২০১৮ সাল থেকে গতবছর পর্যন্ত শাহজালাল ও জীবন চ্যাম্পিয়ন ও রানার্স আপ হলেও এবারের আসরে তাদের কেউই খেলায় অংশ নেননি।
Published : 25 Apr 2024, 09:02 PM
চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী আব্দুল জব্বারের বলী খেলায় শাহজালাল-জীবনের চার বছরের দ্বৈরথ পেরিয়ে ‘বাঘা শরীফের’ হাতে শুরু হলো নতুন অধ্যায়।
নগরীর লালদীঘি মাঠে ঐতিহাসিক এ কুস্তি প্রতিযোগিতায় প্রথমবার অংশ নিয়েই বাজিমাত করেছেন কুমিল্লার হোমনা উপজেলার বাসিন্দা শরীফ। তিনি স্থানীয়ভাবে ‘বাঘা শরীফ’ নামে পরিচিত।
বৃহস্পতিবার লালদীঘি মাঠে প্রায় ১১ মিনিট খেলার পর তার প্রতিদ্বন্দ্বী রাশেদ নিজ থেকেই পরাজয় শিকার করে শরীফের হাত তুলে ধরেন; যার কারণে রেফারি শরীফকে বিজয়ী ঘোষণা করেন।
এবছর আগের বারের চ্যাম্পিয়ন শাহজালাল ও রানার্স আপ তারেকুল ইসলাম জীবন কেউ অংশ নেননি।
২০১৭ সালের প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন কক্সবাজারের রামুর দিদার ও রানার্স আপ উখিয়ার শামসু বলি পরের আসরে অংশ নেননি। এ সুযোগে ২০১৮ সালে ফাইনালে খেলেন চকরিয়ার তারেকুল ইসলাম জীবন ও কুমিল্লার হোমনা উপজেলার শাহজালাল। ওই আসরে চ্যাম্পিয়ন হন জীবন।
এরপর থেকে গত আসর পর্যন্ত এ দুই জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল জব্বারের বলী খেলার শিরোপা।
২০১৮ সালে জীবন চ্যাম্পিয়ন হলেও পরের আসরে চ্যাম্পিয়ন হয় শাহজালাল। ২০২০ ও ২০২১ সালে মহামারীর অনুষ্ঠিত হয়নি বলী খেলা।
২০২২ সালে শিরোপা পুনরুদ্ধার করেন জীবন, আর গত বছর তাকে হারিয়ে শিরোপা জিতেন শাহজালাল।
গতবারের চ্যাম্পিয়ন শাহজালাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শরীফ আমার ছোট ভাই। আমার বয়স হয়ে গেছে। তাই তাকে এবার সুযোগ করে দিলাম খেলার জন্য।”
গতবারের রানার্স আপ তারেকুল ইসলাম জীবন জানান, এবছর কোমরের ব্যথার কারণে তিনি অনুশীলন করতে পারেননি। সেই কারণে প্রতিযোগিতায় অংশ নেনি।
বৃহস্পতিবার দুপুরে ঐতিহাসিক আব্দুল জব্বারের বলী খেলা শুরুর আগে থেকেই নগরীর লালদীঘি ময়দানে হাজারো দর্শক জড়ো হন। ঐতিহ্যবাহী এ খেলা দেখতে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় মাঠ। ঢোল-বাজনার তালে তালে আর করতালিতে তারা সমর্থন জোগাতে থাকেন বলীদের।
কিশোর থেকে শুরু করে বৃদ্ধ নানা বয়সী ৮৪ জন বলী এবছরের ১১৫তম আসরে অংশ নেন।
প্রথম রাউন্ড শেষে কমিটি খাগড়াছড়ির বাবু ধন চাকমা, সীতাকুণ্ডের রাসেল, কর্ণফুলী উপজেলার লিংকন দে ও রুবেলকে চ্যালেঞ্জ রাউন্ডে খেলার সুযোগ করে দেন।
এছাড়া গত আসরের চ্যাম্পিয়ন শাহজালাল, রানার্স আপ তারেকুল ইসলাম জীবন, নূর মোহাম্মদ, সৃজন চাকমা সরাসরি চ্যালেঞ্জ রাউন্ডে খেলার সুযোগ পান।
কিন্তু শাহজালাল ও জীবন তাদের নাম প্রত্যাহার করে নিয়ে শরীফ ও রাশেদকে খেলতে দেওয়ার অনুরোধ করেন কমিটির কাছে। কমিটিও সেটি মেনে নিয়ে তাদের খেলার সুযোগ দেন।
চ্যালেঞ্জ রাউন্ডে নূর মোহাম্মদের সাথে শরীফ, রাশেদের সাথে বাবু ধন, রাসেলের সাথে লিংকন দে এবং সৃজন চাকমার সাথে রুবেলকে খেলার সুযোগ দেন। তাদের মধ্যে শরীফ, রাশেদ, রাসেল ও সৃজন চাকমা জয়ী হয়ে সেমিফাইনালে ওঠেন।
এই পর্বে সৃজন চাকমার সাথে লড়াই করেন নবাগত বাঘা শরীফ। তিন মিনিটের মধ্যেই সৃজনকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো খেলতে এসে ফাইনালে ওঠেন শরীফ।
আর এক মিনিটের কম সময়ে রাসেলকে হারিয়ে ফাইনালে উঠেন রাশেদ।
এক মিনিটেই শেষ তৃতীয় স্থান নির্ধারণী খেলা
পরাজিত দুই সেমিফাইনালিস্ট সৃজন ও রাসেল অংশ নিয়েই এক মিনিটেরও কম সময়ে রাসেলকে কুপোকাত করে প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান লাভ করেন খাগড়াছড়ির সৃজন চাকমা।
প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না ফাইনালে
অতীতে বিভিন্ন সময়ে বলী খেলার ফাইনাল রাউন্ড জমজমাট লড়াই হলেও এবারের খেলা ছিল অনেকটা নিস্তেজ। তবে দর্শকরা করতালিতে মুখরিত করেছিল একই জেলার দুই কুস্তিগীরকে।
খেলা শুরুর পর থেকেই দুজনই কৌশল অবলম্বন করে খেলে যাচ্ছিলেন। দুই জনই শক্তি প্রয়োগের পাশাপাশি ছিলেন কৌশলী ভূমিকায়। তবে রাশেদ কৌশলী থাকলেও শক্তিপ্রয়োগ করেন বাঘা শরীফ। তাদের কৌশলী ও শক্তিমত্তার খেলা দেখে মনে হচ্ছিল ‘কেউ কাহারে নাহি ছাড়ে’।
১০ মিনিট ৪২ সেকেন্ড খেলার পর রাশেদ নিজ থেকেই পরাজয় শিকার করে শরীফের হাত তুলে ধরেন; যার কারণে রেফারি শরীফকে বিজয়ী ঘোষণা করেন।
জয়ী হয়েই শরীফ কৃতজ্ঞতা জানান গতবারের চ্যাম্পিয়ন শাহজালালের প্রতি।
এবারও বাছাই নিয়ে ক্ষোভ
প্রতিবারের মত এবারও বাছাই করা পাঁচজনকে দ্বিতীয় রাউন্ডে খেলার অনুমতি দেওয়ায় প্রথম রাউন্ড জয়ী অনেককেই প্রতিবাদ করেন।
রাজু ইসলাম নামে এক যুবক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ঐতিহ্যের কথা শুনে তিনি এবার দিনাজপুর থেকে চট্টগ্রামে এসেছেন খেলায় অংশ নিতে।
দিনাজপুর ও আশেপাশের জেলায় বিভিন্ন সময়ে কুস্তি প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “আমার বন্ধু জাতীয় কুস্তিগীর। সেনাবাহিনীর হয়ে খেলেন। সে চট্টগ্রামে থাকায়, তার সাথে আমি চট্টগ্রামে এসে খেলায় অংশ নিয়েছি।
“প্রথম রাউন্ডের একটি খেলায় জয়ী হয়েছি। কিন্তু পরের রাউন্ডে আর খেলতে দেওয়া হচ্ছে না। কোন নিয়মে কী হিসাব করে চ্যালেঞ্জ রাউন্ডে বাছাই করা হয়েছে, সেটা আমরা বুঝতে পারছি না।”
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে দেশের যুব সমাজকে সংগঠিত করতে ১৯০৯ সালে স্থানীয় আব্দুল জব্বার সওদাগর লালদীঘি মাঠে কুস্তি প্রতিযোগিতা আয়োজন করেন। পরে তা আব্দুল জব্বারের বলীখেলা নামে পরিচিত পায়, যার জনপ্রিয়তা এখনও অক্ষুণ্ন রয়েছে।
বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে ১২ বৈশাখে লালদীঘির ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় এই খেলা, খেলার আগের দিন থেকে শুরু করে পরদিন পর্যন্ত তিন দিন ধরে লালদীঘির মাঠ ও আশেপাশের কয়েক কিলোমিটার জায়গাজুড়ে বসে বৈশাখী মেলা।
এবারও মেলায় বিভিন্ন ধরনের পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা দোকানিরা।
আরও পড়ুন