বাণিজ্যিক ব্যাংকের হাতে থাকা ডলার এক বছরে বেড়েছে প্রায় এক বিলিয়ন। কমছে স্বল্প মেয়াদি বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের দায়, সামনের দিনে আরও কমবে তা।
Published : 23 Nov 2023, 09:47 PM
দেড় বছরের বেশি সময় ধরে অস্থিরতার পর ডলারের বাজারে স্থিতিশীলতার আভাস দেখতে পাওয়ার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আমদানি ও স্বল্প মেয়াদি বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের দায় কমে আসার কারণে সামনের দিনগুলোতে চাপ আরও কমবে বলেও মূল্যায়ন করেছে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।
বৃহস্পতিবার বিকেলে বাংলাদেশ ব্যাংকে সংবাদ সম্মেলন করে এই তথ্য জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক।
গত বুধবার রাতে ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকারস বাংলাদেশ (এবিবি) এবং ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ডলারের দর প্রথমবারের মতো ৫০ পয়সা করে কমায়।
এতে বৃহস্পতিবার থেকে রেমিটেন্স ছাড়া ডলারের ক্রয় দর ১১০টা ও বিক্রয় সর্বোচ্চ ১১১। গত দুই বছর ধরে অব্যাহত বাড়তে থাকা ডলারের বিপরীতে দীর্ঘ সময় পরে টাকা কিছুটা শক্তিশালী হলো।
বাফেদা-এবিবির এই সিদ্ধান্তকে যৌক্তিক মনে করে তার ব্যাখ্যা দিতেই বৈদেশিক মুদ্রা বাজার নিয়ে সংবাদ সম্মেলন ডাকে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ডলার সংকট নিরসনে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপে প্রভাব পাওয়া যাচ্ছে মন্তব্য করে মেজবাউল বলেন, ‘‘‘আমদানি ব্যয় কমে আসায় ডলারের চাহিদা কমে এসেছে, ডলার বাজার স্থিতিশীল হচ্ছে। আগামী আগামী বছরের সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে বিল পরিশোধের চাপও আরো কমে যাবে।”
ব্যাংকের হাতে ডলার বাড়ছে
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ কমে এলেও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর হাতে ডলারের পরিমাণ গত এক বছরে বেড়েছে বলেও জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে এখন ৩ দশমিক ১ বিলিয়নের বেশি ডলার রয়েছে জানিয়ে একে ‘ব্যাংক খাতের জন্য পর্যাপ্ত’ বলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র।
তিনি বলেন, ‘‘গত বছরের নভেম্বরে দেশের ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার ছিল দুই দশমিক ২ বিলিয়ন। গত এক বছরে ডলার হোল্ডিং বেড়েছে ব্যাংকের।
“৩৯টি ব্যাংকের কাছেই পর্যাপ্ত ডলার আছে।…৬১টি ব্যাংকের মধ্যে মাত্র ২১টি ব্যাংক ডলার সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।”
কিছু ব্যাংকে সংকট থাকায় তাদের গ্রাহকরা চাহিদা অনুযায়ী এলসি (ঋণপত্র) খুলতে পারছে না জানিয়ে মেজবাউল বলেন, “তাই বাধ্য হয়ে গ্রাহকরা অন্য ব্যাংকের শরণাপন্ন হচ্ছেন। এ কারণেই কখনো কখনো অস্থিরতা দেখা দিচ্ছে ডলারের বাজারে।’’
ডলার বিক্রি চলবেই
বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল্যায়ন অনুযায়ী ডলারের বাজার ‘স্বাভাবিক হচ্ছে’। এমন প্রেক্ষাপটে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি বন্ধ করার মতো সিদ্ধান্তে যাবে কি না- এই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, “বিভিন্ন প্রকল্প ব্যয় ও জ্বালানিসহ জরুরি পণ্যের জন্য প্রয়োজনে ডলার দেয়। দেশের স্বার্থেই তা করতে হবে।’’
‘‘ডলার বিক্রি বন্ধ করার কোনো সুযোগ নেই। এবিবি-বাফেদার নির্ধারণ করে দেওয়া দর অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করবে।’’
বাফেদা-এবিবির ঠিক করে দেয়া দর অনুযায়ী ব্যবসায়ীরা ডলার পাচ্ছেন না- এমন অভিযোগের বিষয়ে মেজবাউল বলেন, ‘‘বাজার তদারকি বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মিত কাজ, এটা চলতেই থাকবে। ইতিপূর্বে আমরা একাধিক ব্যাংকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রকার ব্যবস্থা নিয়েছি। জরিমানা ও শাস্তির আওতায় এনেছি।
‘‘সব সময় যে শাস্তি দেওয়া হয় তা নয়। কিন্তু নিদের্শনা না মানার পরিণতি ভোগ করতে হয় ব্যাংকগুলোকে।’’
রিজার্ভ কত
আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণে আনায় বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ২৫ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার বলেও জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।
তবে এই অঙ্ক বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব গ্রস হিসাব। আইএমএফ স্বীকৃত বিপিএম সিক্স অনুযায়ী গত বুধবার দিন শেষে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার।
কেভিড-১৯ এর আগে আমদানি দায় ধারাবাহিকভাবে বেড়েছিল বাংলাদেশের। মহামারীর সময়ে তা কমে আসলে রিজার্ভ ২০২১ সালের অগাস্টে ৪৮ বিলিয়নে উঠেছিল।
তবে মহামারী পরবর্তী অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করলে আমদানি দায় বাড়তে থাকে। এরপর ইউক্রেইন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব পড়ে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে, বেড়ে যায় খাদ্যপণ্য ও জ্বালানির দর। সুদের হার বাড়াতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র, ডলার হয়ে উঠতে থাকে শক্তিশালী, দর হারাতে থাকে টাকা। কমতে থাকে রিজার্ভ।
বৈদেশিক মুদ্রা বাজারের অস্থিরতা কমাতে গত ২০২২ সালের জুলাই থেকে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক, কিন্তু কাজে আসছে না সেভাবে, যদিও আমদানি ব্যয় অনেকটাই কমেছে।
২০২২ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে প্রতি মাসে গড়ে আমদানি ব্যয় ছিল ৬৯৬ কোটি ৮৪ লাখ ডলার, ২০২৩ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে তা হয় ৫৩০ কোটি ৩১ লাখ ডলার।
গত বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের স্বল্প মেয়াদি বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল ১৬ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার। চলতি বছরের নভেম্বরে তা কমে হয়েছে ৬ দশমিক ৯ বিলিয়ন। সামনের মাসগুলোতে এই দায় আরও কমবে।
বৈদেশিক পর্যায়ে ডলার খরচের চাহিদা কমাতে সক্ষম হওয়ায় বৈদেশিক দায় পরিশোধের পরিমাণ অর্ধেকে নেমে এসেছে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র।
মেজবাউল হক জানান, বৈদেশিক মুদ্রার খরচ কমে যাওয়ার আরেক কারণ হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি এলসি ও ঋণ নেয়ার প্রবণতা কমে যাওয়া।
তিনি বলেন, “ব্যবসায়ীরা এখন যেসব এলসি খুলছেন তার বেশিরভাগই তাৎক্ষণিক। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রতি মাসে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ চার কোটি ৯০ লাখ ডলারে নেমে আসবে আশা করছি।’’