ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স চায় এসি ব্যবহার নিয়ে নীতিমালা করে তা মানতে জনগণকে বাধ্য করা হোক।
Published : 04 May 2024, 10:08 PM
রাজধানীতে নগর পরিকল্পনাবিদদের সংগঠনের এক আয়োজনে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বা এসি ব্যবহার সীমিত করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, এটা করতে না পারলে সবুজায়নের পরিমাণ বাড়ালেও কাজ হবে না।
আলোচনায় বক্তারা বলেন, ঢাকায় সবুজ এলাকা ও জলাভূমি কমার পাশাপাশি ভবন নির্মাণ কৌশলের কারণেও তাপমাত্রা বাড়ছে। এসির ব্যবহারও এতে ভূমিকা রেখেছে।
শনিবার নগর পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) রাজধানীর বাংলা মোটরের প্ল্যানার্স টাওয়ারে ‘ঢাকায় দাবদাহ: নগর পরিকল্পনা ও উন্নয়ন ব্যবস্থাপনার দায় ও করণীয়’ শীর্ষক আলোচনার আয়োজন করে।
সেই আলোচনায় স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদরা বলেন, আলো-বাতাস চলাচলকে ব্যাহত করে আবদ্ধ ও কাচ নির্মিত ঘর আর শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ব্যবহারের কারণে তাপমাত্রা বাড়ছে।
অবশ্য বিআইপির কার্যালয়েও এসির ব্যবহার আছে।
ইনস্টিটিউটের সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, “ঢাকা শহরে সবুজ যেমন কমেছে, ঠিক তেমনি গত দুই দশকে বেড়েছে মাত্রাতিরিক্ত ধূসর এলাকা ও কংক্রিটের পরিমাণ, যা নগর এলাকায় তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে মারাত্মক হারে।
“বাড়ছে আরবান হিট আইল্যান্ড এর প্রভাব। ২০১৯ সালে করা বিআইপির গবেষণা অনুসারে, কংক্রিট আচ্ছাদিত এলাকা ১৯৯৯ সালে ছিল ৬৪ দশমিক ৯৯ ভাগ, ২০০৯ সালে বেড়ে হয় ৭৭ দশমিক ১৮ ভাগ, আর ২০১৯ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৮১ দশমিক ৮২ শতাংশে।”
বিআইপির সাধারণ সম্পাদক শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে পুরো পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১ থেকে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধির কথা বলা হলেও ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় এই তাপমাত্রা ৫ থেকে ৬ ডিগ্রি বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিআইপির ন্যাশনাল অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল লিয়াঁজো পরিকল্পনাবিদ আবু নাইম সোহাগ বলেন, “কাগজে কলমে ঢাকা শহরে যে পরিমাণ খাল অথবা জলাভূমির পরিমাণ উল্লেখ করা রয়েছে বাস্তবে তার পরিমাণ আরও কম।
“প্রতিনিয়ত নগরায়ণে পার্ক, উদ্যান এবং জলাভূমি ভরাট করা হচ্ছে যা আমাদের ঢাকা শহরে তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে অন্যতম কারণ। তাছাড়া ঢাকা শহরে এসি ব্যবহারে যে বাণিজ্যিক চিন্তাভাবনা গড়ে উঠেছে তা থেকে আমাদেরকে যত দ্রুত সম্ভব সরে আসতে হবে।”
বিআইপির বোর্ড সদস্য (রিসার্চ অ্যান্ড পাবলিকেশন) পরিকল্পনাবিদ হোসনে আরা বলেন, “ঢাকার দাবদাহ নিয়ন্ত্রণ এবং তাপ সহনশীল নগর হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে আরবান হিট মিটিগেশন ও ম্যানেজমেন্ট কৌশল নগর পরিকল্পনায় সর্বোচ্চ বিবেচনায় আনতে হবে।”
পরিকল্পনাবিদ মো. রেদওয়ানুর রহমান বলেন, “ঢাকা শহরে ৫ থেকে ১০ শতাংশ জনগণ এসি ব্যবহার করে থাকে যা আমাদের ঢাকা শহরের তাপমাত্রা পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান কারণ। এটি আমাদের জলবায়ুরও ক্ষতি করছে।”
এই ধরনের পণ্য ব্যবহারে নীতিমালা প্রণয়ন এবং জনগণকে তা মানতে বাধ্য করতে সরকারকে আহ্বানও জানান তিনি। বলেন, “শহরে কার্বন নিঃসরণ কমানো না গেলে সবুজায়নের পরিমাণ বৃদ্ধি করেও শহরের তাপমাত্রা পরিবর্তনে তেমন একটা ভূমিকা রাখবে না।”
পরিকল্পনা সংলাপে আদিল মুহাম্মদ ঢাকা মহানগরীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে বিআইপির পক্ষ থেকে ২৩টি প্রস্তাব তুলে ধরেন।
এর মধ্যে বৃক্ষ রোপণ, সবুজায়ন মহাপরিকল্পনা যেমন আছে, তেমনি জলাশয়-জলাভূমি ও সবুজ এলাকা বাস্তবতার নিরিখে সম্ভাব্যতা যাচাই সাপেক্ষে পুনরুদ্ধার করার কথা বলা আছে।
এসির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও সীমিত করতে প্রয়োজনীয় নীতিমালা ও নির্দেশনা প্রণয়ন, ভবনের নকশায় প্রাকৃতিক আলো-বাতাস চলাচল ও জ্বালানি সাশ্রয়কে প্রাধান্য দিয়ে যথাযথ নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবহারের তাগিদও দেন তিনি।
কার্যকর নগর পরিকল্পনা ও ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনার মাধ্যমে সবুজ এলাকা, জলাশয় ও কংক্রিট এলাকার ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার কথাও বলা হয় প্রস্তাবে।
নগর এলাকার সড়কের ধারে ও ফুটপাতের পাশে বৃক্ষায়নের উদ্যোগ বাড়ানো, ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জলাশয় ও জলাধার রক্ষা, আবাসিক এলাকা ও ভবনের মধ্যবর্তী স্থানে সবুজায়ন ও বৃক্ষায়ন বাড়ানো, সরু রাস্তার পাশে সুউচ্চ ভবন নির্মাণ করবার বিদ্যমান প্রবণতা বন্ধ করা, বেসরকারি আবাসিক প্রকল্পের বিধিমালা সংশোধন করে সবুজ ও জলাশয় এলাকা, পার্ক, উদ্যান, খেলার মাঠ বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ, ঢাকার প্রতিটি ওয়ার্ডের জন্য আলাদা মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন, মাত্রাতিরিক্ত কংক্রিটের ব্যবহার বন্ধ করার পরামর্শও উঠে আসে এতে।
ময়লার ভাগাড়, ইটভাটা, যানবাহন ও শিল্পকারখানার ধোঁয়া থেকে বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, মেগা প্রকল্প ও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে জলাশয়-জলাধার-সবুজ এলাকা, পার্ক-উদ্যান-খেলার মাঠ যেন ধ্বংস না হয়, সে ব্যাপারে নগর সংস্থাসমূহের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় নিশ্চিত করা, জলকেন্দ্রিক পার্ক, ইকোপার্ক, পার্ক, খেলার মাঠ তৈরিতে স্থানীয় সরকারকে সম্পৃক্ত করে দ্রুততম সময়ে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ, জ্বালানি সাশ্রয়ী ভবন ও গ্রিন বিল্ডিং কোড প্রণয়নের কথাও আছে তার প্রস্তাবে।
প্রান্তিক, নিম্ন আয় ও বস্তি এলাকার মানুষের আবাসন পরিকল্পনা, বসতির নির্মাণ উপাদান-উপকরণসমূহের বিষয়ে যথাযথ নির্দেশনা ও নীতিমালা প্রণয়ন করার কথাও বলেন আদিল মুহাম্মদ খান।