এক দরপত্রে একজন ঠিকাদারকে একাধিক কাজ দেওয়া হবে না বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (সিসিসি) সাধারণ সভায়।
মঙ্গলবার সিসিসি’র ২৫তম সাধারণ সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সিসিসি’র সর্ববৃহৎ প্রকল্পের তৃতীয় লটের দরপত্রে ৩৭টি কাজের মধ্যে তিন ঠিকাদার ৩৪টি কাজ পাওয়ার খবরে ক্ষুব্ধ হয়ে প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয়ে ২৯ জানুয়ারি হামলা চালিয়ে তাকে মারধর করে অন্য ঠিকাদাররা।
এমন প্রেক্ষাপটে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো মঙ্গলবারের সাধারণ সভায়।
সভায় সভাপতির বক্তব্যে সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, “প্রকল্পের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার স্বার্থে একজন ঠিকাদারকে এক টেন্ডার নোটিসে একাধিক কাজ দেওয়া হবে না। আর যেসব ঠিকাদার ঠিকমতো কাজ করতে পারবে না তাদের কালো তালিকাভুক্ত করব।
“আমি কঠোর না হলে পোর্ট কানেক্টিং (পিসি) রোড হতো না। ঝুঁকি নিয়ে কঠোর হয়ে পিসি রোডের কাজ শেষ করেছি। অনৈতিক কার্যক্রমে জড়িত ঠিকাদারদের ছাড় দেব না। কর্মকর্তাদেরও সতর্ক করছি, কারও গাফিলতির জন্য জনদুর্ভোগ হলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেব।”
২৯ জানুয়ারি প্রকল্প পরিচালককে মারধরের ঘটনায় সিসিসির মামলায় এ পর্যন্ত ৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে ১২ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। হামলাকারী ১১ ঠিকাদারকে চিহ্নিত করেছে সিটি করপোরেশনের তদন্ত কমিটি।
আড়াই হাজার কোটি টাকার ‘এয়ারপোর্ট রোডসহ বিভিন্ন সড়কসমূহের উন্নয়ন ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো উন্নয়ন’ শীর্ষক এ প্রকল্প সিসিসির সর্ববৃহৎ প্রকল্প। প্রকল্পের প্রথম ধাপে ২৯ কোটি টাকার ১১টি লটের কাজ ই-টেন্ডারের পরও লটারির মাধ্যমে বণ্টন করা হয়েছিল।
পরে দ্বিতীয় ধাপের ২৬টি লটে মোট ১০৫ কোটি টাকার দরপত্র আহ্বান করা হয়, যেগুলোর মূল্যায়ন শেষে কার্যাদেশও দেওয়া হয়েছে।
সবশেষ গত বছরের নভেম্বরে আহ্বান করা হয় ২২০ কোটি টাকার ৩৭টি কাজের দরপত্র। এটি খোলার পর তা মূল্যায়ন হলেও কাউকে এখনও কার্যাদেশ দেওয়া হয়নি। তবে কারা কাজ পেতে যাচ্ছেন তা জেনে গিয়েছিলেন ঠিকাদারদের কেউ কেউ।
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে টেন্ডারের তথ্য আগেই ঠিকাদাররা জেনে যাওয়ায় সিসিসির প্রকৌশল বিভাগকে দায়ী করা হয়।
সিসিসির একাধিক প্রকৌশলী ও ঠিকাদার জানান, ই টেন্ডার প্রক্রিয়াতে দর একই হয়ে গেলে ম্যাটিক্স পদ্ধতিতে পয়েন্টের ভিত্তিতে কাজ দেওয়া হয়। সিসিসির ঠিকাদাররা প্রায় ক্ষেত্রেই কাজের একই রকম দর দেন।
সেক্ষেত্রে ম্যাটিক্স পয়েন্টে গত ৫ বছরে সিসিসির প্রকল্পে শেষ করা কাজের সংখ্যা (১৪০ পয়েন্ট), পাঁচ বছরে সিসিসিতে করা কাজের অর্থ মূল্য (১০০ পয়েন্ট) এবং সব সরকারি সংস্থায় চলমান কাজের মোট মূল্য (৬০ পয়েন্ট) ধরে গণনা করা হয়।
এবারের ৩৭টি কাজের মধ্যে রুকনউদ্দিন নামের এক ঠিকাদারের ইকবাল অ্যান্ড ব্রাদার্স ২২টি, আলাউদ্দিন মোল্লার ডি-কনস্ট্রাকশন ট্রেড ৮টি এবং কাশেম কনস্ট্রাকশন আরেকটি প্রতিষ্ঠানকে চারটি কাজ দেওয়া হচ্ছে বলে তারা জেনেছেন। এ থেকেই কাজ না পাওয়া ঠিকাদারদের একাংশ হামলা চালায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিসিসির এক কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ম্যাটিক্স পদ্ধতিতে পয়েন্টের কারণে যেসব ঠিকাদারের অভিজ্ঞতা বেশি তারাই ঘুরেফিরে কাজ পায়। মূলত এই কারণে সাধারণ সভায় এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।”
মঙ্গলবারের সাধারণ সভায় মেয়র রেজাউল বলেন, “আমি মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রধানমন্ত্রী সিসিসির ইতিহাসের সর্বোচ্চ আড়াই হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বরাদ্দ দিয়েছেন। এই প্রকল্পসহ চলমান প্রকল্পগুলো শেষ হলে চট্টগ্রামের বৈপ্লবিক পরিবর্তন হবে।
“তবে সেবা সংস্থাগুলো সিটি করপোরেশনের সাথে সমন্বয় না করলে চলমান উন্নয়ন কার্যক্রমের সুফল হুমকির মুখে পড়বে। ওয়াসা চলমান স্যুয়ারেজ প্রকল্পের জন্য রাস্তা কাটবে।”
যে কোন সংস্থা রাস্তা কাটার আগে অবশ্যই সিসিসি থেকে লিখিত অনুমতি নিতে হবে এবং যথাযথ প্রাক্কলনের মাধ্যমে সিসিসির পাওনা বুঝিয়ে দিতে হবে জানিয়ে মেয়র বলেন, “সংশ্লিষ্ট কাউন্সিলরদের সঙ্গে সমন্বয় করে রাস্তা কাটতে হবে। আমরা রাস্তা বানাবো আর কোন সংস্থা রাতের আঁধারে নতুন রাস্তা কেটে ফেলবে এমন কোন অভিযোগ পেলে কঠোর পদক্ষেপ নেব।”
সভায় একাধিক ওয়ার্ড কাউন্সিলর চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের জন্য বাঁধ নির্মাণ করায় বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টির বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং এ বিষয়ে সিডিএকে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান।
জবাবে মেয়র রেজাউল বলেন, “সিডিএ জলাবদ্ধতা হ্রাসে যে প্রকল্প পরিচালনা করছে, সেখানে রিটেনিং ওয়ালের কারণে নালা-খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় চট্টগ্রামের অনেকগুলো এলাকার মানুষ খুব কষ্ট পাচ্ছে।
“আমি সিডিএ চেয়ারম্যান মহোদয়সহ সিডিএর উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বারবার বলেছি যাতে এ প্রকল্পের জন্য বর্ষায় মানুষ কষ্ট না পায়। তবে, সিডিএ থেকে এখনো কোন কার্যকর পদক্ষেপ দেখছি না।”
তিনি বলেন, “স্থায়ী কার্যালয় না থাকায় নাগরিক সেবা প্রদানে সমস্যা হচ্ছে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি সিসিসি’র নিজস্ব ফান্ডে স্থায়ী কার্যালয় নির্মাণ করব।”
সভায় সিসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম, সচিব খালেদ মাহমুদ, ও ওয়ার্ড কাউন্সিলররাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় ও শাখা প্রধানগণ এবং নগরীর বিভিন্ন সরকারি সংস্থার প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।