ঢাকার তেজগাঁওয়ের রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্সের সামনের সড়ক নালা সংস্কারের জন্য খোঁড়া হয়েছিল, সেই গর্তে বালি ফেলার পর ইটের খোয়া দেওয়া হয়েছে। কিন্তু গাড়ি চলার সময় ওড়ে ধুলা, এই দূষণ থেকে বাঁচতে পথচারীদের চলতে হয় নাক-মুখ ঢেকে।
Published : 22 Nov 2021, 12:15 AM
এমন সংস্কার চলছে বিভিন্ন সড়কে, আর তাতে ওড়া ধুলাই ঢাকার বায়ু দূষণের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন বিশেষজ্ঞরা।
শীতের শুরুতে শুষ্ক আবহাওয়ার মধ্যে ঢাকায় বায়ু দূষণের মাত্রা মারাত্মক অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে পৌঁছেছে পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যেই দেখা গেছে।
অধিদপ্তরের নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (কেস) প্রকল্পের তথ্য বলছে, গত বুধবার বাংলাদেশের রাজধানীর বায়ু মান (একিউআই) ছিল ৩০৭।
যার অর্থ সেদিন ঢাকার বাতাস ছিল মারাত্মক অস্বাস্থ্যকর।
বাতাসে ভাসমান বস্তুকণার (পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পিএম) পরিমাপ করা হয় প্রতি ঘনমিটারে মাইক্রোগ্রাম (পিপিএম-পার্টস পার মিলিয়ন) এককে। এসব বস্তুকণাকে ১০ মাইক্রোমিটার ও ২.৫ মাইক্রোমিটার ব্যাস শ্রেণিতে ভাগ করে তার পরিমাণের ভিত্তিতে ঝুঁকি নিরূপণ করেন গবেষকরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে ২.৫ মাইক্রোমিটার ব্যাসের বস্তুকণার পরিমাণ (পিপিএম) যদি শূন্য থেকে ৫০ এর মধ্যে থাকে, তাহলে ওই বাতাসকে বায়ু মানের সূচকে (একিউআই) ‘ভালো’ বলা যায়।
এই মাত্রা ৫১-১০০ হলে বাতাসকে ‘মধ্যম’ মানের এবং ১০১-১৫০ হলে ‘বিপদসীমায়’ আছে বলে ধরে নেওয়া হয়। আর পিপিএম ১৫১-২০০ হলে বাতাসকে ‘অস্বাস্থ্যকর’, ২০১-৩০০ হলে ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ এবং ৩০১-৫০০ হলে ‘অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর’ বলা হয়।
বায়ু দূষণের দিক থেকে বিশ্বে সবচেয়ে উপরের দিকে থাকা ভারতের রাজধানী দিল্লিতে গত ১৭ নভেম্বর বায়ু মান ছিল ৩৮৯। প্রবল দূষণের কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয় রাজ্য সরকার।
দিল্লির বিভিন্ন এলাকায় বায়ু মান ৩০০ থেকে ৪০০ একিউআইর মধ্যে ঘোরাফেরা করে। ঢাকার বায়ু মানও এখন সেই অবস্থার কাছাকাছি পৌঁছেছে।
খোঁড়াখুঁড়িতে বাড়ছে ধুলা
ঢাকায় বায়ুদূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয় রাস্তা খোঁড়াখুড়ি এবং সমন্বয়হীন উন্নয়ন কাজকে।
বাংলাদেশের স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর অ্যাটমোস্ফেরিক পলিউশান স্টাডিজ-ক্যাপ’র গত জানুয়ারির তথ্য বলছে, ঢাকায় যেসব উৎসগুলো বায়ু দূষণ ঘটায়, তার ৩০ শতাংশই হয় সমন্বয়হীন রাস্তা খোঁড়াখুড়ি এবং নির্মাণকাজের কারণে।
এছাড়া ঢাকায় বায়ুদূষণের জন্য ইটভাটা ও শিল্প কারখানা ২৯ শতাংশ, যানবাহন ১৫ শতাংশ, আন্তঃদেশীয় দূষণ ১০ শতাংশ, গৃহস্থালী ও রান্নার চুলা ৯ শতাংশ এবং বর্জ্য পোড়ানো ৭ শতাংশ দায়ী।
স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ড. কামরুজ্জামান মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রতি বছর নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি-এই চার মাস দূষণ সবচেয়ে বেশি থাকে।
বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে নিয়ম না মানাকে দূষণের বড় কারণ বলে দায়ী করেন তিনি। দূষণ রোধে হাই কোর্টের নির্দেশনা না মানার কথাও বলেন তিনি।
“আমরা জানি, আমাদের সক্ষমতার অভাব আছে। এজন্য সব জায়গায় অন্তত দিনে দুইবার পানি দিক। আমরা দেখেছি, একবার পানি দিলে অন্তত দেড় ঘণ্টা দূষণ নিম্নমুখী অবস্থানে থাকে।”
বর্তমানে ঢাকার উত্তরা, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, উত্তরখান, বনানী, গুলশান, বারিধারা, কল্যাণপুর, আগারগাঁও, ধানমণ্ডি, আজিমপুর, লালবাগ, মতিঝিল, কমলাপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় চলছে উন্নয়ন কাজ।
ঢাকা ওয়াসা, তিতাস গ্যাস, ডেসকো, বিটিসিএল, পিজিসিবি, ডিপিডিসিসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান সড়ক খুঁড়ে বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ চালাচ্ছে।
এছাড়া মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বাস র্যাপিড ট্রানজিটের কাজ চলছে শহরজুড়ে। রাজউকের পূর্বাচল ৩০০ সড়ক প্রকল্প এবং যাত্রাবাড়ি থেকে ডেমরা পর্যন্ত সড়ক প্রশস্তের কাজও চলছে এই সময়ে।
সড়ক খনন নীতিমালা অনুযায়ী, নির্মাণ এলাকায় যেন ধুলাবালি না উড়ে, সেজন্য নিয়মিত প্রয়োজনীয় পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
কিন্তু এসব এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এই নিয়ম মানা হচ্ছে না। বিভিন্ন জায়গায় খনন করে সড়কের পাশে মাটি ফেলে রাখা হয়েছে। কোথাও খনন করা গর্ত ভরাট করে তাতে মাটি ও ইটের খোয়া ফেলা হয়েছে।
তেজগাঁওয়ের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ সরণি, তেজগাঁও-গুলশান লিঙ্করোডসহ পুরো এলাকা জুড়ে চলছে পানি নিষ্কাশন নালা বসানো এবং ফুটপাত উন্নয়নের কাজ। ফলে ওই এলাকার প্রতিটি সড়ক এখন ধুলায় ধুসর।
তেজগাঁওয়ের রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্সের ফুটপাতের চা দোকানি ছালেক মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, প্রায় ১৫ দিন আগে গর্ত ভরাট করা হয়েছে। কাজ করার সময় পানি দিলেও এখন আর পানি দেওয়া হচ্ছে না।
ওই এলাকার নিষ্কাশন নালা বসানোর একটা অংশের কাজ করছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আসিফ ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড।
এই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল হাই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে দাবি করেন, প্রতিদিনই পানি দেওয়া হচ্ছে সড়কে।
তবে পর্যাপ্ত পানি দেওয়া যায় না স্বীকার করে তিনি বলেন, “সড়কে যে ধুলা উড়ে না সেটা অস্বীকার করা যাবে না। তবে সারাক্ষণ পানি দেওয়া সম্ভব হয় না। তবে আমরা চেষ্টা করি পানি দিতে।”
বিআরটির নির্মাণকাজের জন্য উত্তরা এলাকায় ধুলা হয়, যা নিয়ে ভুগতে হয় প্রতিদিন টঙ্গী থেকে মিরপুরে যাতায়াতকারী সাইফুল ইসলামকে।
টঙ্গীর এই বাসিন্দা বলেন, “তারা মোটেও নিয়মকানুন মানে না, মানলে তো পানি দিত।”
যাত্রাবাড়ি থেকে ডেমরা পর্যন্ত সড়কে চার লেইনের কাজ চলছে। ফলে পুরো সড়কে ধুলার ওড়াউড়ি।
স্টাফ কোয়ার্টার মোড়ে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের সদস্য সোহরাব হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সকাল, দুপুর ও বিকাল- এই তিন বার পানি দিলেও তা শুকিয়ে যায় খুব দ্রুত।
“সারাদিন সড়কে ধুলা থাকে। মাঝেমধ্যে আমরা তাদের বলে পানি দেওয়াই। রাতে অবস্থা খুব খারাপ হয়।”
একটি পরিবহন কোম্পানির সুপারভাইজার মো. জামাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোনোদিন পানি দেয়, কোনোদিন দেয় না। এমন ধুলা হয় যে ঠিকমতো খাড়ান যায় না।”
ঢাকা মেডিকেল কলেজের পাশে বকশীবাজার থেকে থেকে চানখারপুল পর্যন্ত সড়কে নিষ্কাশন নালা বসানোর কাজ চলছে। সেখানেও ধুলা উড়ছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনের দোকানি আবদুল হাই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে মঙ্গলবার বলেন, “তিন দিন আগে একবার পানি দিতে দেখছি। এরপর আর নাই। আমাদের তো সমস্যা হয়ই, হাসপাতালেও ধুলা উইড়া যায়।”
সড়কের পাশাপাশি বিভিন্ন ভবন নির্মাণের কাজও বাড়াচ্ছে ধুলা।
আজিমপুর সরকারি কলোনির পুরাতন ভবন ভাঙার কাজ চলছে। তবে কোনো আচ্ছাদন না দেওয়ায় ধুলাবালি উড়ে আশপাশে ছড়িয়ে পড়ছে।
ভবন ভাঙার সর্দার মো. আনিস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা একা না। আরও কয়েকটা গ্রুপ আছে বিল্ডিং ভাঙার দায়িত্বে। আমরা চারপাশে দেওয়ার জন্য জাল দিয়ে এসেছি। জাল দিয়ে দিব।”
ধুলা দূষণ রোধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে- জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পর্যাপ্ত পানি ছিটানো, নির্মাণ সাইট বেষ্টনি দিয়ে রাখার শর্তে সংস্থাগুলোকে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির অনুমতি দেওয়া হয়। এসব শর্ত মেনে চলা উচিৎ।
শর্ত না মানলে কী করা হয়- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নস্থলে পর্যাপ্ত পানি না দেওয়ার কারণে ধুলোবালির পরিমাণ বেড়ে গেলে আমরা সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে আরও দায়িত্বশীল হওয়ার এবং যে শর্ত সাপেক্ষে অনুমোদন পেয়েছেন, তা প্রতিপালনের অনুরোধ জানাই।”