ঢাকায় জলাধার ও সবুজ উধাওয়ের পথে, পার্ক ছেয়েছে কংক্রিটে: গবেষণা

“আজকে হাতিরঝিলে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নিয়ে কথা হয়। কিন্তু এলিভেটেড না হলে রাস্তায় চলাচল করবেন কীভাবে?- প্রশ্ন স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 June 2023, 05:05 PM
Updated : 3 June 2023, 05:05 PM

জলাধার ভরাট করে ও সবুজ খালি জায়গায় একের পর এক ভবন তৈরির মূল্য দিতে হচ্ছে ঢাকাবাসীকে; কমতে কমতে ২৮ বছরের ব্যবধানে জলাভূমি এসে ঠেকেছে মাত্র ২ দশমিক ৯১ শতাংশে এবং সবুজ এলাকা ৭ দশমিক ৯ শতাংশে।

শনিবার ঢাকায় এ বিষয়ক এক গবেষণার বরাতে এসব তথ্য তুলে ধরে জানানো হয়, প্রায় ৩০৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ঢাকা শহরে ১৯৯৫ সালে ঢাকা শহরে জলাধার ও জলভূমি ছিল নগরীর মোট আয়তনের ৩০ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং সবুজ এলাকার পরিমাণ ছিল ১৯ দশমিক ৭৮ শতাংশ।

ওই সময় ৪৩ দশমিক ৭২ শতাংশ এলাকা নির্মাণের আওতায় এসেছিল, যা এখন বেড়ে হয়েছে ৭৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ।

কোনো ধরনের নিয়ম না মেনে খেলার মাঠ দখল করে ক্লাব, বিপণিবিতান, হাটবাজারসহ নানা স্থাপনা এবং জলাভূমি ভরাট করে প্রতিনিয়ত আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন তৈরি করায় সবুজ ও জলাভূমি কমেছে আশঙ্কাজনক হারে বলে এ গবেষণার প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে জানানো হয়।

এতে বলা হয়, একটি আদর্শ শহরে ১০ থেকে ১২ শতাংশ জলাভূমি এবং ১৫ শতাংশ সবুজ থাকাটা প্রয়োজন।

রাজধানী ঢাকায় পার্কের উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে কংক্রিট আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণও অত্যন্ত বেশি। প্রতিবেদনে দেখা যায়, বনানী পার্ক, বিচারপতি সাহাবুদ্দিন পার্ক, ওসমানী এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের যথাক্রমে ৪২, ৩৭, ৫২ ও ৩৭ শতাংশ এলাকা কংক্রিটে আচ্ছাদিত।

এমন প্রেক্ষাপটে বক্তারা উন্নয়নের নামে জলাশয় ভরাট করা ও সবুজ নষ্ট করে সরকারি-বেসরকারি নির্মাণ কার্যক্রম হাতে নেওয়ার সমালোচনা করেন। এ বিষয়ে নিয়ম মেনে চলা ও সচেতনতা বাড়ানোর তাগিদ দেন।

Also Read: জলাধার ভরাট করে বিএডিসির গবেষণাগার, ডিএনসিসির আপত্তি

Also Read: দুই দশকে জলাশয়ের ৭০% উধাও, রাজধানীতে কংক্রিটের রাজত্ব

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী ‘বিউটিফিকেশনের’ জন্য যে অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে তা সবুজ সংরক্ষণে ব্যয়ের পরামর্শ দেন।

এদিন বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) পরিচালিত ‘২৮ বছরে রাজধানীর জলাধার ও সবুজ নিধনঃ বাস্তবতা ও উত্তরণের পথনকশা' শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ ও গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করা হয়।

বিআইপি মিলনায়তনে নগর উন্নয়ন সাংবাদিক ফোরামের সঙ্গে যৌথভাবে এটি আয়োজন করে সংগঠনটি। এতে বিআইপির সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন।

স্যাটেলাইটে চিত্র, সংবাদমাধ্যমে ও বিভিন্ন প্রকাশনায় প্রকাশিত সরকারি-বেসরকারি তথ্য এবং চারটি পার্ক সরেজমিনে পরিদর্শনের ভিত্তিতে এ গবেষণা করা হয়েছে।

আলোচনায় সাবের হোসেন বলেন, "একটা পর্যায়ে ঢাকা আদৌ বসবাসযোগ্য হবে কি না, সেই প্রশ্নটা অনেকের মনেই আসতে পারে। একটা শহরে জনপ্রতি গ্রিন স্পেস থাকা দরকার ৯ দশমিত ৩ মিটার। সেখানে দিল্লি ও করাচিতে আছে ৫ মিটার করে। আর ঢাকায় আছে মাত্র ৩।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় প্রতি সাড়ে ১২ হাজার জনে দুই একর খেলার মাঠ ও এক একর পার্ক থাকার প্রয়োজন থাকলেও বর্তমান জনসংখ্যা বিবেচনায় ৩৭ হাজার ৯০০ জনে এক একর মাঠ বা পার্ক রয়েছে।

এছাড়া যেকোনো পার্কের সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ এলাকা কংক্রিটে আচ্ছাদিত থাকতে পারে। কিন্তু ঢাকার পার্কগুলোর দিকে তাকালে উল্টো চিত্র চোখে পড়ে।

আলোচনায় অন্যান্যদের বক্তব্য শোনার পর প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, মানুষ বাড়লে দূষণ বাড়বে। সে কারণে প্রথমে ঠিক করতে হবে ঢাকায় কতজন থাকবে।

ঢাকায় রাস্তার জন্য জায়গা নেই মন্তব্য করে তিনি বলেন, আজকে হাতিরঝিলের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নিয়ে কথা হয়। কিন্তু এলিভেটেড না হলে রাস্তায় চলাচল করবেন কীভাবে?

“আমাদের রাস্তা কম, তাই সরকার চিন্তা করলো ফ্লাইওভার করবে, মেট্রোরেল করবে। এটা করা কি দোষ হয়েছে?"

প্রয়োজন ছাড়া গাছ কাটাকে সরকারও সমর্থন করে না উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, নগরের সবুজায়ন নিশ্চিত করতে ড্যাপে বর্ণিত বিষয়গুলো খুব সচেতনভাবেই করা হয়েছে। দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ না হলে ঢাকার নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা যাবে না।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সভাপতি সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেন, "জলাশয় ভরাট ও গাছ কাটার বিষয়টা যতখানি সামাজিক, ততখানি রাজনৈতিকও বটে।“

কোনো প্রকল্পই প্রাকৃতিক সম্পদের বিকল্প হতে পারবে না মন্তব্য করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ইশরাত ইসলাম বলেন, “তাই সবুজের ক্ষেত্রে আমি ছাদবাগান কথাটাকে ভয় পাচ্ছি। ওয়াটার পার্ক কথাটাকেও আমি ভয় পাই।"

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান পুরনো ঢাকায় গেন্ডারিয়া দিঘী, হাতিরঝিলের লেক ও গাবতলীতে বিএডিসির নিম্নভূমি ভরাট বন্ধ করার দাবি জানান।

সাবেক মুখ্য সচিব ও সোসাইটি অব এক্সপার্টস অন এনভায়রনমেন্ট ডেভেলপমেন্ট (সিড) এর সভাপতি মো. আবুল কালাম আজাদ প্রশ্ন রেখে বলেন, "আজকে পূর্বাচলে নদীকে লেক বানানো হচ্ছে। কেন? এতে তো ওখানে জলাভূমি ও প্লাবনভূমি কমে যাচ্ছে।"

Also Read: ধোলাইখাল জলাধারকে নান্দনিক রূপ দেওয়ার কাজ শুরু

Also Read: সীমানা নির্ধারণেই অনিশ্চয়তা, খাল উদ্ধার কীভাবে

নগর উন্নয়ন সাংবাদিক ফোরাম বাংলাদেশের সভাপতি অমিতোষ পালের অভিযোগ, উন্নয়নের নামে জলাশয় ভরাট করে ফেলা হচ্ছে এবং যে জলাশয়গুলো এখনও বেঁচে আছে সেগুলোর অবস্থা শোচনীয়। সোনারগাঁও হোটেলের পেছনের লেকে মশায় ভয়াবহ অবস্থা। বিদেশিরা এলে লেকের পাড়ে বসতে পারেন না।

বিআইপি সভাপতি পরিকল্পনাবিদ মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমনের সভাপতিত্বে বৈঠকে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সদস্য (উন্নয়ন) শামসুদ্দীন আহমেদ চৌধুরী, বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সহ সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ আলী নকী, স্ট্যামর্ফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার, নগর উন্নয়ন সাংবাদিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মো. সোহেল মামুন বক্তব্য দেন।