অহনার মা রুবিনা ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভেবেছিলাম বড় হলে সমস্যাটা কমে আসবে, কিন্তু না। ওকে যতই সাবধানে রাখি, তারপরও অসুস্থ হয়ে পড়ে। ধুলোবালিতে অ্যালার্জি থেকে ঠাণ্ডা লেগে যায়। এবারও বুকে কফ জমে শ্বাসকষ্টের সমস্যা হয়েছে, কাশিও ছিল কিছুদিন।... এই মৌসুমটায় আতঙ্কে থাকি, এবছর ভয়টা আরও বেড়ে গেছে।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত নভেম্বর থেকে জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত দেশে প্রায় অর্ধলক্ষ মানুষ শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর বাইরেও বহু মানুষকে বিভিন্ন শীতজনিত অসুস্থতায় ভুগতে হয়েছে, যাদের তথ্য এই হিসাবে আসেনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বরাবরের মত এবারও শীতের শুষ্ক আবহাওয়ায় বায়ু দূষণ বেড়েছে, আর তাতে মানুষের শ্বাসতন্ত্রের অসুস্থতাও বাড়ছে।
দেশে গতবছর করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর প্রথম দিকে যানবাহন, কলকারখানাসহ সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকার ঢাকার বাতাসে দূষণের মাত্রা কিছুটা কমলেও স্বস্তির শ্বাস নেওয়ার মতো অবস্থায় পৌঁছায়নি।
বায়ু দূষণ শুধু স্বাস্থ্যঝুঁকি নয়, পরিবেশ ও অর্থনীতিতেও বিরূপ প্রভাব ফেলেছে বলে উঠে এসেছে এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) এক গবেষণায়।
বায়ুমান পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকায় বায়ুমানের অবনতি হয়ে তা বিপজ্জনক সীমা ছাড়িয়ে গেছে।
বাতাসের মান নির্ভর করে ভাসমান সূক্ষ্ম ধূলিকণার পরিমাণ (পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পিএম-১০) এবং অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণার পরিমাণের (পিএম ২.৫) ওপর, যা পরিমাপ করা হয় প্রতি ঘনমিটারে মাইক্রোগ্রাম (পার্টস পার মিলিয়ন-পিপিএম) এককে।
একিউআই শূন্য থেকে ৫০ এর মধ্যে থাকলে সেই এলাকার বাতাসকে ভালো বলা যায়। ৫১ থেকে ১০০ হলে বাতাসের মান মডারেট বা মোটামুটি গ্রহণযোগ্য ধরা হয়।
একিউআই ১০১ থেকে ১৫০ হলে সেই বাতাস স্পর্শকাতর শ্রেণির মানুষের (শিশু, বৃদ্ধ, শ্বাসকষ্টের রোগী) জন্য অস্বাস্থ্যকর এবং ১৫১ থেকে ২০০ হলে তা সবার জন্যই অস্বাস্থ্যকর বিবেচিত হয়। আর একিউআই ২০ থেকে ৩০০ হলে তা খুবই অস্বাস্থ্যকর এবং ৩০১ থেকে ৫০০ হলে সেই বাতাসকে বিপদজনক ধরা হয়।
একিউআই বিপদজনক পর্যায়ে পৌঁছালে পুরো জনগোষ্ঠীর গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়, যা স্বাস্থ্য সতর্কতা জারির পরিস্থিতি সৃষ্টি করে।
এসডোর সাম্প্রতিক এক গবেষণা তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ১১ মাসের বায়ুমান সূচকে বিশ্বব্যাপী সর্বাধিক দূষণের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল দ্বিতীয় এবং বিশ্বের শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা ছিল চতুর্থ অবস্থানে।
আন্তর্জাতিক বায়ুমান প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় ঢাকা নিয়মিতই ওপরের দিকে থাকছে। তাদের তথ্য বলছে, গত এক মাসে ১৮ দিনই ঢাকার বাতাস ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ ও ‘বিপদজনক’ মাত্রায় ছিল।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণ দেখা যায় গত ১৯ জানুয়ারি, সেদিন একিউআই ওঠে ৩৬৩ এ। সেদিন সকাল ৮টার দিকে ঢাকার একিউআই ৬০৩ পর্যন্ত ওঠে।
নর্দার্ন ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ বিশ্বাস আখতার হোসাইন বলেন, ঢাকার বায়দূষণ জনস্বাস্থ্যের ওপর ‘মারাত্মক চাপ’ ফেলছে।
শীতের এই সময়ে অ্যাজমা, সিওপিডি, ফুসফুসের সংক্রমণজনিত রোগী বেশি পাওয়া যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে শিশু ও বয়স্করা বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন বলে জানান তিনি।
২০১৮ সালের শীতে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পাঁচ দিন হাসপাতালে কাটাতে হয়েছিল আবুল খায়ের গ্রুপের বিপণন বিভাগের কর্মকর্তা চিন্ময় মজুমদারকে।
সেবারের ভোগান্তির কারণে শীত এলে বেশ সাবধানে থাকেন তিনি। এ বছর তীব্র সমস্যা না হলেও সর্দি, কাশি লেগেই আছে।
মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা চিন্ময় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এবার শীতের শুরুতে জ্বর, সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্ট ছিল। ধুলা আর ঠাণ্ডাজনিত অ্যালার্জিতেই এ সময় বেশি আক্রান্ত হই। ধুলাবালিতে গেলেই ঠাণ্ডা লেগে যায়, শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়। তখন ইনহেলার নিতে হয়।”
তবে মাস্ক ব্যবহারের কারণে এবার কিছুটা কম ভুগতে বলে আশা করছেন চিন্ময়।
“ঢাকা শহরে বের হলে তো ধুলাবালিতে শ্বাস নেওয়ার মত অবস্থা থাকে না। রাস্তয় খোঁড়াখুঁড়ি আর উন্নয়নের কাজ সারাবছরই চলতে থাকে। এবারের শীতে মাস্ক ব্যবহারের কারণে ধুলায় সমস্যা কিছুটা কম হচ্ছে। তবে শীতের আরও বাকি, জানি না কি হয়।”
ঢাকার বাতাস নিয়ে একই কথা বললেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ লেনিন চৌধুরী; তার ভাষায়, এ নগরীর বাতাস কখনও কখনও শ্বাস নেওয়ারও যোগ্য থাকছে না।
“দূষণের মাত্রাকে কখন আমরা বিপদজনক বলি? যখন এটা গ্রহণ করলে আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি, মৃত্যুর ঝুঁকি তৈরি হয়, স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হয়। শীত আসার পর থেকে বায়ুমান ক্রমাগত অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে আছে এবং মাঝে মাঝে বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। তার মানে ঢাকায় আমরা এত দূষিত বায়ু নিচ্ছি যে, আমাদের ফুসফুস এবং শ্বাসতন্ত্র অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে।”
বায়ুদূষণ কীভাবে ঢাকার মানুষের ওপর প্রভাব ফেলছে, তার ব্যাখ্যা করে এই চিকিৎসক বলেন, “পিএম ২.৫ ফুসফুস হয়ে রক্তেও চলে যায় এবং রক্তের মধ্য দিয়ে লিভার, কিডনি, প্লীহাসহ শরীরের নানা অঙ্গ-প্রতঙ্গকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং হরমোনকেও প্রভাবিত করে। ফলে নানা অসুখ হয়।
“একদিকে শ্বাসতন্ত্রীয় অসুখ হচ্ছে, অন্যদিকে দূষিত বাতাসের কারণে টিউবারকোলোসিস জাতীয় রোগ বেড়ে যায়। যাদের শ্বাসতন্ত্রের অ্যালার্জি রয়েছে, হাঁপানি বা শ্বাসের টান শুরু হয়ে যায়, অথবা যারা অধিক সংবেদনশীল, তাদের শ্বাসের অসুবিধা শুরু হয়ে যায়। শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগ যেমন- নিউমোনিয়া, টিউবারকোলোসিস, গলায় ব্যথা বেড়ে যায়। আবার মাথা ঝিমঝিম, মাথাব্যথা, বমিভাব তৈরি হয়। এর প্রভাবে হৃদপিণ্ডের গতি বেড়ে যায়।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে দেশে হাঁপানি রোগীর সংখ্যা প্রায় ২৪ গুণ বেড়েছে। আর শ্বাসতন্ত্রের রোগে মৃত্যুর সংখ্যা ১০ গুণ বেড়েছে। এর মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী ফুসফুসজনিত রোগের চিকিৎসা নেওয়া রোগীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ১৯ শতাংশ।
বায়ুদূষণ নারী-পুরুষের বন্ধ্যাত্বের সমস্যা ছাড়াও বেশ কিছু জটিল সমস্যা তৈরি করছে বলে জানান হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক লেলিন চৌধুরী।
তিনি বলেন, “বায়ুদূষণের রোগের দুটি ধরণ রয়েছে। একটি হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদী ও আরেকটি হচ্ছে তাৎক্ষণিক। শ্বাসের টান, হাঁচি, কাশি কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে শুরু হয়ে যায়। নিউমোনিয়া তাৎক্ষণিকভাবে শুরু না হলেও কিছুদিনের মধ্যে শুরু হয়ে যায়। ফুসফুসের ক্যান্সার, কিডনি বা প্লীহার সমস্যা দেরিতে স্পষ্ট হয়।”
শুধু মানুষ নয়, দূষিত বায়ু সমস্ত জীবনচক্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে বলে জানান পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক লেলিন চৌধুরী।
তিনি বলেন, “বায়ুদূষণে ধুলায় গাছের ওপর একটা আস্তরণ ফেলে, ফলে সালোকসংশ্লেষণ ব্যাহত হয়। এতে বায়ুমণ্ডলের অক্সিজেন ও কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ভারসাম্য নষ্ট হয়। প্রাণীর স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়। দূষিত বায়ু পানিতে মিশে জলজ প্রাণির ক্ষতি করে। আমরা যেভাবে যাচ্ছি, সেভাবে চলতে থাকলে ক্রমাগত একটি অসুস্থ জাতিতে পরিণত হব।”
নির্মাণকাজে বিধি না মানা, দূষণ সৃষ্টিকারী যানবাহন নিয়ন্ত্রণ না করা, বর্জ্যের অব্যবস্থাপনা, ইটভাটা ও অপরিকল্পিত কলকারখানা নিয়ন্ত্রণ না করা এবং পানি না ছিটানোয় বায়ুদূষণ বাড়ছে বলে জানান তিনি।
“কোনো দিন বায়ু বিপজ্জনক বা অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে থাকলে আবহাওয়া অধিদপ্তর বা পরিবেশ অধিদপ্তরের উচিত মানুষকে সতর্কতা সংকেত দেওয়া, যাতে ওইদিনগুলোতে মানুষ খুব বেশি প্রয়োজন না হলে বাইরে না যায়। গেলেও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে যেন মাস্ক পরে। এখন যারা মাস্ক পরছে, কিছুটা রক্ষা পাচ্ছে। বায়ুদূষণের সংকেত দেওয়া গেলে সাধারণ মানুষের অনেক উপকারে আসবে।”
তিনি বলেন, “পরিবর্তিত তাপমাত্রায় খাপ খাইয়ে নিতে গরম কাপড় পরতে হবে, যেন ঠাণ্ড বাতাস নাক-মুখ দিয়ে ঢুকতে না পারে। কুয়াশার মধ্যে বের না হওয়া ভালো। পুষ্টিকর খাবার, যেমন ভিটামিন, প্রেটিন, মিনারেলসমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। মাস্ক পরতে হবে। যারা সচেতন, তারা পরছে, আমার অনেক রোগী মাস্ক পরার কারণে এবার শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হননি।”
ঢাকার বায়দূষণ বাড়ায় বাইরের দায় বেশি দেখছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগের পরিচালক জিয়াউল হক।
তিনি বলেন, ভারত থেকে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল দিয়ে ‘প্রচুর দূষিত বায়ু’ দেশে প্রবেশ করে। এ কারণে বাংলাদেশে দূষণের মাত্রা মাঝে মাঝে অনেক বেড়ে যায়।
“ভারত থেকে একটা দূষণের মেঘ আমাদের দেশে প্রবেশ করে। ঢাকার ওপর দিয়ে চট্টগ্রাম হয়ে সেটা বঙ্গোপসাগর হয়ে চলে যায়। এটা দূষণের বড় একটা স্তর। এটা ঢাকাসহ কয়েকটা জেলার উপর দিয়ে চলে যায়।”
এসডোর এক গবেষণাতেও বিষয়টি উঠে এসেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মৌসুম পরিবর্তন ও বাতাসের আন্তঃসীমান্ত গতিশীলতা বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ। শীতকালে আন্তঃসীমান্ত গতিশীলতার বাতাসে দূষিত বায়ুকণার প্রভাব সর্বোচ্চ থাকে, যা বাংলাদেশে ইন্ডিয়ান বেল্টের কারণে উত্তরদিকে প্রবাহিত হয়ে ঢাকা, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছায়।
নভেম্বর থেকে জানুয়ারি মাসে বায়ুপ্রবাহ কম থাকায় বায়ুদূষণ বেশি হয় বলে জানান জিয়াউল হক।
দূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের তৎপরতার বিষয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, “আমরা এখন ঢাকার ভেতরে নির্মাণকাজ কমানোর দিকে নজর দিয়েছি। নির্মাণকাজে পানি দেওয়া- এটা বাড়ানো হবে। ইটভাটাগুলোতে আমরা জোরালো অভিযান চালাচ্ছি। ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারির মাঝামাঝি নাগাদ ৫০টির মতো ইটভাটা আমরা বন্ধ করে দিয়েছি।”
যানবাহনের মাধ্যমে দূষণ কমানোতে এখনও সফল না হলেও বিআরটিএসহ বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে বিষয়টি কথাবার্তা হচ্ছে বলে জানান তিনি।