কফিনবন্দি হয়ে প্রয়াত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী এবং ছায়ানটের প্রাক্তন সদস্য পাপিয়া যখন এলেন, উপস্থিত সহশিল্পীদের অনেকেই চোখের জল আর ধরে রাখতে পারেননি।
Published : 13 Dec 2024, 01:31 PM
সকাল থেকে ধানমন্ডির ছায়ানট ভবনের বিশাল দরজা হাট করে খোলা ছিল। অন্যদিনের মত শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মীরা যাওয়া আসা করছিলেন ঠিকই, তবে পুরনো দিনের শিক্ষক শিল্পীসহ সবার মধ্যে ছিল অপেক্ষা, কখন আনা হবে পাপিয়া সারোয়ারের মরদেহ।
শুক্রবার কফিনবন্দি হয়ে প্রয়াত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী এবং ছায়ানটের প্রাক্তন সদস্য পাপিয়া যখন এলেন, উপস্থিত সহশিল্পীদের অনেকেই চোখের জল আর ধরে রাখতে পারেননি।
তারা ফুল দিয়ে তারা শ্রদ্ধা জানিয়েছেন পাপিয়া সারোয়ারকে। ছায়ানটের পর ফুলেল শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় একুশে পদকজয়ী এই সংগীতশিল্পীকে চিরবিদায় জানানো হয়েছে শহীদ মিনার প্রাঙ্গনেও।
দীর্ঘদিন ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে পাপিয়া অনন্তলোকে পাড়ি দেন বৃহস্পতিবার। তার বয়স হয়েছিল ৭১ বছর।
ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার পর ২০২১ সাল থেকে তিনি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। সম্প্রতি অবস্থার অবনতি হলে ঢাকার ইমপালস হাসপাতালে তাকে ‘লাইফ সাপোর্ট' দেওয়া হয়। বুধবার রাতে খবর আসে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে পৌঁছে গেছেন শিল্পী। সেখান থেকে তাকে আর ফেরানো যায়নি।
সকাল ৯টায় ছায়ানট ভবনে পাপিয়ার মরদেহ আনা হলে রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের সহসভাপতি মফিদুল হক, ছায়ানটের সহসভাপতি খাইরুল আনাম শাকিল, সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমদ লিসাসহ অনেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
এ সময় সাংগঠনিকভাবে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ, ছায়ানট ও উত্তরায়ণ।
ছায়ানটের উপদেষ্টা মফিদুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টফোর ডটকমকে বলেন, “শিল্পী হিসেবে পাপিয়া সারোয়ারের গানের চর্চা ও জাগরণ, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সঙ্গে যুক্ত। অল্প বয়স থেকেই গানের চর্চাটা শুরু করেছিলেন।”
স্বাধীন বাংলাদেশে রবীন্দ্রসংগীত চর্চার নতুন পথরেখা তৈরিতে যারা অবদান রেখেছেন, পাপিয়া সারোয়ার তাদের ‘অন্যতম’ বলেও ভাষ্য মফিদুল হকের।
“স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে রবীন্দ্রসংগীত চর্চার পথিকৃৎ তিনি।”
প্রয়াত শিল্পী সাদি মহম্মদ এবং এখন পাপিয়ার মৃত্যুর কথা তুলে আক্ষেপ করেন মফিদুল হক।
তিনি বলেন, “স্বাধীনতার পর পর তারা প্রথম বাংলাদেশ থেকে সংগীত নিয়ে শান্তি নিকেতনে পড়তে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে বাংলাদেশের রবীন্দ্রসংগীত চর্চার বিকাশ এবং প্রশিক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।”
পাপিয়া সারোয়ার জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের সাধারণ সম্পাদকেরও দায়িত্ব পালন করেছেন বলেও জানিয়েছিলেন মফিদুল হক।
তিনি বলেছেন, পাপিয়া সাংগঠনিকভাবেও রবীন্দ্রচর্চার বিকাশে ‘ভূমিকা রেখেছেন’।
“তার কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত তো অনেকেরই হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। রবীন্দ্রসংগীতের চর্চায় এদেশে এক অন্য মাত্রা যুক্ত করতে পেরেছেন তিনি। আর মানুষ হিসেবেও খুবই নরম স্বভাবের ছিলেন, বিনয়ী ছিলেন।"
ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমদ লিসা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এরকম রুচিশীল, নিরহংকারী মানুষ তো বিরল। সারাটা জীবন তিনি রবীন্দ্রনাথের শুদ্ধ সুর ছড়িয়ে দিয়েছেন। পাপিয়া আপা আমাদের ছায়ানটের প্রাক্তনী, তাঁর মতো গুণি শিল্পীকে ছায়ানটে ফুলেল শ্রদ্ধা জানিয়ে বিদায় দিয়েছি। তিনি অনন্তলোকে ভালো থাকুন।”
ছায়ানট থেকে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে শিল্পীর মরদেহ আনা হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে। সেখানে জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সংস্থার ব্যবস্থাপনায় শ্রদ্ধা জানিয়েছেন অনেকে।
এছাড়া জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সংস্থা, সত্যেনসেন শিল্পী গোষ্ঠী, সুরবিহার, স্বনন, নীতিসুধা, সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
সেখানে পাপিয়ার পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণিপেশার অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
পাপিয়া সারোয়ারের স্বামী সারোয়ার এ আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন বাদ জুম্মা ধানমন্ডির ঈদগাঁ মাঠে জানাজার পর বনানী কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হবে।
পাপিয়া সারোয়ারের খ্যাতি রবীন্দ্রসংগীতে। আধুনিক গানেও তিনি পরিচিত। ১৯৭৮ সালের প্রথম দিকে বিটিভির একটি অনুষ্ঠানে প্রচার হয় পাপিয়ার ‘নাই টেলিফোন নাইরে পিয়ন নাইরে টেলিগ্রাম’ গানটি। এই গানটি তাকে রবীন্দ্র সংগীতশিল্পীর বাইরে আলাদা একটি পরিচিতি এনে দেয়।
২০১৩ সালে তিনি বাংলা একাডেমি থেকে রবীন্দ্র পুরস্কার পান। ২০১৫ সালে বাংলা একাডেমি ফেলোশিপ লাভ করেন। চলতি বছর চ্যানেল আইয়ের আয়োজনে রবীন্দ্রমেলায় পাপিয়া সারোয়ারকে আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়।
বরিশালের মেয়ে পাপিয়া প্রাণিবিদ্যা বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে ১৯৭৩ সালে তিনি রবীন্দ্রসংগীতে ডিগ্রি নিতে যান বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে।
তার আগে তিনি ১৯৬৬ সালে ছায়ানটে ওয়াহিদুল হক, সনজীদা খাতুন এবং জাহেদুর রহিমের কাছে এবং পরবর্তীতে বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে সংগীত দীক্ষা নেন।
তার দুই মেয়ের মধ্যে জারা সারোয়ার থাকেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সিতে; আর ছোট মেয়ে জিশা সারোয়ার থাকেন কানাডায়।
পুরনো খবর
শিল্পী পাপিয়া সারোয়ারের জীবনাবসান
শিল্পী পাপিয়া সারোয়ার 'লাইফ সাপোর্টে