টাকার অঙ্কে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সর্ববৃহৎ প্রকল্পে কাজ পেতে উঠে পড়ে লেগেছিলেন ঠিকাদাররা; দাবি তুলেছিলেন কাজ ভাগাভাগি করে দেওয়ার। এতে প্রকল্প পরিচালক রাজি না হওয়ার ক্ষোভ থেকেই হামলার এ ঘটনা বলে মনে করছেন ঠিকাদার ও কর্মকর্তাদের অনেকে।
ঠিকাদারদের একাংশের জোট বেঁধে রোববারের হামলার এ ঘটনায় শোরগোলের পর সামনে এসেছে আড়াই হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্পের দরপত্রের বিভিন্ন দিক।
এবার ৩৭টি লটের মাধ্যমে প্রায় ২২০ কোটি টাকার কাজের দরপত্র ডাকা হয়েছিল। দরপত্র মূল্যায়ন শেষে এটির ঠিকাদার নির্বাচনের প্রক্রিয়া চলার মধ্যেই সিটি করপোরেশনের অস্থায়ী ভবনে প্রকল্প পরিচালক মো. গোলাম ইয়াজদানীর কার্যালয়ে ঢুকে তাকে মারধর ও কক্ষ ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।
হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ এখন পর্যন্ত চার ঠিকাদারকে গ্রেপ্তারও করেছে।
সোমবার ঘটনার পরদিন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (সিসিসি) সচিব খালেদ মাহমুদ জানিয়েছেন, দরপত্র প্রক্রিয়া আগের মতই চলবে।
“বেআইনী কিছু করার সুযোগ নেই। তাদের দাবি, তারা কাজ পাচ্ছে না কেন? নিয়ম অনুসারে যারা পাবার তারা কাজ পাবে। কেউ চাইলেই তো বেআইনী কিছু করা সম্ভব না,” যোগ করেন তিনি।
একাধিক ঠিকাদার ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দলবেঁধে প্রকল্প পরিচালকের কক্ষে যাওয়া ঠিকাদাররা এ প্রকল্পে কাজ কারা পাচ্ছেন তা আগে থেকেই জেনে গিয়েছিলেন। তারা দাবি তুলেছিলেন বেশিরভাগ কাজ হাতেগোনা কয়েকজন ঠিকাদার পাচ্ছে। সেজন্য কাজ ভাগাভাগি চেয়েছিলেন তারা। এতে রাজি ছিলেন না প্রকল্প পরিচালক, যা থেকেই ঘটনার শুরু।
আড়াই হাজার কোটি টাকার ‘এয়ারপোর্ট রোডসহ বিভিন্ন সড়কসমূহের উন্নয়ন ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো উন্নয়ন শীর্ষক’ এ প্রকল্প সিসিসির সর্ববৃহৎ প্রকল্প।
ই টেন্ডারে আপত্তি
এ প্রকল্পের প্রথম ধাপে ২৯ কোটি টাকার ১১টি লটের কাজ ই টেন্ডারের পরও লটারির মাধ্যমে বণ্টন করা হয়েছিল।
পরে দ্বিতীয় ধাপের ২৬টি লটে মোট ১০৫ কোটি টাকার দরপত্র আহ্বান করা হয়, যেগুলোর মূল্যায়ন শেষে কার্যাদেশও দেওয়া হয়েছে।
সবশেষ গত বছরের নভেম্বরে আহ্বান করা হয় ২২০ কোটি টাকার ৩৭টি লটের দরপত্র। এটি খোলার পর তা মূল্যায়ন হলেও কাউকে এখনও কার্যাদেশ দেওয়া হয়নি। তবে কারা কাজ পেতে যাচ্ছেন তা জেনে গিয়েছিলেন ঠিকাদারদের কেউ কেউ।
সিসিসি’র প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম মানিকের কথাতেও কিছুটা ইঙ্গিত মেলে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এবারের মূল্যায়ন প্রতিবেদন এখনও আমাদের কাছে আসেনি। হয়ত ঠিকাদাররা কিছু জানেন। পিডি সাহেব, উনি নতুন এসেছেন। উনি নিয়ম অনুসারে কাজ করছেন।”
এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “নিয়ম আগেও অনুসরণ করা হয়েছে। ই জিপিতে অনিয়মের সুযোগ থাকে না। হ্যাঁ, একবার লটারিতে কাজ দেওয়া হয়েছিল। সেটাও নিয়ম মেনেই।”
ঠিকাদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবু ফরহাদ চৌধুরী বলেন, “ই টেন্ডারে বিভিন্ন ক্লজ থাকে। প্রথমবার ম্যানুয়ালি হয়েছিল। যেহেতু এখন ম্যাটিক্স পদ্ধতিতে রেটিং হয় তাই পদ্ধতিগত বিষয় নিয়ে কারো কারো মত বিরোধ আছে।
“এবার দরপত্র মূল্যায়ন শেষে কারা কাজ পেয়েছে সেটা এখনও ঘোষণা করা হয়নি। তাই কে কাজ পাবে আর কে পাবে না, সেটা জানি না।”
করপোরেশনের একাধিক প্রকৌশলী ও ঠিকাদার জানান, ই টেন্ডার প্রক্রিয়াতে দর একই হয়ে গেলে ম্যাটিক্স পদ্ধতিতে পয়েন্টের ভিত্তিতে কাজ দেওয়া হয়। সিসিসি’র ঠিকাদাররা প্রায় ক্ষেত্রেই কাজের একই রকম দর দেন।
সেক্ষেত্রে ম্যাটিক্স পয়েন্টে গত ৫ বছরে সিসিসি’র প্রকল্পে শেষ করা কাজের সংখ্যা (১৪০ পয়েন্ট), পাঁচ বছরে সিসিসিতে করা কাজের অর্থ মূল্য (১০০ পয়েন্ট) এবং সকল সরকারি সংস্থায় চলমান কাজের মোট মূল্য (৬০ পয়েন্ট) ধরে গণনা করা হয়।
ঠিকাদারদের অভিযোগ পয়েন্টের ভিত্তিতে ই টেন্ডারে বড় ঠিকাদারই বারবার কাজ পাচ্ছেন।
সেটির সূত্র ধরে হামলাকারীদের অভিযোগ, এবারের ৩৭টি লটের কাজে রুকনউদ্দিন নামের এক ঠিকাদারের ইকবাল অ্যান্ড ব্রাদার্স ২২টি, আলাউদ্দিন মোল্লার ডি-কনস্ট্রাকশন ট্রেড ৮টি এবং কাশেম কনস্ট্রাকশন আরেকটি প্রতিষ্ঠান চারটি কাজ দেওয়া হচ্ছে বলে তারা জেনেছেন। এ থেকেই তাদের মধ্যে কাজ না পাওয়ার ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।
তদন্তে কমিটি
সিসিসি’র সচিব খালেদ মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ঘটনা খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।
কমিটি কোন কোন ঠিকাদারজড়িত ছিল তা সহ পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখবে। একই সঙ্গে হামলার ঘটনায় করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত কি না সেটিও অনুসন্ধান করবে বলে জানান তিনি।
হামলাকারী ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, “তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়টি আলোচনা হয়েছে। আইনগত দিক যাচাই করে পরবর্তীতে যা করার সেটা করা হবে।”
সিসিসি’র কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ১০ জন সশস্ত্র আনসার নিয়োগের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে বলে জানান সচিব।
তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে করপোরেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা সৈয়দ শামসুল তাবরীজকে। দুই সদস্য হলেন আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা জোনায়েদ কবীর সোহাগ ও আইন কর্মকর্তা মনীষা মহাজন।
হামলায় ঠিকাদাররা
অস্থায়ী নগর ভবনের চতুর্থ তলায় প্রকল্প পরিচালকের কক্ষে ঢুকে হামলার ঘটনার ভিডিও ফুটেজ দেখে জড়িতদে চিহ্নিত করার পর নগরীর খুলশী থানায় মামলা করেন সিসিসি’র নিরাপত্তা কর্মকর্তা মো. কামাল উদ্দিন।
মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে তাদের বেশিরভাগই ঠিকাদার। তারা হলেন- এসজে ট্রেডার্সের সাহাব উদ্দিন, শাহ আমানত ট্রেডার্সের সঞ্জয় ভৌমিক কংকন ও সুভাষ দে, মাসুদ এন্টারপ্রাইজের মো. ফেরদৌস, মেসাস খান করপোরেশনের হাবিব উল্ল্যাহ খান, মেসার্স নাজিম অ্যান্ড ব্রাদার্সের মো. নাজিম, মেসার্স রাকিব এন্টারপ্রাইজের ফিরোজ, জ্যেতি এন্টারপ্রাইজের আশীষ বাবু, ইফতেখার অ্যান্ড ব্রাদার্সের ইউসুফ ও ফরহাদ।
তাদের মধ্যে সঞ্জয় ভৌমিক এমইএস কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। সুভাষ আওয়ামী ঘরানার ও শাহাবুদ্দিন বিএনপিপন্থি ঠিকাদার হিসেবে করপোরেশনে পরিচিত।
এদের মধ্যে চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তারা হলেন- সুভাষ দে, সঞ্জয় ভৌমিক কংকন, মো. ফিরোজ ও মাহমুদুল্লাহ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঠিকাদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে আগের বিভিন্ন সময়ের কাজের বিল এখনও বকেয়া।
“এই প্রকল্পটা পুরেপুরি সরকারি অর্থায়নের হওয়ায় অন্য প্রকল্পের কাজের মত বিল বাকি থাকার কোনো আশঙ্কা নেই। অন্যদিকে বড় ঠিকাদাররাই ঘুরে ফিরে কাজ পাচ্ছে। ফলে অন্যরা বঞ্চিত। তাই তারা কাজ পেতে মরিয়া।”
জানতে চাইলে সিসিসি ঠিকাদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবু ফরহাদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওখানে যারা গিয়েছিল সবাই ঠিকাদার না। ঠিকাদারদের সাথে বাইরের লোকজনও ছিল।
“কারো অভিযোগ থাকতে পারে। কিন্তু প্রতিবাদ জানানোর অনেক উপায় আছে। এভাবে কারো উপর হামলা করতে পারে না। কারো অভিযোগ থাকলে সেটা সমিতির পক্ষ থেকে আমরা মেয়র মহোদয়কে জানাই। কখনো পিডি’র কাছে যাই না। তারা আমাদেরও আগে কিছু বলেনি।”
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) ২০২২ সালের ৪ জানুয়ারির সভায় অনুমোদন হওয়া ২ হাজার ৪৯৯ কোটি ৯৬ লাখ টাকার এ প্রকল্পের পুরো অর্থায়ন খরচ হবে সরকারি তহবিল থেকে।
প্রকল্পের আওতায় বিমানবন্দর সড়ক সম্প্রসারণ, ওভারপাস, রাস্তা, ফুটওভারব্রিজ, কালভার্ট ও গোলচত্বর নির্মাণ করা হবে। এছাড়া বিদ্যমান ৬২ কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্তার উন্নয়নে ব্যয় হবে ২ হাজার ১০৪ কোটি টাকা।
আগে দুইবার প্রকল্প পরিচালক বদলের পর ২০২২ সালের ১৪ আগস্ট থেকে দায়িত্ব পালন করছেন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. গোলাম ইয়াজদানী।