। এছাড়া কারাগারে থাকে এবং এই ঘটনার মূল হোতা আনমোলের ভাই গ্যাংস্টার লরেন্স বিষ্ণোইও ভিকি এবং সাগরের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলেছেন।
আনমোল ওই দিন ভিকি এবং সাগরকে বলেছিলেন, যদি তারা তাদের কাজে সফল হয় তাহলে ‘ইতিহাস তৈরি হবে’ এবং সংবাদমাধ্যমে তাদের নাম ছড়িয়ে পড়বে। পুলিশের ধারণা আনমোল কানাডায় আত্মগোপনে আছেন।
আরও পড়ুন:
মুম্বাইয়ের তিনবারের এমএলএ বাবা সিদ্দিকী খুনে বিষ্ণোই গ্যাং?
সালমানকে 'হত্যাচেষ্টা': অভিনেতার জবানবন্দি ও অভিযোগপত্রে যা আছে
এবার হুমকি নয়, সালমানের বাড়ির সামনে গুলি