‘চাপ সামলানোর’ মুদ্রানীতি সাজাতে বসছে বাংলাদেশ ব্যাংক

এবারের মুদ্রানীতির সব সূচক ঘিরেই রয়েছে আইএমএফ এর শর্ত পূরণের প্রসঙ্গ।

শেখ আবু তালেববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 May 2023, 05:14 AM
Updated : 18 May 2023, 05:14 AM

আগামী অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতি প্রণয়নের জন্য প্রথম বৈঠকে বসছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। আইএমএফ এর পরামর্শ বাস্তবায়নকে প্রধান উপজীব্য ধরে অর্থনীতির চাপ কমানো হবে এই মুদ্রানীতির লক্ষ্য।

গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের নেতৃত্বে বৃহস্পতিবার বেলা ১২টায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এ বৈঠক শুরু হবে। নতুন মুদ্রানীতির একটি খসড়া পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন আকারে উপস্থাপন করা হবে বৈঠকে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. হাবিবুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আগামী মুদ্রানীতি পর্যালোচনা করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রাথমিক প্রক্ষেপণ ও কৌশল নির্ধারণের পর অতীতের রেওয়াজ অনুযায়ী অংশীজনদের মতামত নেওয়া হবে।

গত জুলাইয়ে গভর্নরের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর এটি হবে আব্দুর রউফ তালুকদারের দ্বিতীয় মুদ্রানীতি। বাংলাদেশ ব্যাংক এমন সময়ে মুদ্রানীতি প্রণয়নের কাজ শুরু করছে যখন, টাকার মান কমে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতির পারদ প্রায় দুই অংকের কাছাকাছি, ব্যাংকিং খাত রয়েছে তারল্য সংকটের চাপে।

গত এক বছর ধরে বিদেশি মুদ্রার সরবরাহে টান রয়েছে, লেনদেন ভারসাম্য হয়ে আছে মাথাব্যথার কারণ। রাজস্ব আদায় আশানুরুপ না হওয়ায় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে সরকারের।

টাকা মান হারাতে শুরু করায় ডলার সাশ্রয়ে গতবছর জুলাই মাসে আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক, এখনও তা অব্যাহত রাখা হয়েছে। আমদানি কমে গত বছরের তুলনায় অর্ধেকে নেমে এলেও বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হয়নি।

ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতি হারিয়েছে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কমেছে।

অর্থনীতির বিদ্যমান চ্যালেঞ্জের মধ্যেই সুদহার করিডোর, একক বিনিময় হার নির্ধারণ, রিজার্ভ হিসাব পদ্ধতি আইএমএফ নির্দেশিত পন্থায় পরিবর্তনের মত যেসব সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়েছে, তা বাস্তবায়নের রূপরেখা থাকবে নতুন মুদ্রানীতিতে।

অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এসব সূচকে পরিবর্তন এনে নতুন যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে; তার প্রভাব কেমন হবে তা বুঝতে চেষ্টা করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।

অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম মনে করেন, আগামী মুদ্রানীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে বাড়তে থাকা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আইএমএফ এর পরামর্শ বাস্তবায়নে মুদ্রানীতিতে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংককে যৌথভাবে স্বার্থক উদ্যোগ নিতে হবে।”

সুদহার বাজারমুখী করলে ফের কিছু ক্ষেত্রে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যেতে পারে, যা মূল্যস্ফীতিকে আরো বাড়িয়ে দেবে। সেজন্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতা বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছেন মির্জ্জা আজিজ।

তবে বিনিময় হার দ্রুত একক রেটে নিয়ে আসা সময় সাপেক্ষ হবে জানিয়ে তিনি বলেন, রিজার্ভের হিসাব আইএমএফ স্বীকৃত বিপিএম৬ পদ্ধতিতে করা কঠিন হতে পারে এই মুহূর্তে।

সরকারের রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি যে আশাব্যঞ্জক নয়, সে প্রসঙ্গ ধরে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, “দ্রুত সংস্কারের মাধ্যমে হয়রানি ছাড়াই কীভাবে করের আওতা বাড়ানো যায়, সেই পন্থা সরকারকে বের করতে হবে।”

আইএমএফ এর সাবেক কর্মকর্তা, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলছেন, মূল্যস্ফীতি কমাতে শুধু ‘টার্গেট’ দিলেই হবে না, কীভাবে কমানো হবে সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিকল্পনা স্পষ্টভাবে জানাতে হবে।

ব্যাংকে আমানত প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে, কেন কমছে, সেই প্রশ্ন রেখে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন,  আগামী মুদ্রানীতিতে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা থাকতে হবে।

৯ শতাংশে বেঁধে দেওয়া সুদহার তুলে নিয়ে সুদহার করিডোর করার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যার বিস্তারিত মুদ্রানীতে থাকার কথা।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, “সুদহার ১০ শতাংশের মধ্যে বেঁধে না দিয়ে বাজারমুখী করতে হবে। বাজার যে সুদহার তৈরি করে, তা হতে দিতে হবে। এজন্য বাজারকে বিশ্বাস করতে হবে। এখানে ম্যানিপুলেট করলে তা কার্যকর হবে না।”

আর সুদহার যদি বাজারমুখী না হয়, তাহলে চাপে থাকা বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারও সঠিকভাবে কাজ করবে না জানিয়ে তিনি বলেন, “আমার সন্দেহ হয়, যদি একটা জায়গায় সুদহার ও বিনিময় হার বেঁধে দেয়- তাহলে প্রকৃত অর্থে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।”

সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়ানো আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে জানিয়ে আহসান মনসুর বলেন, “সরকারের অর্থায়ন কোন উৎস থেকে হবে তা আগামী মুদ্রানীতিতে স্পষ্ট করতে হবে। ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে যদি হয়, তাহলে কি নতুন টাকা ছাপিয়ে করবে, সে বিষয়ে পরিকল্পনা থাকতে হবে।”

শুধু নীতিমালা প্রকাশ না করে তা কার্যকর করতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংককে আন্তরিক হওয়ার আহ্বান জানান আহসান মনসুর।

সরকারের বাজেট বাস্তবায়নে সহযোগিতা এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বছরের নির্দিষ্ট সময়ে বাজারে কী পরিমাণ মুদ্রা সরবরাহ করা হবে- তার একটি আগাম ধারণা দেওয়া হয় মুদ্রানীতিতে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত জানুয়ারিতে ঘোষিত মুদ্রানীতির ভঙ্গির আদলে খুব একটা নড়চড় আসবে না এবার। মুদ্রানীতির ভঙ্গির চেয়ে এবার বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে অর্থনীতির বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ সামাল দিতে নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্তে পরিবর্তন।

আর এবারের মুদ্রানীতির সব সূচক ঘিরেই রয়েছে আইএমএফ এর শর্ত পূরণের প্রসঙ্গ।

গত মুদ্রানীতির প্রক্ষেপণ ও অর্জন

চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি নীতি সুদহার বাড়িয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) জন্য ‘সতর্ক ও সঙ্কুলানমুখী’ মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।

তখন মুদ্রানীতিতে নেওয়া পরিবর্তনের কারণ ব্যাখ্যায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছিল, চাহিদাজনিত মূল্যস্ফীতির চাপ প্রশমন, বিনিময় হারের চাপ নিয়ন্ত্রণ, সরকারের কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে প্রয়াজনীয় অর্থের সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী খাতে ঋণ সরবরাহ নিশ্চিত করতে মুদ্রানীতিতে এই পরিবর্তন আনা হয়েছে।

জানুয়ারি-জুন ২০২৩ সময়ের জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতির সময় পার হয়েছে সাড়ে চার মাস। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক বিভিন্ন সূচকের তথ্য প্রকাশ করেছে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। হাতে গোনা কয়েকটি সূচকের ক্ষেত্রে মার্চ মাসের তথ্য প্রকাশ করেছে।

চলমান মুদ্রানীতিতে ব্যাপক মুদ্রা (এম২) প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৮ দশমিক ৪ শতাংশ। গত মার্চে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ১৩ শতাংশ। ২০২২ সালের মার্চে যা ছিল ৯ দশমিক ৮৫ শতাংশ।

মুদ্রানীতিতে সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ৩৭.৭ শতাংশ, গত মার্চ পর্যন্ত হয়েছে ৩৭.৮২ শতাংশ।

আর বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৪ দশমিক ১ শতাংশ, সেখানে গত মার্চ শেষে অর্জন হয়েছে ১২ দশমিক ০৩ শতাংশ। ২০২২ সালের মার্চে যা ছিল ১১ দশমিক ২৯ শতাংশ।

সব মিলিয়ে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ, মার্চ পর্যন্ত যা হয়েছে ১৬ দশমিক ২১ শতাংশ।

Also Read: ফের রেপো হার বাড়িয়ে সতর্ক মুদ্রানীতি

মাঝে কিছুদিন বছরে একবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হলেও আইএমএফ এর পরামর্শে এখন আবার ছয় মাস অন্তর মুদ্রানীতি ঘোষণার পথে ফিরেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে সরকার মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশে ধরে রেখে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল।

কিন্তু সর্বশেষ গত ডিসেম্বরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট হিসাবে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ২৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। আর সাময়িক হিসাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে হয়েছে ৬ দশমিক ০৩ শতাংশ।