Published : 13 Sep 2022, 01:37 AM
চট্টগ্রাম নগরীতে যানজট কমাতে এবং বিমানবন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ দ্রুত করতে নির্মাণাধীন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজ পাঁচ বছর এগোনোর পর বদলাচ্ছে নকশা; যা বাস্তবায়নকারী সংস্থাকে প্রকল্পের বড় অঙ্কের ব্যয় ও মেয়াদ বাড়ানোর দিকে ঠেলে দিয়েছে।
নগরীর লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত প্রায় ১৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ উড়াল সড়ক নির্মাণ কাজের কারণে এমনিতেই কয়েক বছর ধরে চরম ভোগান্তিতে রয়েছে নগরবাসী; এ নিয়ে বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) বিরুদ্ধে ক্ষোভও রয়েছে তাদের।
এখন নতুন করে এক্সপ্রেসওয়েটির অ্যালাইনমেন্ট, র্যাম্প ও স্প্যানের দৈর্ঘ্যে পরিবর্তন আনার প্রস্তাবে কাজ শেষের সময় বাড়লে সড়কের বিদ্যমান দুর্ভোগও দীর্ঘায়িত হবে।
সিডিএ প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস নকশায় ‘সংশোধন’ আনার কথা বললেও আগের নকশায় কোনো ত্রুটি ছিল না বলে দাবি করছেন।
প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. মাহফুজুর রহমান বলছেন, আগে একটি ‘খসড়া’ নকশা ছিল, এখন ‘চূড়ান্ত’ হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের এই প্রকল্প মূল্যায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, পুরনো নকশায় কাজ করা হলে র্যাম্প, অ্যালাইনমেন্টসহ বেশ কিছু সমস্যা থেকে যাবে, যা প্রকল্পের সুফলের বদলে যানবাহন চলাচল উল্টো জটিলতা তৈরি করবে। যে কারণে প্রকল্পটি নতুন নকশায় বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
এই প্রেক্ষাপটে নকশা ‘সংশোধন’ করে এবং আরও এক হাজার ৪৮ কোটি টাকা (আগের ব্যয়ের চেয়ে ৩২ শতাংশ) ব্যয় বাড়িয়ে প্রকল্পটি সংশোধন করতে পরিকল্পনা কমিশনের প্রস্তাব পাঠিয়েছে সিডিএ।
একই সঙ্গে ২০১৭ সালে একনেকে অনুমোদন হওয়া ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ের তিন বছরের প্রকল্পটি মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুনে শেষ করার প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছে সংস্থাটি।
এর আগে ব্যয় না বাড়িয়ে প্রকল্পটির মেয়াদ দুই বছর বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছিল। এ দফায় অনুমোদন পেলে প্রকল্পটির মেয়াদ বেড়ে হবে সাত বছর, আর ব্যয় বেড়ে হবে ৪ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা।
‘চট্টগ্রাম শহরের লালখান বাজার হতে শাহ আমানত বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পটির এমন সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য চলতি সপ্তাহে একনেক সভায় উপস্থাপন করা হতে পারে বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনা বিভাগের সচিব মো. মামুন-আল-রশীদ।
চট্টগ্রামের আলোচিত এ উড়াল সড়কের কাজ ২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে শুরু হয়। এরপর চট্টগ্রাম বন্দরের আপত্তি, জমি অধিগ্রহণের জন্য অপেক্ষা, ট্রাফিক বিভাগের অনুমতি না পাওয়া, লালখান বাজার অংশের নকশা নিয়ে আপত্তি ও বিকল্প সড়ক চালু করতে দেরিসহ নানা কারণে দেরি হয়।
এখন কমিশনে পাঠানো প্রকল্পের সংশোধন প্রস্তাবে সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষার ত্রুটির কারণ দেখিয়ে আরও দুই বছর মেয়াদ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। এক্সপ্রেসওয়েটির বর্তমান নকশার ‘অ্যালাইনমেন্ট ঠিক নেই’ বলেও এতে উল্লেখ করা হয়।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, মূল নকশাটি চট্টগ্রাম বন্দরের আমদানি-রপ্তানির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে করা হয়নি। বিশেষ করে সল্টগোলা থেকে বারিক বিল্ডিং পর্যন্ত বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে যে ধরনের নকশা করা দরকার ছিল, সেভাবে করা হয়নি।
যে কারণে ওইসব এলাকা দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে চলাচলকারী যানবাহনের জন্য রাস্তা উন্মুক্ত রাখতে প্রকল্পের অ্যালাইনমেন্টে পরিবর্তন আনতে হচ্ছে। এছাড়া বন্দরের গাড়ি সহজে চলাচলের জন্য যথাযথ ‘ফাউন্ডেশন, সাব স্ট্র্যাকচার ও সুপার স্ট্র্যাকচার’ তৈরি করে নতুন নকশায় অ্যালাইনমেন্ট করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
কর্মকর্তারা জানান, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে যেপথে নির্মাণ হচ্ছে সেখানে রপ্তানি প্রক্রিয়াজাত এলাকা (কেইপিজেড), সিমেন্ট ক্রসিং, নৌবাহিনী, সিইপিজেড, বন্দর এলাকা, কাস্টমস সার্কেল এবং আগ্রাবাদ এলাকার ২০টি জংশন রয়েছে। মূল নকশায় স্প্যানের দৈর্ঘ্য রাখা হয় ৩০ থেকে ৩৫ মিটার। এখন নতুন নকশায় তা বাড়িয়ে ৪৫ থেকে ৫০ মিটার করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া ভূমিতে রাস্তার প্রশস্ততা ঠিক রাখতে পিয়ারের পরিসর কমিয়ে নকশায় সংশোধন আনার কথা প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছে। পাশাপাশি কংক্রিটের গ্রেডের পরিবর্তনসহ অতিরিক্ত নির্মাণ ব্যয় এবং কিছু অংশের পরিমাণ বাড়া ও কমার কারণে ব্যয় ও মেয়াদ বাড়ানোর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রস্তাবে বলা হয়, আগের নকশায় র্যাম্পগুলো পিসি গার্ডার দিয়ে তৈরি করার কথা ছিল। নতুন নকশায় তা আরসিসি বক্স গার্ডার দিয়ে তৈরি করা হবে, যাতে চট্টগ্রাম ইপিজেড ও কর্ণফুলী ইপিজেড থেকে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্পের মাধ্যমে বড় আকারের (লং ভেহিক্যাল) নির্বিঘ্নে যাতায়াত করতে পারে।
এসব বিষয়ে সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রকল্পটি গ্রহণের আগে নকশা করার সময় বন্দর, গ্যাস ও বিদ্যুৎসহ সকল প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বসি। তাদের সম্মতি নিয়েই নকশা প্রণয়ন করা হয়।
“কিন্তু পরে প্রকল্পের অনুমোদন নিয়ে কাজ করতে গেছি তখন পোর্ট বাধা দেয়। বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, বন্দরের সড়কে কাজ করলে তাদের যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে। পরে তাদের সঙ্গে সিরিজ মিটিং করার পর বন্দরের আওতাধীন ৩০ ফুট জমি আমাদের দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এখন অ্যালাইনমেন্ট পরিবর্তন করে সেই জায়গা দিয়েই ফ্লাইওভার যাচ্ছে।”
আগের নকশার ত্রুটি ছিল কি- তার সরাসরি উত্তর না দিয়ে তিনি বলেন, “আগের নকশায় ওই এলাকায় সাতটি র্যাম্প করা হয়েছিল। এখন সবার দাবি অনুযায়ী ১৪টা র্যাম্প করা হচ্ছে।“
এর আগে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশের (আইইবি) চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার এ প্রকল্প নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “তড়িঘড়ি সংশ্লিষ্টদের সাথে সমস্যা সমাধান না করেই কাজ শুরু করায় নানা সমস্যার উদ্রেক হয়। কাজ চলমান অবস্থায় বিরোধ মেটানো ও অ্যালাইনমেন্ট সংশোধন করতে হয়েছে।”
এতে দ্বিমুখী ক্ষতি হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেছিলেন, “সঠিক অ্যাসেসমেন্ট করে কাজ শুরু না করায় এবং নির্মাণ সামগ্রীর দাম বাড়ায় খরচ বাড়ছে। সময়ও বেশি লাগছে। এতে জনগণের সুফল পেতে যেমন দেরি হচ্ছে, পাশাপাশি ভোগান্তিও দীর্ঘায়িত হচ্ছে।”
প্রকল্প সংশোধনের কারণ ব্যাখ্যা করে প্রকল্প পরিচালক মো. মাহফুজুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আসলে এই প্রকল্পের জন্য সলিড কোনো সমীক্ষাই করা হয়নি। একটি ট্রাফিক সমীক্ষা হয়েছিল। এই ফ্লাইওভার করা হলে চট্টগ্রামের যানজট সমস্যার সমাধান হবে কি না, এমন একটি সমীক্ষা করা হয়েছিল।
“এই প্রকল্পের জন্য ডিটেইলড ডিজাইন করা হয়নি। যে নকশার মাধ্যমে সয়েল টেস্ট, পাইলিং, পিলারের আকার বা দুই পিলারের মধ্যে কত দুরত্ব এই রকম ডিজাইন করা হয়নি। একটা রাফ নকশা ছিল, চূড়ান্ত কোনো নকশা ছিল না।”
এছাড়া প্রকল্পটি অনুমোদনের আগে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করা না হওয়ায় কাজ শুরুর পর সমস্যায় পড়ার কথা জানান তিনি।
ব্যয় বাড়ার কারণ তুলে ধরে তিনি বলেন, “এখন নকশা চূড়ান্ত করে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নতুন নকশায় এখন ভূমি অধিগ্রহণ করতে ৬০০ কাঠা। অথচ আগের নকশায় এটা ধরা হয়েছিল ১৩০ কাঠা। ফলে ৫৭ কোটি টাকা ব্যয় বেড়ে হয়েছে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা।
“এছাড়া পিডিবি ও ইউটিলিটি লাইন সরানোর জন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল মাত্র ১৮ কোটি টাকা। এখন ধরা হয়েছে ২২০ কোটি টাকা। এসব কারণে প্রকল্পটি সংশোধন করতে হচ্ছে।”
৭০% বাস্তবায়ন, প্রথমে খুলবে ৮ কিমি
প্রকল্পটির প্রায় ৭০ শতাংশ কাজ হয়েছে জানিয়ে সিডিএ এর প্রধান প্রকৌশলী জানান, আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে পতেঙ্গা থেকে নিমতলা পর্যন্ত আট কিলোমিটার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে যানবাহন ওঠানামার জন্য খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা চলছে।
এতে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল দিয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রামের সঙ্গে যেসব গাড়ি চলাচল করবে, সেগুলো এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করে বিকল্প সড়ক দিয়ে চলাচল করতে পারবে।
১৬ কিলোমিটার উড়াল সড়কটি দেওয়ানহাট রেলসেতুর পশ্চিম পাশ দিয়ে পাহাড় ঘেষে টাইগার পাস মোড়ের পর মূল সড়কের ওপর দিয়ে লালখান বাজার মোড় পেরিয়ে ওয়াসার মোড়ে আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারে গিয়ে মিলবে।