Published : 20 Sep 2022, 08:27 PM
এ বছর আমন মৌসুমের শুরুতে অনাবৃষ্টি আর লোডশেডিং সারাদেশে কৃষকদের যে শঙ্কায় ফেলে দিয়েছিল, তাতে স্বস্তি এনে দিয়েছে সেপ্টেম্বরে বৃষ্টি।
কদিন আগেও পানির অভাবে ফেটে চৌরির ধান ক্ষেতগুলোতে এখন সবুজের ঢেউ খেলছে; শেষ মুহূর্তে বাড়তি সার আর সেচ দিতে খরচের খাতা লম্বা করার যে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল, তা থেকেও রেহাই মিলেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশে এবার ২৫ লাখ ২৫ হাজার ৮০৮ হেক্টর জমিতে আমন ধানের চাষ হচ্ছে।
আমনের মওসুমে গত জুলাইয়ে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫৭ শতাংশ এবং অগাস্টে ৩৬ দশমিক ৪ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হওয়ায় চিন্তার ভাঁজ পড়েছিল চাষিদের কপালে। কিন্তু গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে তা প্রশমিত হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, মৌসুমী বায়ু সক্রিয় রয়েছে। সাগরে একটি লঘুচাপ বিরাজ করছে, তা কেটে গেলে আরেক দফা বৃষ্টি হতে পারে।
আবহাওয়াবিদ শাহিনুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সেপ্টেম্বরে এ পর্যন্ত বৃষ্টিপাত স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়েছে। চলতি মাসে আরও কয়েকদিন বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।”
নিজের পাঁচ একর জমিতে এবার আমন ধান লাগিয়েছেন নেত্রকোণার কলমাকান্দা উপজেলার কৈলাটি ইউনিয়নের কনুরা গ্রামের কৃষক গোপাল চন্দ্র বিশ্বশর্মা। ওই এলাকার শামসুদ্দিনও সাত একর জমিতে আমন লাগিয়েছেন।
শুরুর দিকে বৃষ্টি না হওয়ায় অর্ধেক জমিতে ধান লাগাতে হয়েছিল জানিয়ে গোপাল বলেন, “পরে বৃষ্টি হলে অন্য জমিতেও আমান ধান লাগিয়েছি। বৃষ্টি না হলে এই জমিটুকু আবাদের কোনো সুযোগ ছিল না।”
নেত্রকোণার কেন্দুয়া উপজেলার চিরান ইউনিয়নের দুল্লি গ্রামের কৃষক তমজিদ উদ্দিন এবার চাষ দুই একর জমিতে আমন চাষ করছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ধান লাগানোর পর বেশিরভাগ জমি শুকিয়ে গিয়েছিল। ধান বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহের পর থেকে বৃষ্টি হওয়ায় কোনো রকমে রক্ষা পেয়েছে।
“বৃষ্টি না হলে সেচের যে ব্যবস্থা রয়েছে সেটা বোরোর সময় কাজে লাগে। তবে এবার আমনের সময়ও সেচ দিতে হয়েছিল। সাধারণত এই অঞ্চলে আমন মওসুমে সেচ দেওয়া হয় না।”
বৃষ্টি না হওয়ায় আমন নিয়ে বিপাকে পড়েছিলেন রংপুরের কৃষকরাও। সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের চিলমন এলাকার লতিফুল ইসলাম বলেন, “কিছুদিন আগে বৃষ্টি ছিল না। খরায় ধান পড়ে যাচ্ছিল এখন বৃষ্টি হওয়ায় ধান খুব সুন্দর মতো হচ্ছে। অতিবৃষ্টি বা পোকামাকড়ের আক্রমণ না হলে খুব সুন্দরভাবে ধান ঘরে তুলতে পারব।
রংপুর সদর উপজেলার চন্দনপট ইউনিয়নের রাধাকৃষ্ণপুর এলাকার কৃষক রফিকুল ইসলাম বলেন, এখন যেহেতু বৃষ্টি হচ্ছে, ধানের কোনো সমস্যা নেই। ধানের আবাদও ভালো হচ্ছে। দোনপ্রতি (২২ শতক) প্রায় ২০ মণ করে ধান হবে।
অনাবৃষ্টির কারণে একটা শঙ্কা তৈরি হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “সেচের মাধ্যমে আবাদ শুরু করি। এই বৃষ্টিটা না হলে ধান ঘরে তোলা কঠিন হয়ে যেত। খরচ পোষানো যেত না। বিদ্যুতে লোডশেডিং ছিল। ডিজেলের দাম বেড়ে গেছে। সেক্ষেত্রে ডিজেল ইঞ্জিন দিয়ে সেচ করে ধানের উৎপাদন খরচ অনেক বেশি পড়ে যেত।”
সেপ্টেম্বর মাসের বৃষ্টিতে আমনের ‘অনেক উপকার’ হয়েছে বলে জানালেন কুষ্টিয়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক হায়াত মাহমুদ।
তিনি বলেন, “মনে হয় যেন এক মাসের পানির চাহিদা পূরণ হয়ে গেছে। আর আগামী এক মাসের মধ্যে কোনো কোনো ক্ষেতে ধান পাক ধরবে।
“গত ১০ দিনে থেমে থেমে যে বৃষ্টিপাত হয়েছে, তাতে কুষ্টিয়া অঞ্চলের ধানক্ষেত ছাড়াও সব উদ্ভিদ, উদ্যান সবুজে ছেয়ে গেছে। মানুষ ইউরিয়া সার প্রয়োগ করেও জমিতে ধান গাছে সবুজ রঙ দেখতে পাচ্ছিলেন না। বৃষ্টি শুরু হওয়ার দুই দিনের মধ্যেই মাঠে সবুজ ফিরে এসেছে।”
তার ভাষ্য, এবার জেলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৪ হেক্টর জমিতে আমন বেশি চাষ হয়েছে। গত বছরের চেয়ে ফলনও বেশি হবে বলে তারা আশা করছেন।
এ মওসুমে কুষ্টিয়ায় ৮৮ হাজার ৮৯৫ হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্র ঠিক করা হয়েছিল। কিন্তু চাষাবাদ হয়েছে ৮৮ হাজার ৯১৯ হেক্টর জমিতে।
হায়াত মাহমুদ বলেন, “এখন থেমে থেমে বৃষ্টি হলেও তাতে কোনো অসুবিধা হবে না। জেলার গড়াই নদীর পানি কমছে। এতে বন্যার শঙ্কাও কমে গেছে। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে এবার বাম্পার ফলন আশা করছি।”
খরার ধাক্কার পর সার নিয়ে ‘বিপাকে’ জয়পুরহাটের কৃষক
বর্ষায় চার দশকের সর্বনিম্ন বৃষ্টিপাত, আমনে প্রভাব
এক সপ্তাহের বৃষ্টিপাত বগুড়ায় আমনসহ সব ধরনের চাষাবাদে স্বস্তি ফিরিয়েছে বলে জানালেন বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক দুলাল হোসেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “অনাবৃষ্টির কারণে সেচ নিয়ে কৃষকের নাভিশ্বাস উঠেছিল। বৃষ্টি হওয়াতে মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। এবার আমনে বাম্পার ফলন হবে। এখন আর সেচ নিয়েও কৃষককে ব্যস্ত থাকতে হবে না। যেই বৃষ্টি হয়েছে তাতে সেচের কাজও হয়ে গেছে। এই পানিতেই আমনে পাক ধরবে।”
গত বছর বগুড়ায় ১ লাখ ৮২ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে আমনের চাষ হলেও এবার ১ লাখ ৮৩ হাজার ৪৭৫ হেক্টর জমিতে ধান লাগানো হয়েছে বলে জানান দুলাল।
“বৃষ্টির কারণে আগাম শীতকালীন শাক সবজির কোনো ক্ষতি হয়নি। সামনের দিনগুলোতে ভারী বৃষ্টি না হলে এবার কৃষির অবস্থা ভালো থাকবে।”
নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবু হোসেন বলেন, “নওগাঁয় আমনের ৯৭ শতাংশ রোপন সম্পন্ন হয়েছে। বাকিটা সুগন্ধি ধানের আবাদ, তাই বিলম্ব হচ্ছে। আশা করছি টার্গেট পূরণ হয়ে কিছুটা বেশি আবাদ হতে পারে।”
জুলাই-অগাস্টে আমনের চারা বপনের সময় বৃষ্টিপাত কিছুটা কম ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “তখন সেচের মাধ্যমে কৃষক আবাদের কাজটি করেছে। কিন্তু এই সময়ে আমরা ভালো বৃষ্টি পাচ্ছি। সেপ্টেম্বর মাসের ১৮ তারিখ পর্যন্ত জেলায় বৃষ্টিপাত হয়েছে ১৭৫ মিলিমিটার। গত বছর একই সময়ে বৃষ্টি হয়েছিল ৬১ মিলিমিটার।
“সাধারণত সেপ্টেম্বরে বৃষ্টি কমই হয়। সব মিলিয়ে শেষ মুহূর্তের বৃষ্টির কারণে আমনের আবাদ পরিস্থিতি বেশ ভালো। প্রতিবছর সেপ্টেম্বরে এসে কৃষক ধানে যে সেচটা দেয়, সেটা এবার দেওয়ার প্রয়োজন হবে না।”
বৃষ্টির কারণে সেচ খরচও কমে আসছে জানিয়ে আবু হোসেন বলেন, “এখনও থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। সেই হিসাবে অনাবৃষ্টির কারণে শুরুর দিকে কৃষকের যে বাড়তি খরচ হয়েছিল, সেটাও পুষিয়ে যাচ্ছে।”
সোমবার ময়মনসিংহ টাউন হলে মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাকও আমন ধান নিয়ে অনিশ্চয়তা কেটে যাওয়ার কথা বলেছেন।
তিনি বলেন, “আর কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে আমনে উৎপাদন গতবছরের তুলনায় বেশিও হতে পারে।”
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন সিরাজগঞ্জ, রংপুর ও নেত্রকোণা প্রতিনিধি।]