চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে: প্রকল্প বিলম্বিত, দুর্ভোগও দীর্ঘায়িত

চট্টগ্রামে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজ যত বিলম্বিত হচ্ছে, ততই দীর্ঘায়িত হচ্ছে এলাকাবাসীর ভোগান্তি।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Oct 2020, 03:36 PM
Updated : 6 Oct 2020, 03:36 PM

জমি অধিগ্রহণের জন্য অপেক্ষা, ট্রাফিক বিভাগের অনুমতি না পাওয়া, বিকল্প সড়ক চালু হতে বিলম্ব, চট্টগ্রাম বন্দরের আপত্তিতে নকশা পরিবর্তন, বৃষ্টিসহ নানা কারণে বিলম্বিত হচ্ছে এ প্রকল্পের কাজ।

প্রকল্প পরিচালক মাহফুজুর রহমান বলছেন, প্রকল্পের মেয়াদ ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হলেও কাজ শেষ হতে ২০২৩ সাল পর্যন্ত লেগে যাবে বলে তার ধারণা।

এদিকে বিমানবন্দর সড়কের সল্টগোলা ক্রসিং থেকে পতেঙ্গা সৈকত পর্যন্ত অংশে রাস্তার এক তৃতীয়াংশ নির্মাণ কাজের জন্য আটকে যাওয়ায় নগরীর অন্যতম ব্যস্ত এই সড়কে যানজট এখন প্রতিদিনের ঘটনা।

সেইসঙ্গে যোগ হয়েছে ভাঙা রাস্তা, কাদা আর ধুলোবালির ভোগান্তি, যা থেকে সহসাই মুক্তি মিলছে না নগরবাসীর।

প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) নভেম্বরে বারিক বিল্ডিং-দেওয়ানহাট অংশের কাজ শুরু করতে চাইলেও ট্রাফিক বিভাগ অনুমতি দিতে ‘অনিচ্ছুক’।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালের ১২ অক্টোবর চট্টগ্রাম সফরকালে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের ঘোষণা দেন। এরপর ২০১৭ সালের ১১ জুলাই একনেক সভায় ৩ হাজার ২৫০ কোটি ৮৩ লাখ টাকার এ প্রকল্প যখন অনুমোদন পায়, তখন তিন বছরের মধ্যে কাজ শেষ করার লক্ষ্য ধরা হয়।

নগরীর লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত চারলেইনের এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের দৈর্ঘ্য হবে সাড়ে ১৬ কিলোমিটার। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী এর নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন।

শুরুতে বন্দর লাগোয়া সড়কের উপর দিয়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু বারিক বিল্ডিং থেকে সল্টগোলা অংশে মূল সড়কের পাশেই বন্দরের প্রধান জেটিগুলো থাকায় নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে আপত্তি তোলে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

এরপর নকশা সংশোধন করে সড়কের একপাশ দিয়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। সেজন্য জমি অধিগ্রহণের কাজটি এখনও ঝুলে আছে।

প্রায় তিন কিলোমিটার দীর্ঘ ওই অংশে জমি অধিগ্রহণের জন্য গত মাসে বন্দর কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন সিডিএ’র ঊর্ধ্বতনরা।

প্রকল্প পরিচালক মাহফুজুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জমি অধিগ্রহণ এবং ডিজাইন নিয়ে বন্দরের সাথে আলোচনা চলছে। এখনো চূড়ান্ত হয়নি। অধিগ্রহণে কত সময় লাগবে এখনই বলা সম্ভব নয়। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২১ এর জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। এটা আরও বাড়বে। ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময় লাগবে।”

তাতে ব্যয় বাড়বে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “অধিগ্রহণে ব্যয় বাড়তে পারে, আবার অন্য কোনো অংশে ব্যয় কমতেও পারে। এখনই বলা যাচ্ছে না।”

বন্দরের উপ-ব্যবস্থাপক (ভূমি) জিল্লুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বন্দরের সাড়ে ছয় একর জমিসহ প্রচুর বেসরকারি জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। ওইসব জমিতে সাত থেকে ১১ তলার বহুতল ভবনও আছে।

“সিডিএকে বলেছি আগে তাদের সম্মতি নিতে। নতুন নকশায় বন্দর ভবন প্রাঙ্গণের সীমানা দেয়ালের ভিতর দিয়ে যাবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। তাতেও আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু বেসরকারি মালিকরা জমি না ছাড়লে আমরা ছেড়ে কি হবে।”

জমি অধিগ্রহণের জটিলতা থাকায় সল্টগোলা-বারিক বিল্ডিং অংশের আগে বারিক বিল্ডিং-দেওয়ানহাট অংশের কাজ শুরু করতে চায় সিডিএ। 

মাহফুজুর রহমান বলেন, “এ অংশের কাজ নভেম্বরে শুরু করে শুকনো মৌসুমের মধ্যেই শেষ করতে চাই। এজন্য ট্রাফিক বিভাগকে বলেছি।”

কিন্তু তাতে আপত্তি জানিয়ে নগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের উপ-কমিশনার (বন্দর) তারেক আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখনই অনুমতি দিতে আমরা অনিচ্ছুক। সল্টগোলা থেকে সিমেন্ট ক্রসিং অংশে কাজ চলছে। দুই অংশে একসাথে কাজ শুরু হলে যানজট বাড়বে।

“এমনিতেই বন্দরে গাড়ির চাপ থাকে। বারিক বিল্ডিং থেকে মাঝিরঘাট সড়কে সিটি করপোরেশন ধীর গতিতে সংস্কার কাজ করছে। তাই চাপ আরও বেড়েছে।”

এর আগে সল্টগোলা-সিমেন্ট ক্রসিং অংশের কাজ শুরু করতেও ট্রাফিক বিভাগের অনুমতি চেয়ে কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হয়েছে সিডিএকে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নগরীর লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর বা পতেঙ্গা সৈকতে যেতে এমনিতে সময় লাগে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হলে সময় লাগবে ২০ থেকে ২৫ মিনিট।

কর্ণফুলী টানেলের সাথে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সংযোগ স্থাপন হলে দক্ষিণ চট্টগ্রামের সঙ্গে নগরীর সরাসরি সংযোগ স্থাপিত হবে।

নগরীর ব্যস্ত সড়ক সিডিএ এভিনিউ, শেখ মুজিব রোড এবং বিমানবন্দর সড়কের উপর এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মিত হচ্ছে। তাই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে যানজট নিরসন হবে বলে সিডিএ আশা করছে।

কিন্তু নির্মাণ কাজ চলাকালে গত দেড় বছর ধরেই যানজট হয়ে উঠেছে নগরবাসীর নিত্যসঙ্গী।

বিমানবন্দর সড়কে চট্টগ্রাম বন্দর, সিইপিজেড, কর্ণফুলী ইপিজেড, ছয়টি বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এই সড়কে দিনে ছোট-বড় মিলিয়ে ৫০ হাজার যানবাহান আর কয়েক লাখ মানুষের চলাচল।

ইপিজেডের একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মী সৌভিক দত্ত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাস্তার তিনভাগের একভাগ ঘেরা দিয়ে রেখে কাজ করতেছে। গাড়ি চলে ধীরে ধীরে। সবসময় জ্যাম থাকে।”

এদিকে পানি চলাচলে পর্যাপ্ত নালা না থাকায় বৃষ্টির সময় বিভিন্ন অংশে সড়কের উপর দিয়ে রীতিমত ঢেউ বইতে শুরু করে। ফলে সড়কের নেভি হাসপাতাল গেইট, বন্দর টিলা, নেভি কলেজ, ইপিজেড, সল্টগোলা ক্রসিংসহ বিভিন্ন অংশে ইতোমধ্যে বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হয়েছে।

পতেঙ্গা এলাকার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, “ইপিজেড থেকে বন্দর টিলা অংশে পিলারের জন্য বোরিংসহ অন্যান্য কাজ চলছে। রাস্তা ভাঙা, বৃষ্টি হলে কাদাপানি আর রোদ উঠলে ধুলা উড়ে সারাদিন। আবার অফিস টাইমে গাড়ির ভাড়াও বেশি নেয় বাস-হিউম্যান হলারগুলো।”

স্থানীয়রা জানান, সকাল ৬টা থেকে ৮টা ইপিজেড কেন্দ্রিক যানবাহানের চাপ থাকে সর্বোচ্চ। বেলা বাড়ার সাথে বন্দরগামী পণ্যবাহী ভারী যানবাহনের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এ কারণে বেলা ১১টা থেকে শুরু হয় আবার যানজট।

বিকেলে অফিস ছুটির পর থেকে রাত ৮টা-৯টা পর্যন্ত পুরো এলাকাজুড়ে যানজট লেগেই থাকে।

ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তা তারেক আহমেদ বলেন, “বিকল্প হিসেবে আউটার রিং রোড সীমিত পরিসরে চালু হওয়ায় (অগাস্টে) কিছুটা সুফল মিলছে। কিন্তু পোর্ট কানেক্টিং রোডের খারাপ দশার কারণে গাড়ির চাপ খুব একটা কমছে না। প্রকল্প এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে মেরামত করানো হচ্ছে।”

ভারী যানবাহন চলাচল এবং পর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানান প্রকল্প পরিচালক মাহফুজুর রহমান।

তিনি বলেন, চার অংশে ভাগ করে প্রকল্পের কাজ চলছে। এরমধ্যে লালখান বাজার থেকে বারিক বিল্ডিং ও বারিক বিল্ডিং থেকে সল্টগোলা অংশের কাজ এখনো শুরুই হয়নি।

সল্টগোলা থেকে সিমেন্ট ক্রসিং অংশের কাজ চলছে। সিমেন্ট ক্রসিং থেকে পতেঙ্গা অংশে গার্ডার বসানো শুরু হয়েছে গত সপ্তাহে।

সিমেন্ট ক্রসিং থেকে পতেঙ্গা অংশের পিলারের কাজ শেষ। গার্ডার বসানো হয়েছে ২৪টি। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মোট ৩৭৮টি পিলারের মধ্যে ১৩০টি নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে।

“৩৭ শতাংশ কাজ শেষ। বর্ষা ছাড়া যে সময় পেয়েছি তাতে কাজ দ্রুত গতিতে কাজ এগিয়ে নিয়েছি। ট্রাফিকের অনুমতি পেলে দ্রুত কাজ এগিয়ে নিতে পারব।”