‘কালরাতের ইতিহাস বিশ্বকে জানিয়ে শুরু হোক স্বীকৃতি আদায়ের প্রচার’

“আর্মেনিয়ার জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায়ে লেগেছিল ১০০ বছর, বাংলাদেশের হয়ত এত সময় লাগবে না,” বলেন নেদারল্যান্ডসের রাজনীতিবিদ হ্যারি ফন বোমেল। 

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 May 2023, 02:27 PM
Updated : 25 May 2023, 02:27 PM

একাত্তরে বাংলাদেশের মানুষের ওপর পাকিস্তানিরা যে বর্বরতা চালিয়েছিল, তা নিয়ে জাতিসংঘের স্বীকৃতি আদায়ে কালরাতের ঘটনা তুলে ধরেই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রচার শুরুর পরামর্শ দিয়েছেন নেদারল্যান্ডসের রাজনীতিবিদ হ্যারি ফন বোমেল। 

তিনি বলেছেন, “অপারেশন সার্চ লাইট দিয়েই একাত্তরের জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায়ে আন্তর্জাতিক অ্যাডভোকেসি শুরু করা যায়। শুধু নেদারল্যান্ডস নয়, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে এ প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে।

“আর্মেনিয়ার জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায়ে লেগেছিল ১০০ বছর, বাংলাদেশের হয়ত এত সময় লাগবে না।”

বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম সিনিয়রস ক্লাবে ‘রিকগনাইজিং বাংলাদেশ জেনোসাইড ইন ১৯৭১’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।

বাঙালির মুক্তির আন্দোলনের শ্বাসরোধ করতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে এ দেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের সেই অভিযানে কালরাতের প্রথম প্রহরে ঢাকায় চালানো হয় গণহত্যা।

সেই বর্বর হত্যাযজ্ঞে নিহতদের স্মরণে ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের প্রস্তাব ২০১৭ সালে জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়। তখন থেকেই এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ।

ইতিমধ্যে ‘জেনোসাইড’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান ‘লেমকিন ইনস্টিটিউট ফর জেনোসাইড প্রিভেনশন’, আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘জেনোসাইড ওয়াচ’ এবং গণহত্যা বিশেষজ্ঞদের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলার্স (আইএজিএস)। বাংলাদেশ এখন জাতিসংঘের স্বীকৃতি চাইছে।

নেদারল্যান্ডসের সাবেক এমপি বোমেল বলেন, “১৯৭১ সালে বাংলাদেশে জেনোসাইডের স্বীকৃতির জন্য ডাচ সংসদে আমি দাবি উত্থাপন করি। এর পক্ষে রাজনৈতিক সম্মতি তৈরিতে কাজ করছি।  

“১৯৭১ সালে গণহত্যা সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়ে যেতে থাকেন। বাংলাদেশে ন্যায়বিচারের বিপরীতে ছিল সে অবস্থান৷ যদিও তখন মার্কিন জনগণ বাংলাদেশের পক্ষে ছিল।”

২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান; শুরু হয় বাঙালির প্রতিরোধ পর্ব।

নয় মাসের যুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান, আড়াই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি এবং জাতির অসাধারণ ত্যাগের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে।

ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ ফোরামের (ইবিএফ) সভাপতি বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া অনুষ্ঠানে বলেন, “আমরা এমন একটা বিষয় নিয়ে কাজ করছি, যা বিশ্ব আজ ভুলতে বসেছে। আমাদের ৩০ লাখ শহীদ, ২ লক্ষ মা বোনের আত্মত্যাগ আর কোটি শরণার্থী মানুষের এই ইতিহাস।

Also Read: ‘জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায়ে জোরাল প্রচার দরকার’

Also Read: ‘একাত্তরের জেনোসাইডের জাতিসংঘের স্বীকৃতি বেশি দূরে নয়’

“এই জেনোসাইডের বিচার না হওয়াতে বারবার পৃথিবীতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। বিচার হলে এমনটা হতো না। তাই জেনোসাইডের স্বীকৃতি শুধু নয়, বিচারও খুব জরুরি। দুর্ভাগ্যবশত একাত্তরের জেনোসাইড ইউরোপ-আমেরিকায় সাধারণের কাছে তেমন জানা বিষয় নয়।”

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া বলেন, “আমরা ইউরোপে অনুষ্ঠান করতে গিয়ে দেখলাম সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা ১৯৭১ এর গণহত্যা বিষয়ে তেমন কিছু জানে না। এর জন্য প্রয়োজন প্রচার, প্রকাশনা ও তথ্য।

“প্রবাসী বাংলাদেশিরা সব ইস্যুতে বিভক্ত হয়ে যাই দুর্ভাগ্যজনকভাবে। কিন্তু জেনোসাইড ইস্যুতে আমাদের অবশ্যই এক থাকা উচিত।”

‘আমরা একাত্তর’ সংগঠনের প্রধান সমন্বয়ক হেলাল ফয়েজী বলেন, “অন্যদের অভিযুক্ত করার আগে নিজেদের দিকে তাকানো দরকার। আমরা কি জানি চুকনগর কোথায়? ১৯৭১ সালে ২০ মে সেখানে কয়েক ঘণ্টায় ১০ হাজার মানুষকে হত্যা করে পাকিস্তানিরা। অন্যরা স্বীকৃতি দেয় না বলে আমরা ক্ষুব্ধ। কিন্তু আমরা কতটা জানি? 

“পঁচাত্তরের ১৫ অগাস্টের পর কৌশলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে মুছে দেওয়া হয়। ফলে কয়েক প্রজন্ম তা জানতে পারেনি। এখন নতুন করে আবার জানতে শুরু করেছে।”

হেলাল ফয়েজী বলেন, “তাই আমাদের দায়িত্ব সারা বিশ্বকে জানানো। আন্তর্জাতিকভাবে ডকুমেন্ট তৈরি করা। যত বেশি ডকুমেন্ট আমরা দিতে পারব, আওয়াজ তুলতে পারব তত দ্রুত স্বীকৃতি আসবে৷

“দূতাবাসগুলোকে বাজেট দিন, যাতে তারা একাত্তরের জেনোসাইড নিয়ে অনুষ্ঠান করতে পারে। এই স্বীকৃতি অর্জন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়। আমাদের এতে বিজয়ী হতেই হবে।”

আমস্টারডামের ভ্রিজে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. অ্যান্টনি হোলস্ল্যাগ বলেন, “জেনোসাইড গণহত্যার চেয়ে অনেক বেশি কিছু। নির্মূল করার অপচেষ্টা - জাতিকে, ভাষাকে, অস্তিত্বকে। বাংলাদেশের জেনোসাইডের স্বীকৃতির পাশাপাশি আর বিশ্বে যেন কোনো জেনোসাইড না হয়, সেজন্য সোচ্চার থাকা জরুরি।”

সুইস ইন্টারস্ট্যাটেজি গ্রুপের কমিউনিকেশন ডিরেক্টর ক্রিস ব্ল্যাকবার্ন বলেন, “ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে আমরা জেনোসাইডের স্বজন হারানোর অভিজ্ঞতা শুনেছি। আরও তথ্য চাই।”

মুক্তিযোদ্ধা গবেষণা কেন্দ্রের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজুর রহমান বলেন, “প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ ভিডিও আমাদের কাছে আছে, সেখানে ভিকটিম যারা গণহত্যার কথা তারা সরাসরি বলেছেন। গণহত্যার স্থানগুলোতে ফলক যদি দেওয়া যায়…

“ইতিহাস আসলে একশ বছর পর লেখা হয়। এখন যা হচ্ছে, তা রাজনৈতিক ইতিহাস। যা সব থেকে প্রয়োজন সেটা হলো নতুন প্রজন্মকে ইতিহাস জানানো। ইতিহাস নিয়ে চর্চা আরও বাড়ানো উচিত, যাতে সবাই জানতে পারে।”

সিনিয়রস ক্লাবের সভাপতি ডা. সেলিম আকতার চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন আহমেদ উল্লাহ, বীর মুক্তিযোদ্ধা ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল, মাহফুজুল হক শাহ, বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. সরফরাজ খান বাবুল, অধ্যাপক মো. মাঈনুদ্দিন ও অমলেন্দু সরকার।