“ব্যাংক থেকে সরকার অতিরিক্ত ঋণ নিলে ব্যবসায়ীদের ঋণ পেতে কষ্ট হবে ”, বলেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠনটির সভাপতি।
Published : 08 Jun 2024, 09:32 PM
আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে আড়াই লাখ কোটি টাকা ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক খাত থেকে যে পরিমাণ ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে, তাতে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহে বাধা সৃষ্টির আশঙ্কা করছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। তারা বাজেট ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক ঋণে জোর দেওয়ার অনুরোধ করেছে।
বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমলে তার প্রতিক্রিয়ায় বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে বলেও মনে করছে তারা।
এই প্রভাব এড়াতে ভালো ভালো কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে আসার পরামর্শ দিয়েছেন সংগঠনটির সভাপতি মাহবুবুল আলম।
প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে শনিবার ঢাকার মতিঝিলে এফবিসিসিআইয়ে বোর্ডরুমে সংবাদ সম্মেলন করে ব্যবসায়ীদের সংগঠনটি।
প্রস্তাবিত বাজেটে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি মেটাতে সরকারকে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ঋণ নিতে হবে। এর মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা নেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে এই ঋণের ফলে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের সম্ভাব্য ক্ষতি তুলে ধরে এফবিসিসিআই সভাপতি লিখিত বক্তব্যে বলেন, “বাজেট ঘাটতি মেটাতে স্থানীয় ব্যাংক ব্যবস্থার পরিবর্তে যথাসম্ভব সুলভ সুদে ও সতর্কতার সঙ্গে বৈদেশিক উৎস হতে অর্থায়নের জন্য নজর দেয়া যেতে পারে।”
সাংবাদিকদের প্রশ্নে মাহবুবুল আলম বলেন, “ব্যাংকিং চ্যানেল থেকে সব দেশের সরকারই ঋণ নিয়ে থাকে। এ জন্য যে ব্যবসায়ীরা ঋণ পাবে না, বিষয়টি সে রকম নয়। তবে সরকার অতিরিক্ত ঋণ নিলে ব্যবসায়ীদের ঋণ পেতে কষ্ট হবে ।”
ব্যবসায়ীদের দীর্ঘমেয়াদি ঋণের জন্য পুঁজিবাজারে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “ভালো ভালো কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসছে না। তবে আর্থিকভাবে লাভজনক নীতি নেওয়া হলে অনেক প্রতিষ্ঠানই পুঁজিবাজারে আসতে আগ্রহী হবে।
“যারা পুঁজিবাজারে আসবে তাদের জন্য বিশেষ ছাড়ও থাকতে হবে। বিদেশি যেসব প্রতিষ্ঠান এ দেশে ব্যবসা করছে তাদের যদি পুঁজিবাজারে আনা যায়, তাহলে আরো অনেক মানুষ পুঁজিবাজার নিয়ে আগ্রহী হবে। পুঁজিবাজার থেকে ব্যবসায়ে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নও সম্ভব হবে। তাহলে দীর্ঘমেয়াদে ঋণ যেমন মিলবে একইভাবে দেশে শিল্পায়নও বাড়বে।”
‘অসৎ ব্যবসায়ীদের পক্ষে ওকালতি নয়’
খেলাপি ঋণ নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে এফবিসিসিআই প্রধান বলেন, ‘আমরা সৎ ব্যবসায়ীদের পক্ষে, অসৎ ব্যবসায়ীদের পক্ষে এফবিসিসিআই কোনো ওকালতি কোনোদিন করেনি, করবেও না।
“এখন কথা হচ্ছে, কেউ যদি ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হয় সেটা এক জিনিস আর ব্যবসা করতে গিয়ে কেউ যদি ঋণখেলাপি হয়, সেটা আরেক জিনিস।”
একটা ব্যবসা বা গ্রুপ দাঁড় করানো সহজ নয় মন্তব্য করে মাহবুবুল বলেন, “একটি বড় ব্যবসায়িক গ্রুপ হতে কমপক্ষে ৫০-৬০ বছর লাগে। ব্যবসা করতে-করতে এক সময় ব্যবসাতে লস হতে পারে। একটা কোম্পানি বা দুইটা কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়, তখন আমরা দেখি তার আরেকটা কোম্পানিকে (ঋণ দেওয়া) বন্ধ করে দিল। সে জন্য আমরা অনুরোধ করেছি যে আমার ১০টা কোম্পানি আছে, ব্যবসা করতে গিয়ে একটা কোম্পানি খেলাপি হয়ে গেল, ৯টা কোম্পানিকে যেন বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা দিয়ে সাহায্য করে বা ব্যবসাটা করতে দেয়।”
ঋণ দেওয়ার পর সেসব ঋণের দেখভাল অনেক গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “যাকে ঋণ দিচ্ছেন তাকে ফলোআপ করতে হবে, যাতে সে ঋণখেলাপি না হয়। তার অর্থ স্থানান্তর করছে কিনা, সেটাও আপনাকে দেখতে হবে। এগুলো একটি মনিটরিং পলিসিতে আনতে হবে।
এক বছর খারাপ হলে সেই ব্যবসা একেবারেই খারাপ হয়ে যায় না মন্তব্য করে এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, “সে আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু একেবারে মুখ ফিরিয়ে নিলে (ঋণ না দিলে) ওই কোম্পানি একেবারে ধ্বংস হয়ে যায়।”
মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্কের বিরোধিতা
মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে ১ শতাংশ শুল্ক আরোপের প্রস্তাবের যে প্রস্তাব অর্থমন্ত্রী করেছেন, তার বিরোধিতা করছে এফবিসিসিআই। তারা মনে করছে, অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কের প্রতিষ্ঠানের মূলধনি যন্ত্রপাতি ও নির্মাণ সামগ্রী আমদানিতে বিদ্যমান শূন্য শুল্ক আরও ৫ থেকে ১০ বছর বহাল রাখা দরকার।
এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, “বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ করতে আসছে এটা দেখে যে, বাংলাদেশে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে কোনো শুল্ক দিতে হয় না।”
বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে এই বিধান নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলেও মত দেন তিনি।
সুশাসন ও তদারকিতে জোর
তবে গত কয়েক বছর ধরে বাজেটের আকার যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছিল, এ বছর ততটা ব্যয় বাড়ানো হয়নি। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাজেটের এই আকারকে ‘বাস্তবসম্মত ও বাস্তবায়নযোগ্য’ বলে মত দিয়েছে এফবিসিসিআই।
তবে বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে মন্তব্য করে সংগঠনটির সভাপতি বলেন, “যা মোকাবেলার জন্য সুশাসন ও যথাযথ মনিটরিংয়ের দরকার রয়েছে।”
মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ৬.৫ শতাংশ অর্জন করা একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ বলেও মনে করে এফবিসিসিআই। মাহবুবুল বলেন, “মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ধরতেই হবে। তা না হলে সাধারণ মানুষের কষ্ট ও ভোগান্তি বাড়বে।”
ধান, গম, গোল আলু, পেঁয়াজ, রসুন, মটরশুঁটি, ভোজ্য তেল, চিনি, বাদাম প্রভৃতি পণ্যের উপর উৎসে কর ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করায় তা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে বলে মনে করে এফবিসিসিআই।
বৈদেশিক মুদ্রার উচ্চ বিনিময় হার, ঋণের সুদের হার, মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রভৃতি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বাজেট বাস্তবায়নের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণের কথাও বলেন তিনি।
সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতি আরও শক্তিশালী হওয়া প্রয়োজন বলে মন্তব্য করে মাহবুবুল ৫ লক্ষ ৪১ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রাকেও ‘বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ’ বলে উল্লেখ করেন।
২০৪১ সালে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে স্মার্ট গ্রিড ব্যবস্থা প্রচলন, সামগ্রিক বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থাকে আধুনিকায়নের উপর জোর দেওয়াকেও ইতিবাচক বলেন তিনি। এ কার্যক্রম বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ওপরও জোর দেন তিনি।
তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কর অব্যাহতির মেয়াদ বৃদ্ধি বিনিয়োগ বাড়াবে মত দিয়ে মাহবুবুল বলেন, “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ব্লকচেইন, রোবোটিক্স, ডেটা সায়েন্স প্রভৃতিকেও কর অব্যাহতির আওতায় আনা হয়েছে - যা অত্যন্ত ইতিবাচক।”
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানি এবং এক ব্যক্তি কোম্পানির করপোরেট করহার শর্ত সাপেক্ষে আড়াই শতাংশ কমিয়ে যথাক্রমে ২৫ শতাংশ এবং ২০ শতাংশ করায় বিষয়টিও ইতিবাচকভাবে দেখছে এফবিসিসিআই।
কিছু বিষয় পুনর্বিবেচনার অনুরোধ
বর্তমান মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় করমুক্ত সীমা ৪ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা করার বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য সুপারিশও করেছে সংগঠনটি।
এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, “কর ফাঁকি বের করতে কর কর্মকর্তাদের পুরস্কার দেওয়া হয়। এর ফলে আইনের অপপ্রয়োগ হয়। সরকারি কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছা ক্ষমতা কমানোর জন্য পুরস্কার প্রথা বাতিল করে বিকল্প প্রণোদনার ব্যবস্থা করার জন্য আমরা প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিন্তু বাজেটে এর প্রতিফলন দেয়া যায়নি। বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।”
রাজস্ব সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তি ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে এডিআর সিস্টেম কার্যকর করা, কর ন্যায়পাল নিয়োগ, কর আপিলাত ট্রাইব্যুনালে নিরপেক্ষ ও স্বাধীন করা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিচার বিভাগীয় সদস্যকে ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট করার আহ্বান জানিয়েছিল এফবিসিসিআই। কিন্তু জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্যকে প্রেসিডেন্ট করার বিধান করা হয়েছে। এ প্রস্তাবটিও পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করা হয় সংবাদ সম্মেলনে।