“বেশিরভাগ জায়গায়ই দখল করে ফেলা হয়েছে। অনেক জায়গায় খালের জায়গায় হাউজিং করে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়ে গেছে। দখলদারদের মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠান যেমন আছে, তেমনি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও আছে। এটা আমাদের জন্য মূল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে,” বলছেন একজন কর্মকর্তা।
Published : 11 May 2023, 01:36 AM
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকার ২৯টি খাল এবং কল্যাণপুর রিটেনশন পন্ডের সীমানা নির্ধারণ করতে গিয়ে জটিলতায় পড়েছে কর্তৃপক্ষ।
সিএস নকশায় যেখানে খাল থাকার কথা, এখন সেখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে দালানকোঠা। সীমানা নির্ধারণে নেওয়া প্রকল্পের আওতায় এ পর্যন্ত বসানো খুঁটির অনেকগুলোই পড়েছে বাড়ি এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভেতরে।
এসব খুঁটি অপসারণের দাবি জানিয়ে এরইমধ্যে অন্তত ৭০০ চিঠি এসেছে উত্তর সিটির সম্পত্তি বিভাগে। এ অবস্থায় সিএস নকশা অনুযায়ী খালগুলো উদ্ধার করা যাবে কি না তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। সীমানা খুঁটি বসানো শেষ না হওয়ায় বাড়ানো হয়েছে প্রকল্পের মেয়াদ।
মেয়র আতিকুল ইসলাম বলছেন, সিএস নকশা অনুযায়ী সীমানা নির্ধারণ করতে না পারলে খালের প্রশস্ততা কমে যাবে। তাতে খালগুলো গভীরতা ফিরে পাবে না, পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে।
২০২০ সালের ২১ ডিসেম্বর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকার খাল এবং ড্রেনেজ ব্যবস্থা সিটি কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেয় ঢাকা ওয়াসা। এসব খালের উন্নয়ন করতে গেলে দেখা যায়, খাল পাড় দখল করে আছে অবৈধ দখলদাররা; অনেক জায়গায় সীমানা পিলার নেই, থাকলেও সেগুলোর অবস্থান সঠিক নয়।
এ অবস্থায় সঠিকভাবে পানি নিষ্কাশনের জন্য খালগুলো নির্ধারিত প্রস্থ এবং গভীরতায় খননের জন্য সঠিক সীমানা নির্ধারণ, প্রকৃত সীমানা বরাবর পিলার স্থাপন, অবৈধ দখলদার চিহ্নিতকরণ এবং খালের জিএস ডেটাবেইজ তৈরির উদ্যোগ নেয় উত্তর সিটি।
সেজন্য ‘ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতাধীন ২৯টি খাল এবং একটি রেগুলেটিং পন্ডের সীমানা নির্ধারণ, অবৈধ দখলদার উচ্ছেদের পর সীমানা নির্দেশক পিলার স্থাপন, খাল ও পন্ডের জিআইএস ডাটাবেইজ তৈরিকরণ’ শীর্ষক প্রকল্প নেওয়া হয়।
প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৪ স্বতন্ত্র ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেড এবং অ্যাডহক সুপারভিশন কনসালটেন্ট। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ২৭ কোটি চার লাখ টাকার বেশি। প্রকল্পের আওতায় খালের পাড়ে ১ হাজার ৯১০টি খুঁটি বসার কথা।
২০২২ সালের ১ জানুয়ারি শুরু হওয়া প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ছিল ওই বছরের ৩১ ডিসেম্বর। কাজ শেষ না হওয়ায় এ বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল। তাতেও কাজ শেষ না হওয়ায় মেয়াদ আবার বাড়ানো হয়েছে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত।
সীমানা নির্ধারণ কাজের গত মার্চ মাস পর্যন্ত হওয়া অগ্রগতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন মেয়রের কাছে দিয়েছে বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান। সেখানে বলা হয়েছে, এখন পর্যন্ত রেগুলেটিং পন্ডের সীমানা পুরোপুরি নির্ধারণ করা যায়নি।
কল্যাণপুর ঘ, ঙ, চ খাল, রূপনগর আরামবাগ খাল, বাইশটেকি খাল, সাংবাদিক কলোনি খাল, কসাইবাড়ি খাল, মহাখালী খাল এবং উত্তরা দিয়াবাড়ি খালের সিএস তথ্য পাওয়া যায়নি।
এছাড়া সীমানা পিলার বসানোর উপযোগী না হওয়ায় কয়েকটি খালের পাড়ে তা বসানো হয়নি বলে জানানো হয়েছে প্রতিবেদনে।
সীমানা নির্ধারণ কাজে যুক্ত উত্তর সিটির একজন প্রকৌশলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সীমানা নির্ধারণে তারা সিএস, আরএস এবং বিডিএস নকশা দেখছেন। কিন্তু এসব খালের সীমানা নির্ধারণ করা হবে সবচেয়ে পুরোনো নকশা সিএস অনুযায়ী।
সিএস নকশায় যে সীমানা আছে, সেটাই খালের প্রকৃত সীমানা। কিন্তু ওই নকশা অনুযায়ী সীমানা পিলার বসাতে গিয়ে তারা নানা ধরনের বাধার মুখে পড়ছেন।
“সিএস অনুযায়ী যখন আমরা ধীরে ধীরে এগোচ্ছি তখন দেখা যাচ্ছে বেশিরভাগ জায়গায়ই দখল করে ফেলা হয়েছে। অনেক জায়গায় খালের জায়গায় হাউজিং করে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়ে গেছে। দখলদারদের মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠান যেমন আছে, তেমনি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও আছে। এটা আমাদের জন্য মূল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
ওই কর্মকর্তা বলেন, খালের ওপর যেখানে ৫ তলা, ১০ তলা ভবন হয়ে গেছে, সেখানে এখন কাজ করতে গেলে বিপুল প্রস্তুতি লাগবে। সিএস নকশায় কাজটি করতে গিয়ে যেসব বাধা আসছে, সেগুলো দূর করতে না পারলে সীমানা খুঁটি বসানো কঠিন।
এসব বিষয় ঢাকা উত্তর সিটির মেয়রকেও জানানো হয়েছে। এপ্রিল মাসে কর্মকর্তাদের নিয়ে এ বিষয়ে একটি বৈঠক করেছেন মেয়র আতিকুল ইসলাম। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছে, এই মুহূর্তে সিএস নকশা ধরে সীমানা নির্ধারণ করতে গেলে যেসব এলাকা থেকে বাধা কম আসছে, অবৈধ দখলদার কম এবং সিএস নকশা অনুযায়ী খালের অস্তিত্ব আছে, সেখানে আগে খুঁটি বসানো হবে।
মেয়র আতিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, উচ্চ আদালতের একটি রায় আছে নদীর সীমানা সিএস নকশা অনুযায়ী নির্ধারণ করতে হবে। তারাও চাইছেন সিএস নকশা অনুযায়ী খালের সীমানা নির্ধারণ করতে।
“ঢাকা শহরকে স্থায়ীভাবে জলাবদ্ধতামুক্ত করা, খালগুলোকে যদি নৌচলাচলের উপযোগী করতে হলে সিএস নকশা অনুযায়ী করতে হবে। পরের জরিপগুলোয় খালের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ দুটোই কমে যাচ্ছে।
“সীমানা পিলার বসাতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে যেখানে খাল থাকার কথা সেখানে খালই নাই। কিচ্ছু নাই, সব ভরাট করে ফেলা হয়েছে। আমার মতামত হচ্ছে কোর্ট সিএস ম্যাপ ধরে নদীর সীমানা পিলার বসানোর যে রায় দিয়েছে, সেটা অনুযায়ী করার।”
খালের জায়গায় নানা স্থাপনা
উত্তর সিটির প্রকৌশল শাখা সিএস, আরএস এবং বিডিএস-এই তিনটি নকশা অনুযায়ী খালের অবস্থান চিহ্নিত করে একটি নকশা করেছে।
ওই নকশায় দেখা গেছে, সীমানা নির্ধারণে ৬৫৬, ৬৬৩ এবং ৬৬৪ নম্বর খুঁটি যেখানে বসানো হয়েছে, সেখানে বর্তমানে বাংলাদেশ-কোরিয়া কারিগরী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (বিকেটিটিসি)।
গত শনিবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, খালের কোনো অস্তিত্বই নেই। এর মধ্যে ৬৫৬ নম্বর খুঁটি যেখানে বসানো হয়েছে, সেখানে বিকেটিটিসির ছাত্রদের আবাসিক হোস্টেল। ৬৫৬, ৬৬৩ নম্বর খুঁটি যেখানে, সেখানে বিকেটিটিসির কর্মকর্তাদের আবাসিক ভবন।
সিএস এবং আরএস নকশায় থাকা কল্যানপুর খ খালের আরেকটি অংশে বর্তমানে মেট্রো রেল প্রকল্পের গাবতলী কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড।
খালের জায়গায় এমন আরও স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। সিএস নকশা অনুযায়ী সীমানা খুঁটি বসাতে হয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, বাড়ির ভেতরে। যাদের স্থাপনার ভেতরে সীমানা পিলার পড়ছে তারা খুঁটি সরানোর জন্য ডিএনসিসির মেয়র, প্রকৌশল শাখা এবং সম্পত্তি বিভাগে আবেদন করেছেন।
মোহাম্মদপুরের কাটাসুর এলাকায় ফিউচার হাউজিংয়ের ৪ নম্বর সড়কের ১৩ নম্বর প্লটে গড়ে উঠেছে ইনস্টিটিউট ফর লাইব্রেরি অ্যান্ড ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট– ইলিম।
২০২২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর মেয়রের কাছে পাঠানো চিঠিতে ইলিমের অধ্যক্ষ বলেছেন, ইলিম ভবনের একটি অংশে খুঁটি বসানো হয়েছে। এ অবস্থায় সিএস, আরএস নকশা অনুযায়ী সঠিকভাবে সীমানা চিহ্নিত করার আবেদন জানিয়েছেন তিনি।
দারুস সালাম এলাকায় কল্যাণপুর প্রধান খালের ৩৩ নম্বর খুঁটির বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে গত বছরের ২৫ অগাস্ট মেয়রের কাছে চিঠি দিয়েছেন আবদুস সাত্তার নামে একজন।
লতিফ রিয়েল এস্টেটের পক্ষে মো. আক্তার বিশ্বাস গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর মেয়রের কাছে পাঠানো চিঠিতে দাবি করেছেন, মনসুরাবাদ আবাসিক এলাকার বি ব্লকের ১৩ নম্বর প্লটে একটি সীমানা খুঁটি বসানো হয়েছে। ওই পিলার অপসারণের দাবি করেছেন মো. আক্তার বিশ্বাস।
মোহাম্মদপুরের রামচন্দ্রপুর খালের পাশে ৩০৪ নম্বর পিলারের বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে গত বছরের ১৬ অগাস্ট মেয়রের কাছে চিঠি দেন এস এম মালেকুজ্জামানসহ চারজন।
ওই চিঠিতে দাবি করা হয়েছে, খালের সীমানা থেকে ৩০ ফুট ভেতরে ওই সীমানা পিলার স্থাপন করা হয়েছে। তাদের জমির পরিবর্তে সঠিক জায়গায় সীমানা খুঁটি বসানোর অনুরোধ করা হয়েছে।
এই বাস্তবতায় প্রকল্পের ভবিষ্যত অনিশ্চয়তা থাকলেও কাজটি এগিয়ে নিতে চান মেয়র আতিকুল ইসলাম।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এরই মধ্যে ৫৬৫টি পিলার বসানো হয়েছে। পিলারগুলো না বসাতে পারলে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কিছু রেখে যাওয়া যাবে না।”