উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক মো. গোলাম ইয়াজদানীর উপর হামলায় জড়িত হিসেবে ১১ ঠিকাদারকে চিহ্নিত করেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (সিসিসি) তদন্ত কমিটি।
তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি তিন সপ্তাহ পর বুধবার সন্ধ্যায় তাদের প্রতিবেদন সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরীর কাছে জমা দেয়।
তিন পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার কথা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে নিশ্চিত করেছেন মেয়র রেজাউল।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঠিকাদারি কাজ না পাওয়ায় ওই ১১ ঠিকাদার গত ২৯ জানুয়ারি প্রকল্প পরিচালকের উপর হামলা চালান।
প্রতিবেদনে চিহ্নিত ১১ ঠিকাদার হলেন- মুহাম্মদ সাহাব উদ্দিন (মেসার্স মাহমুদা বিল্ডার্স ও মেসার্স এস জে ট্রেডার্স), সঞ্জয় ভৌমিক (মেসার্স বাংলাদেশ ট্রেডার্স), মোহাম্মদ ফেরদৌস (মেসার্স মাসুদ এন্টারপ্রাইজ), সুভাষ মজুমদার (মেসার্স জয় ট্রেডার্স), মো. হাবিব উল্লাহ খান (মেসার্স খান কর্পোরেশন), মো. নাজিম উদ্দিন (মেসার্স নাজিম এন্ড ব্রাদার্স), মো. নাজমুল হোসেন ফিরোজ (মেসার্স রাকিব এন্টারপ্রাইজ), মো. ইউসুফ (মেসার্স ইফতেখার অ্যান্ড ব্রাদার্স), আশীষ কুমার দে ও হ্যাপী দে (মেসার্স জ্যোতি এন্টারপ্রাইজ ও মেসার্স দীপা এন্টারপ্রাইজ) এবং মো. আলমগীর (মেসার্স তানজিল এন্টারপ্রাইজ)।
এই ১১ ঠিকাদারের ১২টি প্রতিষ্ঠানকে এরই মধ্যে ‘কালো তালিকা’ভুক্ত করেছে সিটি করপোরেশন। সাহাব উদ্দিনসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। হামলার পর থেকে প্রকল্প পরিচালক ইয়াজদানী আর সিসিসিতে আসেননি।
মেয়র রেজাউল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যেসব ঠিকাদারকে হামলা ও ভাংচুরের জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে, তাদের ইতিমধ্যে আমরা কালো তালিকাভুক্ত করেছি। মামলা করেছি। সেই মামলায় কয়েকজন গ্রেপ্তারও হয়েছে। এ বিষয়ে আমরা কঠোর অবস্থানে আছি।”
দরপত্র মূল্যায়ন শেষ হওয়ার আগেই ঠিকাদাররা এ সংক্রান্ত তথ্য জেনে যাওয়ায় প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের দায়ী করা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে।
পাশাপাশি হামলার সময় প্রকল্প পরিচালকের অফিস সহায়ক তিলক সিংহ ছাড়া নগর ভবনে উপস্থিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কেউই এগিয়ে যায়নি বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। তবে হামলার নেপথ্যে সিসিসি’র কেউ জড়িত কি না, সে বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা হয়নি।
আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আওতায় বিমানবন্দর সড়কসহ বিভিন্ন সড়ক উন্নয়ন ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্প গত বছরের ৪ জানুয়ারি একনেক সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে গত বছরের ১৪ অগাস্ট স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম ইয়াজদানীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
এবার ৩৭টি লটের মাধ্যমে প্রায় ২২০ কোটি টাকার কাজের দরপত্র ডাকা হয়েছিল। দরপত্র মূল্যায়ন শেষে এটির ঠিকাদার নির্বাচনের প্রক্রিয়া চলার মধ্যেই সিটি করপোরেশনের অস্থায়ী ভবনে প্রকল্প পরিচালক গোলাম ইয়াজদানীর কার্যালয়ে ঢুকে তাকে মারধর ও কক্ষ ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।
ঘটনার পরদিনই সিসিসির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা সৈয়দ শামসুল তাবরীজকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়। কমিটির অন্য দুই সদস্য ছিলেন আইন কর্মকর্তা মনীষা মহাজন ও আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা জোনায়েদ কবীর সোহাগ।
তথ্য আগেই জেনে যায় ঠিকাদাররা
তদন্ত কমিটি হামলার শিকার প্রকল্প পরিচালকসহ মোট ২৮ জনের সাক্ষ্য নেয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, “শুনানিতে প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই জানান, মূল্যায়ন কমিটির চূড়ান্ত অনুমোদনের আগেই ঠিকাদারদের গোপনীয় বিষয় জানার কোনো সুযোগই নেই। যদি না প্রকৌশল দপ্তর থেকে কেউ তাদের এই গোপনীয় তথ্য সরবরাহ না করে।
“মূল্যায়ন কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ার আগেই টেন্ডার প্রক্রিয়ার গোপনীয় বিষয় ঠিকাদারদের নিকট প্রকাশ করা বা প্রকাশিত হওয়া প্রক্রিয়ার নিয়মবহির্ভূত। কিন্তু এক্ষেত্রে তা প্রতিপালন করা হয়নি।”
“এক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকল্প পরিচালক, উপ-প্রকল্প পরিচালক, প্রধান প্রকৌশলী, সহকারী প্রকৌশলী, উপ-সহকারী প্রকৌশলী, কম্পিউটার অপারেটর কাম অফিস সহকারী সম্পূর্ণ দায়বদ্ধ,” বলা হয় প্রতিবেদনে।
হামলা ও ভাংচুরের কারণ উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, “নেপথ্যে ছিল তাদের (ঠিকাদারদের) দাবি অনুযায়ী ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানসমূহ প্রকাশিত টেন্ডার বিজ্ঞপ্তির কাজ না পাওয়া।”
তবে সিসিসি’র প্রকৌশল বিভাগ থেকে ভাংচুরে ক্ষতিগ্রস্থ জিনিসপত্রের ক্রয় রশিদ তদন্ত কমিটিকে দাখিল না করায় ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ নির্ধারণ করতে পারেনি কমিটি।
মূল্যায়ন শেষ হওয়ার আগেই দরপত্র বিষয়ক তথ্য প্রকাশিত হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, “তথ্য আগেই যাতে প্রকাশ না হয় সে বিষয়ে আমাদের কঠোর নজরদারি থাকবে।”
ভবিষ্যতে এরূপ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে চারটি সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। সেগুলো হলো- দরপত্রে নিয়মতান্ত্রিকতা ও স্বচ্ছতা আনতে প্রত্যেক ফাইলে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে মেয়রের অনুমোদন গ্রহণ, এ সংক্রান্ত তথ্য গোপন রাখতে আরও যত্নবান হওয়া, এই প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তালিকা করে দায়িত্ব প্রদান এবং প্রক্রিয়া চলাকালে ঠিকাদার ও তাদের লোকজনদের অফিস এলাকায় অপ্রয়োজনীয় অনু্প্রবেশ সংরক্ষিত করা।
পাশাপাশি সিসিসিতে নিরাপত্তা জোরদার করতে কমিটি যে ১০টি সুপারিশ করেছে, তারমধ্যে আছে- প্রত্যেক কর্মকর্তার কক্ষে ইমার্জেন্সি এলার্ম সু্ইচ স্থাপন, প্রবেশপথে এন্ট্রি রেজিস্ট্রার রাখা, প্রত্যেক ফ্লোরে দুজন নিরাপত্তা কর্মী দেওয়া, পর্যাপ্ত সিসি ক্যামরা বসানো, দশনার্থী সময়সীমা নির্ধারণ, দরপত্র সংক্রান্ত তথ্য গোপন রাখতে যত্নবান হওয়া, অফিসের সামনে বহিরাগত চলাচল নিয়ন্ত্রণে চেকপোস্ট করা, নিরাপত্তা কর্মীদের প্রশিক্ষণ, দরপত্র প্রক্রিয়া চলাকালে নিরাপত্তা জোরদার এবং সহকর্মীদের মধ্যে সৌহার্দ্য বাড়ানো।
হামলার পর কমিটি গঠনের তথ্য জানিয়ে সিসিসি’র সচিব খালেদ মাহমুদ বলেছিলেন, হামলার ঘটনায় করপোরেশনের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত কি না সেটিও অনুসন্ধান করবে কমিটি। কিন্তু সে বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে কিছুই নেই।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আওতায় এই উন্নয়ন প্রকল্পটি গত বছরের ৪ জানুয়ারি একনেক সভায় অনুমোদন হয়। হামলার ঘটনায় এখন পর্যন্ত চারজন গ্রেপ্তার হয়েছে।