বর্ষায় চার দশকের সর্বনিম্ন বৃষ্টিপাত, ‍আমনে প্রভাব

আবহাওয়া অফিস বলছে, টানা এতদিন বৃষ্টিহীন থাকা বাংলাদেশে বিরল। এতে কৃষি, জীববৈচিত্র্যসহ সব খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

মঈনুল হক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Sept 2022, 07:18 PM
Updated : 1 Sept 2022, 07:18 PM

কয়েক দফা তাপপ্রবাহ আর গরমে অস্বস্তিতে কেটেছে এবারের বর্ষা মওসুম; স্বাভাবিকের চেয়ে বৃষ্টিপাত হয়েছে অর্ধেক, যাকে গত চার দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন বলছেন আবহওয়াবিদরা।

এ পরিস্থিতিতে দেশে আমনের চারা রোপণে বিলম্ব হচ্ছে। বৃষ্টি কম হলেও সেচ দিয়ে সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে চারা রোপণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের আশা প্রকাশ করেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।

এরইমধ্যে সেপ্টেম্বর মাসে দেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বন্যার পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অফিস। মে, জুন ও জুলাই মাসে কয়েক দফা বন্যার পর আবারও দুর্যোগ দেখা দিলে তা বড় বিপত্তি তৈরি করতে পারে।

আবহাওয়াবিদ ড. আব্দুল মান্নান বলেন, গত জুলাই মাসে সারা দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫৭ দশমিক ৬ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। ১৯৮১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৪২ বছরের মধ্যে এটি জুলাইয়ের সর্বনিম্ন বৃষ্টিপাত।

অগাস্ট মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে ৩৬ দশমিক ৪ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এটি চল্লিশ বছরের মধ্যে অগাস্টে তৃতীয় সর্বনিম্ন হতে পারে। ১৯৮৯ সালে অগাস্ট মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫৩ শতাংশ বৃষ্টির ঘাটতি ছিল।

“টানা এতদিন বৃষ্টিহীন থাকা খুবই বিরল। এতে কৃষি, জীববৈচিত্র্যসহ সবগুলো খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এমন অস্বাভাবিক আবহাওয়া অব্যাহত থাকলে নেতিবাচক প্রভাব তো থাকবেই।”

গত দুই মাসে বিচ্ছিন্নভাবে কয়েক দফা তাপপ্রবাহ ছিল। আগামী মাসখানেকের মধ্যে আবার বৃষ্টিপাত হলে তাও কতটা স্বাভাবিকভাবে হবে তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।

এবার বর্ষা মওসুমে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে আব্দুল মান্নান বলেন, “প্রধানত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব রয়েছে। আবহাওয়া পরিবর্তনে যেখানে আগে বৃষ্টিহীন ছিল সেখানে বৃষ্টিপাত বেড়েছে, আবার বৃষ্টিবহুল এলাকায় বৃষ্টি কমেছে তুলনামূকভাবে।

“বর্ষায় বৃষ্টি কমার পাশাপাশি তাপপ্রবাহও ছিল। বিশ্বের অন্যান্য জায়গার মতো বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ওয়েদার সেটিংস চেইঞ্জের কারণে এ ধরনের অস্বাভাবিক ঘটনাগুলো হচ্ছে।”

এবার জুলাই-অগাস্ট মাসে গরমের দাপটও তুলনামুলক বেশি ছিল বলে জানান আবহাওয়াবিদ আব্দুল মান্নান।

  • জুলাই মাসে ১৮ দিন (৫, ৭-২১, ২৩ ও ২৯ তারিখ) মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ ছিল রাজশাহী, রংপুর, ঢাকা, সিলেট বিভাগ এবং কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চলে।

  • আর অগাস্টে আট দিন (৫, ৭, ১৭-১৯, ২২ এবং ৩০-৩১ তারিখে) রাজশাহী, রংপুর, খুলনা, ঢাকা ও সিলেট বিভাগে মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে যায়।

  • জুলাই মাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে ২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। আর অগাস্টে ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে ২ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি।

আবহাওয়াবিদ মান্নান বলেন, “সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেশি থাকাটা তেমন বড় প্রভাব না ফেললেও গরমের অনুভূতি বেশ থাকায় সর্বত্র অস্বস্তিকর অবস্থা বিরাজ করেছে।”

তাপপ্রবাহ অব্যাহত, বন্যার পূর্বাভাস

মাঝ ভাদ্রে মঙ্গলবার থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায় বয়ে যাচ্ছে মৃদু তাপপ্রবাহ। বুধবারও রাজশাহী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা, কুমিল্লা ও ভোলা জেলার উপর দিয়ে মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে যায়। অবশ্য কিছু এলাকায় বৃষ্টি হওয়ায় তাপ প্রশমিত হতে শুরু করেছে।

আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ জানান, বৃহস্পতিবার সাতক্ষীরা ও যশোরে দেশের সর্বোচ্চ ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। যশোর ও কুষ্টিয়া জেলার ওপর দিয়ে মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। তবে আগামী ২৪ ঘণ্টায় তা কেটে যেতে পারে।

রংপুরে গত ২৪ ঘণ্টায় ২০১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আগামী পাঁচ দিনে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা বাড়তে থাকবে।

শুক্রবারের আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে- রংপুর বিভাগের অধিকাংশ জায়গায়; রাজশাহী, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় এবং ঢাকা, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের দুয়েক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে।

সেইসাথে দেশের উত্তরাঞ্চলের কোথাও কোথাও ভারি থেকে অতি ভারি বর্ষণ হতে পারে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আজিজুর রহমান জানান, সেপ্টেম্বর মাসে দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে ভারী বর্ষণে কিছু স্থানে স্বল্প থেকে মধ্যমেয়াদী বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টির শঙ্কা রয়েছে।

তবে পুরো দেশের বিবেচনায় এ মাসেও স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা কম বৃষ্টিপাত হতে পারে। এ মাসে দেশে বিচ্ছন্নভাবে মৃদু তাপপ্রবাহ (৩৬-৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস) বয়ে যেতে পারে। দিন ও রাতের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশি থাকতে পারে।

আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, সেপ্টেম্বরে বঙ্গোপসাগরে ১ বা ২টি লঘুচাপ সৃষ্টি হতে পারে; যার মধ্যে একটি নিম্নচাপের রূপ নিতে পারে। সেই সঙ্গে দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে ২-৩ দিন মাঝারি ধরনের বজ্রঝড় এবং সারাদেশে ৩-৪ দিন হালকা বজ্রঝড় হতে পারে।

কম বৃষ্টিপাতের প্রভাব আমনে

আমনের দুটি ধরনের মধ্যে রোপা আমনের বীজ আষাঢ় মাসে বোনা হয়, শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে মূল জমিতে রোপণ করা হয় এবং কার্তিক-অগ্রহায়ণ-পৌষ (এলাকাভেদে) মাসে ধান কাটা হয়।

এবারের মওসুমে দেশের ৫৬ দশমিক ২২ লাখ হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিচালক (সরেজমিন উইং) হাবিবুর রহমান চৌধুরী জানান, এবার লক্ষ্যমাত্রার ৮৪ শতাংশ আমন রোপণ হয়ে গেছে। ১৬ শতাংশ বাকি রয়েছে, আগামী ১২-১৫ দিনের মধ্যে তা পূরণ হয়ে যাবে।

“তুলনামুলক বৃষ্টিপাত কম হলেও সেচ দেওয়া হচ্ছে। যদি একদম পানির অভাব থাকে তাতে সমস্যা হতে পারে। আশা করি সেপ্টেম্বরে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হবে।”

অধিদপ্তরের সরেজমিন উইংয়ের উপপরিচালক (কো-অর্ডিনেশন) ড. মঝহারুল আজিজ বলেন, জুলাই-অগাস্টে স্বাভাবিকের তুলনায় কম বৃষ্টিপাত হয়েছে, আবার গরমও ছিল বেশি। বৃষ্টি না থাকায় আমন আবাদের জন্য জমি চাষে অসুবিধা হয়েছে কিছু এলাকায়।

“কোথাও কোথাও চারা রোপণ কিছুটা বিলম্বিত হয়েছে। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরামর্শে জেলা, উপজেলার সহায়তায় সম্পূরক সেচ দিয়ে রোপণের কাজ প্রায় শেষের দিকে। এবার পাট জাঁক দেওয়ার জন্যও পর্যাপ্ত পানি ছিল না।”

এই সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার আশা প্রকাশ করে আজিজ বলেন, “সেপ্টেম্বর মাসে বৃষ্টির আভাস রয়েছে। একটু দেরি হলেও খুব বেশি ক্ষতি করবে না। যথেষ্ট বৃষ্টি না থাকলে সম্পূরক সেচের ব্যবস্থা রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি রাখা হয়েছে, সব সেচযন্ত্র প্রস্তুত। আমাদের লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ হবে আশা করি।”

এই কর্মকর্তা বলেন, “স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাত খুবই এলার্মিং। আমাদের প্রস্তুতি রাখতে হবে আগামীর জন্যে। এ বছর বড় ক্ষতি যদি নাও হয়, আগামী বছর এমন আবহাওয়া থাকলে শঙ্কা বাড়বে।”

Also Read: বদলাচ্ছে তাপদাহের মানচিত্র

Also Read: তাপদাহ: রেকর্ড ভাঙা গরমে পুড়ছে পশ্চিম ইউরোপ

আমন চাষে পরামর্শ

বিরূপ আবহাওয়া পরিস্থিতিতে আমন ধান চাষে কৃষকদের পরামর্শ দিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।

>> দ্রুত চারা রোপন সম্পন্ন করতে হবে।

>> যে কোনো কারণে চারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকলে সেখানে একই বয়সের সুস্থ চারা রোপণ করতে হবে।

>> হলুদ মাজরা পোকার আক্রমণ দেখা দিলে নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতি হেক্টরে ১০ কেজি হারে কার্বোফুরান স্প্রে করতে হবে।

>> চারা খুব গভীরে রোপণ করা যাবে না। জমি আগাছা মুক্ত রাখতে হবে। চারা রোপণের ১-৩ দিনের মধ্যে অনুমোদিত আগাছানাশক ব্যবহার করতে হবে।

>> চারা রোপণের ১৫-২০ দিন পর নাইট্রোজেন সার দিতে হবে।

>> পামরী পোকা আক্রমণ দেখা দিলে ব্যবস্থা নিতে হবে।

>> সর্বোচ্চ কুশি পর্যায়ে লিফ রোলার, সবুজ পাতা ফড়িং, ব্লাস্ট, ব্যাকটিরিয়া ব্লাইট, উফরা, খোল পোড়া, পাতা পোড়াসহ বিভিন্ন রোগ বালাই দেখা দিতে পারে।

>> নিয়মিত মাঠ পর্যবেক্ষণ করতে হবে।