“আমাদের লোকজন সবাই রেডি যাওয়ার জন্য। কিন্তু সেখানে কোনো কিছুই কমপ্লিট করতে পারে নাই,” বলেন কেমিকেল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নজরুল ইসলাম বাবু।
Published : 20 Apr 2024, 01:30 AM
তিনশ একর প্রকল্প এলাকার বেশির ভাগই বালু ফেলে ভরাট করা হয়েছে। এ কাজেরও রয়েছে কিছু বাকি। এরমধ্যেই বিস্তীর্ণ এ ফাঁকা জায়গার চারপাশে সীমানা প্রাচীর নির্মাণের কাজ করছেন শ্রমিকরা। উত্তর দিকের সীমানা প্রাচীরের ভিত্তি তৈরি শেষে লোহার কলাম করে ঢালাইয়ের কাজ হয়েছে। এর ওপর করা হবে সীমানা দেয়াল। অন্য অংশে লোহার কলাম তৈরি করে বসানো হয়েছে।
কর্মরত শ্রমিকরা বলছেন, গত ডিসেম্বর থেকে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ তৈরি করছেন তারা। পুরো ঘিরে ফেলার এ কাজ শেষ হতে লেগে যাবে বছরখানেক।
পুরান ঢাকায় একের পর এক ভয়াবহ দুর্ঘটনায় প্রাণহানির মধ্যে একটি নিরাপদ রাসায়নিক শিল্পনগরী গড়ে তোলার উদ্যোগের প্রায় দেড় দশক পরও প্রকল্প এলাকার বাহ্যিক বাস্তবায়ন অগ্রগতি বলতে এটুকুই। পুরো প্রকল্পের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া চলছে ঢিমেতালেই। রাসায়নিক দুর্ঘটনার খনি পুরান ঢাকার অলি ঘুপচির কারখানা কবে সরবে সেই হিসাব বহুদূর।
তবে বাস্তবায়নকারী সংস্থা বিসিকের পক্ষ থেকে আগামী বছর শেষ নাগাদ প্লট বরাদ্দের কথা বলা হলেও তা নিয়ে সন্দিহান এ খাতের ব্যবসায়ীরা।
এক দফা জায়গা বদলের পর বর্তমানে ‘বিসিক কেমিকেল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক’ নামের এ প্রকল্প গড়ে তোলা হচ্ছে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে, যেখানে থাকবে ১ হাজার ৮৪৩টি প্লট।
ঢাকা থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে ঢাকা-নবাবগঞ্জ সড়কের তুলসিখালী সেতু পার হলে হাতের বাম পাশে সিরাজদিখানে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার এ শিল্পপার্ক বানানো হচ্ছে।
দেড় দশক আগে প্রথমে কেরানীগঞ্জে হওয়ার কথা থাকলেও সেখানে স্থান সংকুলান না হওয়ায় তা সরিয়ে আনা হয়েছে এখানে। কেরানীগঞ্জেরই ঠিক পাশের তুলসিখালী, সিরাজদিখান উপজেলার গোয়ালখালী ও কামারকান্দা গ্রামের পূর্ব দিকে নতুন প্রকল্প এলাকার অবস্থান। এর পূর্ব পাশ দিয়ে চলে গেছে ইছামতী নদী, কাছেই ধলেশ্বরী।
রোববার সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, বালু দিয়ে ভরাট করা এলাকার একপাশে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণের কাজ চলছে। কিছু অংশে বালুও ফেলা হচ্ছে।
কর্মরত শ্রমিকদের একজন মিজানুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দেড় মাস আগে থেকে বেইস আর কলাম খাড়া করছি। এর মধ্যে একটা অংশের লোহার কলাম দেওয়া হয়েছে, সেখানে ঢালাই করা হবে। এই রকম করে নদীর পাড় পর্যন্ত গেছে। সব মিলিয়ে সাড়ে চার হাজার বেইজ হবে। পুরো বাউন্ডারি ওয়াল হইতে এক বছর তো লাগবেই।”
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুরো প্রকল্প শেষ হতে আরও অনেক কাজ বাকি। যে কারণে পুরান ঢাকায় অগ্নিকাণ্ড আর দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হলেও একটি রাসায়নিক শিল্প পল্লী বা শিল্প পার্কের জন্য অপেক্ষা আরও দীর্ঘ হচ্ছে।
‘শুধু কাজ হচ্ছেই, এখনও শেষ হচ্ছে না’
দুর্ঘটনা ঘটলেই বছরের পর বছর আলোচনায় আসা এ প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) তথ্য বলছে, ২০১০ সালের জুলাইয়ে কেমিকেল শিল্প পার্কের কাজ শুরু হয়। ওই সময় কেরানীগঞ্জে ৫০ একর জমিতে হওয়ার কথা ছিল এ শিল্পনগরী। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে চুড়িহাট্টা ট্রাজেডির পর পরিসর বাড়িয়ে তা সরিয়ে নেওয়া হয় মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে।
প্রকল্প সংশোধন করে প্রথমে ৩০৮ দশমিক ৩৩ একর জমিতে ২ হাজার ১৫৪টি শিল্প প্লট তৈরির পরিকল্পনা করা হয়। পরে তা আবার সংশোধন করে প্লট সংখ্যা কমিয়ে ১ হাজার ৮৪৩টি করা হয়। প্রকল্প এলাকার সড়ক, লেক ও নদীর পাড়ে ১০০ ফুট প্রশস্ত জায়গা ছেড়ে দেওয়ার কারণে কমেছে প্লটের সংখ্যা।
প্রকল্পের অগ্রগতির সবশেষ তথ্যে দেখা যায়, ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত আর্থিক অগ্রগতি ৬২ দশমিক ৭৩ শতাংশ এবং ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৬৮ শতাংশ। ভূমি উন্নয়ন ৮২ দশমিক ২৩ শতাংশ এবং সীমানা প্রাচীর নির্মাণ কাজের ২৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ শেষ হয়েছে।
তবে অগ্রগতির এমন তথ্য আশাবাদী করছে না এ খাতের ব্যবসায়ীদের। বাংলাদেশ কেমিকেল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি নুরুল মোস্তফা হতাশা প্রকাশ করে বলেন, “শুধু কাজ হচ্ছেই, এখনও শেষ হচ্ছে না। বাস্তবতা হল সরকারি কাজ তো, হচ্ছেই।
“প্লট বুঝিয়ে দিতে আরও দেরি আছে। ২০২৫ সাল পার হোক, তারপর বলা যাবে কবে যাচ্ছি আমরা।”
দেরির কারণ হিসেবে বিসিকের চেয়ারম্যান সঞ্জয় কুমার ভৌমিক বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণ ও মাটি ভরাটের কাজ শেষ করতে দেরি হয়েছে। এ বছর এ দুটি কাজ শেষ হবে। আগামী বছর সেখানে বিসিকের কার্যালয়, ফায়ার সার্ভিস স্টেশনসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ হয়ে যাবে।
“আগামী বছরের (২০২৫) ডিসেম্বরের দিকে আমরা প্লট বরাদ্দ দিতে পারব আশা করি। প্লট বরাদ্দ দিতে সময় লাগে না। জেলা প্রশাসক একটা মিটিং করে বরাদ্দ দিয়ে দেবেন।”
দুর্ঘটনা থেমে নেই চকবাজারে
বছরের পর বছর ঢাকা থেকে রাসায়নিকের কারখানা ও গুদাম সরানো নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে প্রায় দেড় দশক আগে শিল্প পার্ক প্রকল্প কাগজে কলমে শুরু করে বিসিক। তবে এতদিনেও তা বাস্তবায়ন না হওয়ায় একের পর এক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির পাশাপাশি সম্পদ ক্ষয় হয়েছে। মাঝেমধ্যেই আগুনের ঘটনা ঘটছে।
চকবাজারের ইসলামবাগে গত ২৩ মার্চ একটি রাসায়নিক গুদামে আগুন লাগে। আড়াই ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। ৫ ফেব্রুয়ারি সকালে মাহুতটুলির আবুল খয়রাত রোডে একটি একতলা ভবনে জুতার কারখানায় আগুন লাগে।
এমন অবস্থায় আগামী ২০২৫ সালের ডিসেম্বর নাগাদ প্লট বুঝিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনার কথা বলছে বিসিক। এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে এ খাতের ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, সেখানে কারখানা সরিয়ে নিতে দীর্ঘ সময় লাগবে। ফলে দ্রুতই যে ঢাকা থেকে কারখানা স্থানান্তর হচ্ছে তা নয়।
থাকবে লেক, কঠিন বর্জ্য পোড়ানোর ব্যবস্থা
প্রকল্প এলাকায় ৬ একর জায়গাজুড়ে একটি লেক করা হবে, যেখানে পানি সংরক্ষণ করা হবে। ভেতরের প্রতিটি সড়কে ১০০ ফুট দূরত্বে একটি করে ‘ফায়ার হাইড্রেন্ট’ রাখা হবে, যাতে আগুন লাগলে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়া যায়।
শিল্পপার্কের ভেতরে ফায়ার সার্ভিসের অফিস থাকবে। তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কেন্দ্রীয় ইটিপির পাশাপাশি কঠিন বর্জ্য পোড়ানোর জন্য ‘ইনসিনারেটর’ রাখা হবে।
তবে মাটি ভরাট ও সীমানা প্রাচীর ছাড়া এগুলোর কাজ শুরু হতে আরও বাকি। পল্ট বরাদ্দের প্রক্রিয়াও এগোয়নি।
সব কাজ ২০২২ সালের জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও আবার সংশোধন করে মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে; ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৪৫৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
প্রকল্প পরিচালক মো. হাফিজুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টফোর ডটকমকে বলেন, এ বছরের জুলাই থেকে তারা প্লট বরাদ্দ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করবেন। পাশাপাশি অন্যান্য উন্নয়ন কাজ চলতে থাকবে।
“মাটি ভরাট শেষ হয়ে গেলে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হবে। প্লট বরাদ্দ দেওয়ার কিছু প্রক্রিয়া আছে, যা শেষ করতে আরও দুই থেকে তিন মাস সময় লাগবে।“
প্লট বরাদ্দ দেওয়ার পর কারখানা মালিকরা কারখানার উন্নয়ন কাজ করবেন, এমন পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “পাশাপাশি আমরা ড্রেনেজ ও রাস্তার কাজ করব। ড্রেনেজের জন্য এরইমধ্যে টেন্ডার হয়ে গেছে। আর রাস্তার টেন্ডার আহ্বান করব ঈদের পর।
“এসব কাজ শেষ করতে এক বছরের বেশি সময় লাগবে না। তারপরও আমরা ফিনিশিং টাচের জন্য ছয় মাস সময় বেশি নিয়েছি। সব প্রক্রিয়া শেষ হবে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর নাগাদ।”
ব্যবসায়ীরা ‘অপেক্ষায়’
বাংলাদেশ কেমিকেল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ব্যবসায়ীরা অপেক্ষায় আছেন কবে প্লট বুঝিয়ে দেবে।
“আমাদের লোকজন সবাই রেডি যাওয়ার জন্য। কিন্তু সেখানে কোনোকিছুই কমপ্লিট করতে পারে নাই। মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন সেখানে এখন পর্যন্ত মাটি ভরাট করেছে। রেডি হবে হবে বলছে। প্লটই এখনও বুঝিয়ে দেয়নি। সেটা দিলে বোঝা যাবে কবে সেখানে রাসায়নিক শিল্প সরিয়ে নেওয়া যাবে।”
তার দাবি, বিপজ্জনক যে ২৫টি রাসায়নিক দাহ্য পদার্থের কথা বলা হয়েছে সেগুলো এখন পুরান ঢাকায় নেই। এগুলো কেরানীগঞ্জে গুদাম নিয়ে সরে গেছে। মিটফোর্ডের ব্যবসায়ীরা কেউ কেমিকেলের ব্যবসা করে না, করে আমদানিকারকরা। তারা আবার কেউ মিটফোর্ডে বসে না। তারপরও কেউ পুরান ঢাকায় এসব ব্যবসা পরিচালনা করলে তার দায় সংগঠন নেবে না।
“আমরা রোজার মধ্যেও একটা মিটিং করেছি। সেই মিটিংয়ে বলে দিয়েছি দাহ্য কোনো পদার্থ নিয়ে আমরা কোনো দায়িত্ব নেব না। কেউ যদি অন্যায় কাজ করে দাহ্য পদার্থের গোডাউন রাখে সে তার নিজ দায়িত্বে রাখবে।”