কিন্তু এই পেশার সাথে একটি দেহজ সম্পর্ক থাকায় একবার নয়, পাঁচবার জাপান ভ্রমণ করেও রবীন্দ্রনাথ তাঁর কোনো লেখাতেই ‘গেইশা’ শব্দটিও উচ্চারণ করেন নি!
Published : 26 Apr 2025, 06:09 PM
নতুন কিছু লেখার আগে তথ্যের প্রয়োজন না হলে আমি সাধারণতঃ অন্যের, বিশেষ করে বিখ্যাত লেখকের একই ধরণের লেখা পড়ি না। কারণ আমার ভয়, তাতে প্রভাবিত হয়ে আমার লেখায় অন্যের লেখার প্রতিফলন ঘটতে পারে, যা আমি পরিহারের চেষ্টা করি। এই অবস্থায় জাপানে দীর্ঘবাসের অভিজ্ঞতা নিয়ে আমার লেখা ক্রমান্বয়ে প্রকাশ শুরু হলে প্রাবন্ধিক আহমাদ মাযহার বললেন জাপান নিয়ে ইতোমধ্যে প্রকাশিত অন্যান্য বই পড়ে নিলে আপনি নিজের লেখার অবস্থানটি বুঝতে পারবেন। এই বলে তিনি কয়েকজন লেখকের নাম বলে একটি বইয়ের পিডিএফ লিংকও পাঠিয়ে দিলেন। ভাবলাম মাযহার সাহেবের মতো সাহিত্যের এক বহুপাঠী যেহেতু বলছেন এবং আমার লেখাও প্রায় ৯০ শতাংশ শেষ যার অনেকটাই প্রকাশিত হয়ে গেছে, তার উপদেশটি গ্রহণ করলে লাভ বই ক্ষতি কিছু হবে না। লাভ যে হয়েছে এর প্রমাণ পেলাম চল্লিশ বছরের পুরনো স্মৃতিচারণে দুয়েকটি তথ্যগত ক্ষেত্রে আমার যে যে দ্বিধা ছিল তা দূর হয়ে গেছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জাপানের যাত্রী’র অনেকটুকু আগেই পড়া ছিল। এবার জাপান সম্পর্কে তিনি কী লিখেছেন তা জানার প্রয়োজনেই আবার পড়লাম। এই জানুয়ারিতে জাপান (ভ্রমণ) সম্পর্কিত চারটি বই ঢাকা থেকে আনিয়েছি এবং একটি অন্তর্জাল থেকে নামিয়েছি। এগুলো হচ্ছে, হরিপ্রভা তাকেদা প্রণীত ‘বঙ্গমহিলার জাপান যাত্রা’, অন্নদাশংকর রায়ের ‘জাপানে’, প্রবীর বিকাশ সরকারের ‘জানা অজানা জাপান (তৃতীয় খণ্ড)’, এবং আশির আহমেদের ‘জাপান কাহিনি’র দুটি বই। এর বাইরে ডঃ নূরন নবীর ‘স্মৃতিময় নিপ্পন’ এবং ডঃ মাহতাব আহমেদের ‘ফিরে দেখা জাপান’ বই দুটো আমার সংগ্রহে ও পড়া ছিল। এই বইগুলোতে ভ্রমণকালের বিস্তৃতি ১১৩ বছর। বিডিনিউজ২৪ আর্টসপাতা যেখানে আমার জাপান ভ্রমণ বৃত্তান্ত ‘নিহনজিন’ ধারাবাহিকভাবে ছাপা হচ্ছে, তার সম্পাদকের পরামর্শের ডঃ মঞ্জুরে খোদা প্রণীত ‘জাপানের উন্নয়নে শিক্ষার ভূমিকা’ বইটি বাজারে পাওয়া গেল না।
ভ্রমণ কাহিনি সচরাচর যা হয়ে থাকে – একটি অপরিচিত স্থানের ভূগোল থেকে শুরু করে এর অধিবাসীদের আচার আচরণ, ধর্ম, খাদ্যাভ্যাস, শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি এক ব্যক্তি বিশেষের চোখে যেভাবে ধরা পড়ে তা পাঠকের কাছে পৌঁছে দেয়া – সেই অর্থে এই আটটি বইয়ের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। পত্রিকায় প্রকাশিত ও প্রকাশিতব্য জাপান সম্পর্কিত আমার কাহিনিতেও এর ব্যাতিক্রম নেই। মনে হতে পারে জাপান সম্পর্কিত একটি বই পড়লেই তো যথেষ্ট হওয়া উচিৎ। কিন্তু আসলে তা নয়, প্রতিটির একেকটি নিজস্ব বিশেষত্ব আছে।
‘বঙ্গমহিলার জাপান যাত্রা’র বিশেষত্ব হচ্ছে এর সারল্য এবং এটি বাংলা ভাষায় প্রথম জাপান সম্পর্কিত সাহিত্য। সাহিত্যমানের কথা উল্লেখ না করেও ‘জাপানের-যাত্রী’র বিশেষত্ব হচ্ছে সেটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা। ‘জাপানে’র বিশেষত্ব হচ্ছে তৎকালীন জাপান ও বিশ্বসাহিত্য ও সাহিত্যিকদের মাঝে বিচরণকালে এক বিদগ্ধ সাহিত্যিকের চোখে দেশটিকে দেখা। ‘জানা অজানা জাপান’ এর বিশেষত্ব হচ্ছে দীর্ঘ তিরিশ বছর জাপানে বাস করা এক অনুসন্ধিৎসু চোখে পর্যবেক্ষণলব্ধ জাপানি সংস্কৃতিকে বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য উন্মুক্ত করা। আর অনেকটা টেকনিক্যাল নোটের স্টাইলে আধুনিক জাপানের বিভিন্ন দিক নিয়ে ছোটো ছোটো লেখা নিয়ে পরের চারটি বইতে চোখ বুলানোর আগেই পড়ে শেষ করে ফেলা যায়। আমার নিজের লেখার কোনো বিশেষত্ব যদি থেকে থাকে তা বিবেচনার বিষয় আমার নয়, পাঠকের।
একই বিষয়ের অনেকগুলো বই পাঠের ভালো দিকটি হচ্ছে সময়ের বিবর্তনে একটি বিশেষ দেশ, সমাজ ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনগুলো স্পষ্টভাবে দেখতে পাওয়া। যেমন, নাম তো বটেই, ১১৩ বছর আগের বইতে বিবৃত জাপানি গ্রামের (‘বঙ্গমহিলার জাপান যাত্রা’) অস্তিত্বই আজ আর নেই। যেমন, ৬৭ বছর আগেও বেঁচে থাকা প্রাচীন ‘নোহ’ ও ‘কাবুকি’ নামে নন্দিত জাপানি নাট্যকলা (‘জাপানে’) এখন শেষ নিঃশ্বাস ফেলছে। যেমন, কথায় কথায় ছবি তোলার চল্লিশ বছর আগে জাপানি প্রবণতার (‘নিহনজিন’) রেশও আজ আর অবশিষ্ট নেই।
একই বিষয়ের বিভিন্ন বই পাঠের আরেকটি ভালো দিক হচ্ছে একই জিনিসকে বিভিন্ন চোখে দেখা। জাপানি সংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য কোনো দিক অন্যের চোখে নিতান্তই তুচ্ছ মনে হতে পারে। যিনি তা দেখছেন বা লিখছেন, তার সামাজিক, পারিবারিক ও শিক্ষাগত পরিবেশের প্রতিফলনও লেখক নিজের অজান্তে সেই লেখাতে রেখে যান। যেমন, ‘লেখক পরিচিতি’ না পড়েও ‘জাপান কাহিনি’র রচয়িতা যে একজন প্রযুক্তিবিদ তা বোঝা যায়। আর একই বিষয়ের বিভিন্ন বই পাঠে সর্বোপরি, মুন্সীয়ানার বাইরেও লেখকের অন্তর্গত সাহিত্য- ও জীবন-বোধের পার্থক্যের পরিচয়টিও উপভোগ করা যায়। আমি এই তিনটি দিকেই মনযোগ দেয়ার চেষ্টা করেছি। একই বিষয় নিয়ে লেখকের দৃষ্টির সাদৃশ্য বা ভিন্নতা খোঁজারও চেষ্টা করেছি।
বঙ্গমহিলার জাপান যাত্রা – বইটি বাঙলা সাহিত্যে তো বটেই, জাপান দেশটিকে বহির্বিশ্বের সাহিত্যামোদীদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়া বইয়ের মাঝে অন্যতম। তেমনই লিখেছেন লণ্ডনে ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে রক্ষিত মাইক্রোফিল্মের ছাপাকপি থেকে বইটি উদ্ধার ও পুণর্নির্মানকারী গবেষক মনজুরুল হক। ঢাকার ব্রাহ্ম পরিবারের কন্যা হরিপ্রভা মল্লিক ১৯০৬ সালে জাপানি নাগরিক উয়েমন তাকেদা’কে স্বামী হিসাবে গ্রহণ করে স্বামীর পারিবারিক নাম গ্রহণ করলেন। ১৯০৩ সালে অধিক উপার্জনের আশায় যে চৌদ্দ হাজার জাপানি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিলেন তাঁদের মাঝে ২৪ জন এসেছিলেন ভারতবর্ষে। তাদেরই একজন ছিলেন আমাদের উয়েমন তাকেদা। তিনি ঢাকার ‘বুলবুল সোপ ফ্যাক্টরিতে প্রযুক্তিবিদ ছিলেন। বিয়ের পর তিনি ‘ঢাকা সোপ ফ্যাক্টরি’ নামে নিজেই একটি কারখানার মালিক হয়েছিলেন। তখন বাংলার বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ভারতের স্বদেশী আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে ইউরোপ থেকে আমদানীকৃত দেশলাই, কাপড়, সাবান ও অন্যান্য দ্রব্যের বদলে দেশেই সেসব উৎপাদনের চেষ্টা করছিল। ধারণা করা যায় তেমনই এক প্রচেষ্টার সাথে যুক্ত হয়েছিলেন এই জাপানি নাগরিক।
যাই হোক, বিয়ের ছয় বছর পর, হরিপ্রভা ১৯১২ সালে স্বামীর সাথে সমুদ্রপথে জাপান রওনা হন। জাপানে শ্বশুরবাড়িতে থাকা এবং অনেকগুলো শহরে বেড়ানোর চার মাস কাটানোর সময় সেখানকার নাগরিক ও গ্রামীণ জীবনের বিস্তারিত বর্ণনা দেন। আজ থেকে ১১৪ বছর আগের জাপানি আতিথেয়তা, নিয়মবর্তীতা, শিশু ও নারীশিক্ষা, পত্রিকা পাঠাভ্যাস, বয়োজ্যেষ্ট ও অতিথির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের তিনি যা যা প্রত্যক্ষ করেছিলেন, তা সর্বশেষ এক বছর আগে আমার অভিজ্ঞতা থেকে কোনো অংশেই কম ছিল না। একইভাবে একটি মাত্র বাক্যে জাপানের ধর্ম সম্পর্কে তিনি যা লিখেছিলেন, তা আজও বহুলাংশে সত্য। বাক্যটি হচ্ছে, ‘পরলোকবাসীদের প্রতি ভক্তি, সম্রাটের প্রতি শ্রদ্ধা, স্বদেশের প্রতি ভালবাসা, কর্মে আসক্তি, ইহাই জাপানের ধর্ম’।
বাংলা সাহিত্যে জাপানের ওপর প্রথম গ্রন্থ হওয়ায় এর গুরুত্ব বিবেচনা করে বইটিতে দুটি প্রবন্ধ যোগ করা হয়েছে। বইয়ের ভূমিকা ও প্রবন্ধ লেখক মনজুরুল হক এই তাকেদা দম্পতিকে নিয়ে কিছু গবেষণা এবং আরো তথ্য সংগ্রহের ওপর গুরুত্ব আরোপ করলেও এখনও কেউ তেমন প্রচেষ্টা করেছেন বলে আমার জানা নেই। তবে এই নিবন্ধের শেষদিকে আলোচিত ‘জানা অজানা জাপান’ বইতে এ সম্পর্কিত নতুন একটি তথ্য এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। কোনো সূত্র উল্লেখ না করেই শেষোক্ত বইয়ের লেখক প্রবীর বিকাশ সরকার জানাচ্ছেন (পৃ৫০) যে তোসান নামে উয়েমন তাকেদা-র ছোটোভাইও ঢাকায় রানি নামে এক বাঙালি মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন। তিনি আরো লিখেছেন এই দুই ভাই পরে কলকাতায় স্থায়ী হয়েছিলেন। কথাটি সত্য হলে ১৯০৩ সালে ভাগ্যান্বষণে একজন জাপানি নয়, দুইজন কিছুকালের জন্য ঢাকায় স্থিতু হয়েছিলেন। তবে সময়টি ১৯০৩ না হয়ে ১৯১২-১৪ পরবর্তী কোনো সময় হয়ে থাকবে, অন্যথায় হরিপ্রভা নিশ্চয়ই তা নিজ বইতে উল্লেখ করতেন কারণ প্রাসংগিকভাবে ভারতে অবস্থানকারী অন্যান্য জাপানি নাগরিকের কথা লিখতে তিনি কোনো ভুল করেননি।
বই হিসাবে প্রকাশের আগে ‘বঙ্গমহিলার জাপান যাত্রা’ ভ্রমণকাহিনিটি ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১৫ সালে, রবীন্দ্রনাথের জাপান যাত্রার এক বছর আগে। আর কবিগুরুর ‘জাপান-যাত্রী প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১৬ সালে।
জাপান-যাত্রী – বইয়ের এক বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের সমুদ্র ভ্রমণের বর্ণনা। সেই তুলনায় তাঁর জাপান অভিজ্ঞতার বিবরণ কমই বলতে হবে। লক্ষণীয় যে, যাত্রাপথে হরিপ্রভা তাকেদার জাহাজ যে যে বন্দরে থেমেছিল কবি প্রায় অবিকল একই পথ ধরে জাপানের কোবে বন্দরে পৌঁছেছিলেন। কিন্তু জাহাজে ও সেই সকল স্থানের অভিজ্ঞতা দুজনেই বর্ণনা করলেও দুজনের জ্ঞান, শিক্ষা ও সামাজিক অবস্থিতির ফলে বর্ণনার বিশাল পার্থক্যটি খুব সহজেই ধরা পড়ে। উপরন্তু ঠিক ঘটনা, প্রথা, আচরণ, স্বভাব বা স্থাপনা নয়, রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে বিষয়টি ঘিরে তাত্ত্বিক ও আধ্যাত্মিক আলোচনার পাশাপাশি আত্মোপলব্ধির প্রকাশ ছিল মূখ্য। ফলে হরিপ্রভার কঙ্কালময় বর্ণনা রবীন্দ্রনাথের হাতে তুলতুলে ও নাদুস নুদুস হয়ে ওঠে। অনেকটা অতি ক্ষুদ্র শিমুল বীচিকে ঘিরে থাকা বিশাল তুলার আবরণের মতো। ঠিক একই সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায় জাপানে পৌঁছে রবীন্দ্রনাথের অভিজ্ঞতা বর্ণনায়। দুজনেই জাপানি সমাজ, শিল্প ও সংস্কৃতির প্রভূত প্রশংসা করেছেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে তা ছিল নানা ধরণের উপমা-উৎপ্রেক্ষার মিশ্রণে এক উচ্চস্তরের শিল্পীত-সুষমায় মণ্ডিত।
হরিপ্রভার মতো তিনিও জাপানি বাগান, আনুষ্ঠানিক চা-পরিবেশন, পুস্প-বিন্যাস, গৃহ ও মন্দিরে আসবাবের অপ্রতুলতা ও ট্রেনের বর্ণনা দিয়েছেন। জাপান কর্তৃক বৌদ্ধধর্ম ও পাশ্চাত্যের উন্নত শিল্প গ্রহণ ও আত্মীকরণ ক্ষমতার উৎস জাতিটির শঙ্কর অতীতের সাথে সম্পর্কিত বুঝতে পেরে বাঙালিও খুব সহজেই তা করতে পারার কথা আলোচনা করেছেন। একই সাথে ভারত ও বাংলার ভর্ৎসনাও করেছেন। কারণ, ভারতের অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় বাঙালিরা শুধু শংকর জাতই নয়, বিদেশি সংস্কৃতিকে সাদরে গ্রহণ করার ক্ষমতাও অতুলনীয়। এইসব বিবেচনায় লিখেছেন ‘…আমাদের জীবনযাত্রার উপযোগী জিনিষ আমরা এখান থেকে যত নিতে পারি, এমন য়ুরোপ থেকে নয়। তা ছাড়া জীবনযাত্রার রীতি যদি আমরা অসঙ্কোচে জাপানের কাছ থেকে শিখে নিতে পারতুম, তাহলে আমাদের ঘর দুয়ার এবং ব্যবহার শুচি হত, সুন্দর হত, সংযত হত। জাপান ভারতবর্ষ থেকে যা পেয়েছে, তাতে আজ ভারতবর্ষকে লজ্জা দিচ্ছে; কিন্তু দুঃখ এই যে, সেই লজ্জা অনুভব করবার শক্তি আমাদের নেই’। শতাধিক বছর পূর্বে রবীন্দ্রনাথের এই আক্ষেপ জাপানে থাকাকালে আমি নিজে যেমন অনুভব করেছি, বিভিন্ন উদাহরণ থেকে আজও আমরা অহরহ করছি।
জাপানি চরিত্রের একটি দিক যা অধিকাংশ পর্যটকের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়, রবীন্দ্রনাথের ‘জাপান-যাত্রী’র ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। তিনি লিখেছেন, ‘জাপানীরা যে রাগ করেনা, তা নয়, কিন্তু সকলের কাছেই একবাক্যে শুনেছি, এরা ঝগড়া করে না। এদের গালাগালির অভিধানে একটিমাত্র কথা আছে—বোকা—তার ঊর্দ্ধে এদের ভাষা পৌঁছায় না! ঘোরতর রাগারাগি মনান্তর হয়ে গেল, পাশের ঘরে তার টুশব্দ পৌঁছল না,―এইটি হচ্চে জাপানী রীতি’। এই পর্যবেক্ষণকে উপলক্ষ করে ভারতবাসীর ঠিক বিপরীত স্বভাবের তীব্র সমালোচনাও করেছেন। জাপানি ভাষায় বোকা হচ্ছে ‘বাকা’ অথবা ‘আহ’। আমার দীর্ঘ জাপান বাস কালে একবার মাত্র এই ‘বাকা’ গালিটি শুনেছিলাম আমার অধ্যাপকের মুখে। আমি ছিলাম ল্যাবের ভেতর। তিনি করিডোর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় অদৃশ্য কোনো ব্যক্তির উদ্দেশ্যে তাঁর স্বগতোক্তি শুনে!
জাপানের প্রশংসা তিনি করেছেন সুন্দর দুটি বাক্যে – ‘জাপানের যেটা শ্রেষ্ঠ প্রকাশ সেটা অহংকারের প্রকাশ নয়, আত্মনিবেদনের প্রকাশ, সেইজন্যে এই প্রকাশ মানুষকে আহ্বান করে, আঘাত করে না’।
জাপানে – বইয়ের লেখক অন্নদাশংকর রায়। জাপান ভ্রমণ সম্পর্কিত যে আটটি বইয়ের উল্লেখ করেছি, তার মাঝে এই ‘জাপানে’ বইটি পড়ে আমি সবচেয়ে আনন্দ পেয়েছি, আত্মার খোরাক পেয়েছি। তথ্য ও ঘটনাকে এমন সুশীল, এমন কোমল, এমন পাণ্ডিত্যপূর্ণ ও এমন সূক্ষ্ম কৌতুকের আবরণে ছোটো ছোটো বাক্যে প্রকাশ করেছেন যা এর আগে খুব বেশি একটা পড়িনি। ‘পথে প্রবাসে’ নামে এই লেখকের আরেকটি ভ্রমণ বই সম্প্রতি পড়লেও এমন আনন্দ পাইনি। লেখক ভূমিকায় লিখেছেন, ‘মন বলছিল সত্যই যথেষ্ট নয়, সৌন্দর্যও চাই। কেবল বহিঃসৌন্দর্য নয়। অন্তঃসৌন্দর্য। সৌন্দর্যের দীক্ষা যে পূর্বে কোনো দিন হয়নি তা নয়, কিন্তু পরিপূর্ণ সৌন্দর্য অভিষেক জাপানে গিয়েই হলো’। বইটির অধ্যায়ের পর অধ্যায়ে আমি দুই সৌন্দর্যই উপভোগ করেছি, আনন্দে এই সৌন্দর্-স্রষ্টার প্রতি প্রণতি জানিয়েছি।
১৯৫৭ সালে টোকিওয় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক পেন (PEN) ক্লাবের ২৯তম কংগ্রেস বা সম্মেলনে ভারতীয় সাহিত্যিক হিসাবে আমন্ত্রিত হয়ে লেখক তাতে যোগ দিয়েছিলেন। সেই সময় মোট দুই মাস জাপান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা তিনি ‘জাপানে’ বইতে বর্ণনা করেছেন। বইটি প্রকাশিত হয়েছিল কলকাতা থেকে, বাংলা ১৩৬৫ (ইংরেজি ১৯৫৯) সালে। লেখক সম্মেলন ছিল বিধায় এই বইতে আমরা জাপানি ও ভিনদেশের অনেক বিখ্যাত লোকের লেখা ও ব্যক্তিগত জীবনের কথাও জানতে পারি, যাদের মাঝে ছিলেন পরবর্তীতে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ইয়াসুনারি কাওয়াবাতার সাথে লেখকের সময় কাটানো। সম্মেলনে তাঁর বক্তৃতার বিষয় ছিল – ‘একালের ও ভাবীকালের লেখকদের উপর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সাহিত্যের পারস্পরিক প্রভাব’ – একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও পরিশ্রমলব্ধ বিষয়ই বটে!
তাঁর বইটি সময়ানুক্রম ধরে লেখা, অর্থাৎ, প্রতিদিন, প্রতি ঘন্টার পরম্পরা অনুযায়ী যাদের সাথে দেখা হয়েছে, তিনি যা দেখেছেন বা বলেছেন তার অনুপূংখ বর্ণনা দিয়েছেন। জাপানের মানুষ, নগর, বন্দর, গ্রাম, শিক্ষা ও সংস্কৃতি নিয়ে তাঁর আগে ও পরে অনেকে লিখলেও তাঁর পর্যবেক্ষণগুলো ছিল অনেক গভীর ও বিশ্লেষণাত্মক। হরিপ্রভা তাকেদার মতো জাপানিদের বইপুস্তক পড়ার আগ্রহটি তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। তাঁর বিচরণ হরিপ্রভা বা আমার মতো শুধুমাত্র ট্রেনে-বাসে সীমাবদ্ধ না থেকে ছিল অনেক উচ্চস্তরের কবি-লেখকদের সাথে। ফলে তিনি লিখতে পেরেছেন, ‘গণশিক্ষা লেখকদের জন্য হয়েছে পোয়াবারো। লাখে লাখে বই বিক্রি হয়, অনেক লেখকের ২/৩টি বাড়ি’।
তিনি মেয়েদের ও ছেলেদের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ভ্রমণ করেছেছেন এবং শিল্প-সাহিত্য বিষয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন। জাপানের বিখ্যাত পুস্প-বিন্যাস বা ফ্লাওয়ার এরেঞ্জমেন্ট, চা-পরিবেশন বা টি-সিরিমনি, ক্যালিগ্রাফি বা চিত্রবত শৈল্পিক হস্তলেখা, উকিয়োয়ে বা কাঠ-খোদাই ছাপশিল্প, পুতুলনাচ, ক্ষয়িষ্ণু নাটক-সদৃশ নোহ এবং কাবুকি বা জাপানের ঐতিহ্যবাহী মঞ্চ প্রদর্শণী, রাশিয়ার ব্যালে ড্যান্স, ইত্যাদি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে বসে শুধু উপভোগই করেননি, প্রতিটি শিল্পের উৎপত্তি, ইতিহাস, দর্শন এবং বর্তমান অবস্থা ও মূল্যায়ন করেছেন অতিশয় নিষ্ঠার সাথে। তিনি যে শিল্প সংস্কৃতির এক উঁচুদরের সমঝদার, তার প্রমাণ পাওয়া যায় প্রায় প্রতিটি প্রদর্শণীর পর মঞ্চের পেছনে গ্রিনরুমে উপস্থিত হয়ে মূল চরিত্র এবং পরিচালক-প্রযোজককে সাধুবাদ জানিয়েছেন। জাপানি উন্নত সাংস্কৃতির অনেকটাই আমার জানা বা শোনা ছিল। কিন্তু ‘য়োশে’র কথা এই বইতেই প্রথম পড়লাম। এটি কাবুকির মতোই একটি মঞ্চ পরিবেশনা – সারাদিন ধরে এক প্রকার গল্প বলে বলে দর্শককে ধরে রাখে। স্বল্পক্ষণের জন্য হলেও তিনি তা উপভোগ করেছেন।
অন্যদের থেকে তার বিস্তারিত আলোচনার ভিন্নতার একটি মাত্র উদাহরণ দিতে হলে ধর্মের কথা উল্লেখ করতে হয়। পূর্বোক্ত তিনজনের মতোই তিনি জাপানের বিখ্যাত ধর্মমন্দিরগুলো দর্শন করে জাপানি মন্ত্র নেমবুতসু , যা ‘নমু অমিদা বুতসু’র সংক্ষিপ্তাকার, তা যে ভারতীয় বৌদ্ধদের যপ – ‘নম: অমিতাভ বুদ্ধ’ থেকে উৎসরিত তা উল্লেখ করেছেন। পরবর্তী ‘জানা অজানা জাপান’ বইতে যথেষ্ট আলোচনা করলেও অন্নদাশংকর জাপানি বৌদ্ধ ধর্মের সাথে ভারতীয় হিন্দু ধর্মের গভীর সম্পর্কের নিয়ে ঢের বেশি আলোচনা করেছেন। তার লেখা থেকেই জানতে পারি জাপানের ৩০টি ভিন্ন ভিন্ন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের দেড় হাজার বৌদ্ধ ধর্ম মন্দির রয়েছে। কিয়োতোর তেনরিওজি বৌদ্ধমন্দির দেখে ‘এক টুকরো ভারত’, ‘এক রত্তি পালযুগ’ দেখেছেন। প্রাচীনতম রাজধানী নারা শহরের হরিওজি টেম্পল-এ রক্ষিত ৭ম শতাব্দীতে বাংলায় মহাযান বৌদ্ধ পালযুগে অজন্তার অনুরূপ ম্যুরালচিত্রের কথা জানিয়েছেন। অনেক বৌদ্ধ দেবদেবীর নামের মাঝে ভারতীয় হিন্দু দেবদেবীর নাম খুঁজে পেয়েছেন। ভারতের অমিতাভ, ক্ষিতিগর্ভ, মহালয়া – শরৎ সংক্রান্তির জাপানি সংস্করণ খুঁজে পেয়েছেন। বাংলার সরস্বতি দেবীমূর্তি হাতে বীনার বদলে অনুরূপ বেনজাইতেন-দেবীমূর্তির হাতে জাপানি কতো বাদ্যযন্ত্র দেখেছেন। এসব সামঞ্জস্য থেকে ভৌগলিকভাবে বিচ্ছিন্ন দেশে ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক এই মিলকে তিনি দেশকেন্দ্রিক না বলে যুগকেন্দ্রিক বলে আখ্যায়িত করেছেন।
তিনি জাপানের যে যে স্থানে ভ্রমণ করেছেন, তার প্রায় সবখানেই আমার যাওয়া হয়েছে। মাত্র একবছর আগে আমার শেষ ভ্রমণের সবকিছুই জ্বলজ্বল করছে। তেমন একটি হলো ফুজি পর্বত দর্শনের জন্য টোকিওর অদূরে পর্যটন-প্রিয় হাকোনে শহরে যাওয়া। সেখানে যেতে আমি যে পথ অবলম্বন করেছিলাম, প্রায় অর্ধশত বছর আগে টোকিও থেকে ট্রেনে করে ওদাওয়ারা স্টেশন হয়ে বাসে করে প্রকৃতির অপূর্ব দান হাকোনে পৌঁছানো। তাঁর কর্মসূচীতে জাহাজ যোগে এখানকার হ্রদে ভেসে বেড়ানোর কথা থাকলেও সময়াভাবে তা উপভোগ করতে পারেননি – সৌভাগ্যবশত যা আমরা পেরেছিলাম। ধারণা করি তারও প্রায় চল্লিশ বছর আগে রবীন্দ্রনাথও আমাদের একই পথ ধরে ফুজি পর্বতের মহিমা দেখতে এসেছিলেন। সময়ের পরিবর্তনে দৃশ্যপটের পরিবর্তন নিশ্চয়ই হয়নি কিন্তু এই তিনজনের দেখার মাঝে যে আকাশ পাতাল পার্থক্য ছিল তা বলাই বাহুল্য।
প্রায় এক মাসের এই ভ্রমণে জাপানি জীবনব্যবস্থার অনেকটাই তিনি তুলে ধরেছেন নির্মোহভাবে। তাকেদা এবং রবীন্দ্রনাথের চোখে পড়া উচিৎ ছিল যা তাঁরা লেখার সাহস করেননি, অন্নদাশংকর রায় তা লিখেছেন।
জাপানের বিখ্যাত গেইশাদের কথাই ধরা যাক! অধিকাংশ লেখকই বিষয়টি এড়িয়ে যান। ‘ফিরে দেখা জাপান’ বইতে মাহতাব আহমেদ এবিষয়ে আলোচনা করেছেন ঐতিহাসিক ও পুঁথিগত দৃষ্টিতে কিন্তু আন্নদাশংকর বেশ খোলামেলাভাবেই নিজের মনোভাব প্রকাশ করেছেন। অতিথিদের মনোরঞ্জনে নিয়োজিত এই দলভুক্ত নারীরা বিদেশি, বিশেষত পশ্চিমাদের কাছে যতোই নিন্দনীয় হোক না কেন, জাপানে শিক্ষা, সাহিত্য ও সংগীত ও নৃত্য-শিল্পকলায় পারদর্শী এই শ্রেণিটির জাপানে একটি সম্মানজনক অবস্থান রয়েছে বা ছিল। জাপানে আমার এক প্রৌঢ় অধ্যাপক সাবুরো ফুকুইয়ের স্ত্রী তাঁর যৌবনকালের স্বামীর প্রসংসা করতে গিয়ে বলেছিলেন, কী সুন্দর সুপুরুষ সে ছিল, শহরের পানশালা পাড়ার প্রতিটি সুন্দরীর কাছে সে আরাধ্য পুরুষ ছিল!’ সেখানে ছাত্র থাকাকালে আমার এক জাপানি বন্ধু বলেছিল ওর এক বান্ধবী কলেজ শেষে এই পেশায় নিয়োজিত হতে চায়। কিন্তু এই পেশার সাথে একটি দেহজ সম্পর্ক থাকায় একবার নয়, পাঁচবার জাপান ভ্রমণ করেও রবীন্দ্রনাথ তাঁর কোনো লেখাতেই ‘গেইশা’ শব্দটিও উচ্চারণ করেন নি! রবীন্দ্রভক্ত হয়েও অন্নদাশংকর এই বিঢ়ম্বনা কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন কিন্তু অনেক বিলম্বে। লিখেছেন,
বেশির ভাগই অল্প বয়সী মেয়ে।...ফুটফুটে মেয়ে, যেমন কচি তেমনি নিরীহ। আহা কেমন ভক্তিমতি।
কিন্তু যখন জানতে পারলেন এরা আসলে গেইশা ছিল, তখন অনুশোচনায় লিখেছেন,
গেইশার হাত ধরে প্রকাশ্যে রাজপথে চলছেন অন্নদাশংকর রায়। দৃশ্যটা কল্পনা করতেই আমার বলতে ইচ্ছা গেল, মা ধরণী দ্বিধা হও!
একইভাবে জাপান ভ্রমণকারী প্রায় সবার মতো ‘ওফুরো’তে গণস্নানের কথা তাকেদা এবং রবীন্দ্রনাথও লিখেছেন। শেষেরজন নারীপুরুষ দিগম্বর হয়ে একত্রে স্নান করাকে জাপানিদের সামাজিক পটভূমিতে প্রশংসাই করেছেন। সেদেশে বহু বছর বাস করেও প্রথাটিকে আমি এবং অনেক বিদেশিই রপ্ত করতে পারিনি। কিন্তু মাত্র একমাস ভ্রমণকালে অন্নদা শংকর প্রবল অনীহা সত্ত্বেও শুধুমাত্র অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য এক পর্যায়ে এক সেবিকার সামনে সাংস্কৃতিক-মানসিক সেই বাধা ঠিকই অতিক্রম করেছিলেন।
ওসাকার বিখ্যাত ‘বিবিন-জা’ বিনোদন কেন্দ্রের ৮০০ ক্যাবারে বা টাক্সি ড্যান্সার-এর প্রদর্শণী দেখেছেন। সম্মান দেখিয়ে এঁদের সবচেয়ে সুন্দরী ইংরেজি জানা নর্তকীটি তাঁর পাশে এসে বসলে তাঁর পেশা, রোজগার এবং জীবনদৃষ্টি সম্পর্কে জেনে নিয়ে সত্যিকার পর্যটকের মতো পাঠকদের জানাতে ভোলেননি, ভোলেননি তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাসুলভ অভিব্যক্তি প্রকাশেও।
জাপানিদের জন্য আরেকটি স্পর্শকাতর বিষয় হচ্ছে সমাজে নারীর স্থান। নারী পুরুষের সমানাধিকার স্বীকৃত থাকলেও সাংস্কৃতিকভাবে বিয়ের পর নারীদের প্রধান কাজ গৃহস্থালীতে সীমাবদ্ধ। আর স্ত্রীকে যদিও ‘উচি নো কামিসামা’ বা ‘বাড়ির দেবী’ বলে আখ্যায়িত করা হয়, স্ত্রীরা স্বামীর ইচ্ছাকেই প্রাধাণ্য দেবেন এটাই সবাই আশা করে। তবে ধারণা করি, স্পর্শকাতর বিধায় এ নিয়ে প্রকাশ্য আলোচনা বা কোনো ভ্রমণকাহিনিতে সরাসরি নেতিবাচক কোনো লেখা পড়িনি। হরিপ্রভা তাকেদা খুব বিনয়ের সাথে যা লিখেছেন তা হলো , ‘মেয়েদের পতি, পতির আত্মীয়-স্বজন, ও শ্বশুর শাশুরীর সেবা পরম ধর্ম। ইহার কোনরূপ অন্যথা হইলে স্ত্রী অত্যন্ত লাঞ্চিত হন’। একইভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘জাপান যাত্রী’তে লিখেছেন, ‘কারো কারো কাছে শুনতে পাই, জাপানের মেয়েরা এখানকার পুরুষের কাছ থেকে সম্মান পায় না। সে-কথা সত্য কি মিথ্যা জানি নে, কিন্তু একটা সম্মান আছে সেটা বাইরে থেকে দেওয়ার নয়—সেটা নিজের ভিতরকার। অন্নদাশঙ্কর একই কথাকে শৈল্পিক ও সুক্ষ্ম রসবোধের মোড়কে জনৈকা শিক্ষিতা, ইংরেজিতে পারদর্শী জাপানি রমনীর মুখ দিয়ে বলিয়েছেন এইভাবে – জাপানের তিনটি প্রধান ভয় হচ্ছে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প, এবং স্বামী – ‘হাজব্যান্ড ইস দা গ্রেটেস্ট টেরার অব জাপান’!
তাঁর জাপান ভ্রমণের প্রায় শেষ দিন টোকিওতে বাঙালি তথা ভারতীয় বিপ্লবী পলাতক রাসবিহারী বসুর কন্যার নাকামুরায়া রেস্তোরাঁয় না গিয়ে থাকতে পারলেন না। ভারতে বৃটিশ বিরোধী সহিংস সংগ্রামে গোপনে যুক্ত থাকার কথা জানা হয়ে গেলে গ্রেফতার এড়াতে জাপানে আশ্রয় নেন এবং এক জাপানি মহিলাকে বিয়ে করে টোকিওয় একটি রেস্তোরাঁ দেন। এই বিপ্লবী সম্পর্কে বীর মুক্তিযোদ্ধা ডঃ নূরন নবীও তাঁর ‘স্মৃতিময় নিপ্পন’ বইতে বিস্তারিত লিখেছেন। রাসবিহারী বসুর আকর্ষণেই অন্নদাশংকর রায় সম্ভবতঃ ঠিক সেই নাকামুরায়া রেস্তোরাঁতেই গিয়েছিলেন।
কলেবরে সর্ববৃহৎ, ২৫৬ পৃষ্ঠার ‘জাপানে’ আলোচনাটি অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ হয়ে গেলেও আরেকটি ব্যাপার উল্লেখ করেই এর ইতি টানতে চাই। রাশিয়ার একটি বিখ্যাত ব্যালে নৃত্যদলের প্রদর্শণী চলছিল টোকিওয়। লেখক এই সুযোগ ছাড়তে রাজি ছিলেন না। অনেক ব্যস্ততা ও টিকেটের দুষ্প্রাপ্যতাকে জয় করেছিলেন, প্রধান ও বিশ্বখ্যাত নর্তকীর অনুরাগী হিসাবে তাঁর সাথে দেখাও করেছিলেন। পরে সেই শিল্পী যখন বলিউডের বিখ্যাত ‘আওয়ারা’ সিনেমা এবং এর নায়ক রাজ কাপুরের প্রশংসা করছিলেন, তাতে নিমেষেই শিল্পীর প্রতি অন্নদাশংকরের সমস্ত আগ্রহ কর্পূরের মতো বিলীন হয়ে গিয়েছিল। সিনেমাটি ভারতের তৎকালীন শিল্পরসিকদের কাছে যে নিকৃষ্ট রূচির ছিল লেখকের প্রকাশে তা খুব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
জানা অজানা জাপান বইয়ের রচয়িতা প্রায় তিরিশ বছর থেকে এখন পর্যন্ত জাপানে বসবাসকারী প্রবীর বিকাশ সরকার। জাপানে রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণ, জাপানি সংস্কৃতি ও সাহিত্য বিষয়ে বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। জাপান সম্পর্কে বাংলা ভাষায় যারা লেখালেখি করেন প্রবীর বিকাশ সরকার তাঁদের মাঝে প্রথম সারির। আমার আলোচ্য গ্রন্থটি বইয়ের তৃতীয় খণ্ড। ২৫টি প্রবন্ধ ও সাক্ষাতকারের সমাহার ২৭২ পৃষ্ঠার বইটি ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়েছে ২০১৫ সালে।
এতো দীর্ঘ সময় জাপানে বাস করার ফলে যে বইটি লিখেছেন তাঁকে সম্ভবতঃ ভ্রমণকাহিনি বলা যায় না। কিন্তু তিনি দেশটি সম্পর্কে যে যে তথ্য দেবেন সেগুলোকে অন্যান্যদের চেয়ে নির্ভরযোগ্য বলে আশা করা যায়। বইয়ের কয়েকটি প্রবন্ধ সম্পর্কে ঠিক আমার তেমনই ধারণা হয়েছে। ‘জাপানের ধর্মীয় বৈচিত্র্য’ নামে বিশাল প্রবন্ধে তিনি দেশটির ধর্মীয় আচার নিয়ে এতো গভীর আলোচনা করেছেন যে তাকে অনেকটা গবেষণামূলক মনে হয়েছে। সেদেশে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি মোটেই নেই শুধু নয়, আমি একনাগাড়ে দীর্ঘ প্রায় সাড়ে চার বছর বাস করেও যা জানতে পারিনি, এই প্রবন্ধটি পড়ে অনেকটাই জেনেছি। যেমন, আমি হিয়ে পর্বতের পাদদেশে বাস করে এবং পর্বতে অবস্থিত এনরিয়াকুজি বৌদ্ধমন্দির কয়েকবার দর্শন করে থাকলেও মন্দিরটি সম্পর্কিত যে যে তথ্য তিনি দিয়েছেন তাতে সত্যি বিস্মিত হয়েছি।
একইভাবে লেখক মিশিমা ইউকিও-র জীবনভিত্তিক প্রবন্ধটি শুধু তার একার আত্মহত্যা ও সাহিত্যের আলোচনাই নয়, আরো অন্ততঃ পঞ্চাশজন জাপানি কবি-সাহিত্যিকের অত্যন্ত নিষ্ঠুর কিন্তু স্বেচ্চামৃত্যুর তথ্য পাঠককে স্তব্ধ করে দেয়। কয়েকশত বছর পূর্ব থেকে প্রচলিত ঘোষণা দিয়ে, অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নিজের পেটে ধারালো ছুরি চালিয়ে আত্মহত্যা করাকে জাপানি ভাষায় ‘হারা-কিরি’ বলা হয় – হারা অর্থ পেট, কিরি অর্থ কাটা। নিজ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে অথবা অভীষ্টে পৌঁছাতে ব্যর্থ হলে প্রাচীনকালে এভাবে আত্মহত্যা করাটা ব্যক্তি ও সমাজের জন্য সম্মানজনক বলে মনে করা হতো। কিন্তু এই আধুনিক সমাজেও ব্যর্থতার গ্লানি কী পর্যায়ে পৌঁছালে মানুষ তা করতে পারে, তা ভাবলে অবাক হতে হয়। আমার আলোচিত পরের ‘জাপান কাহিনি’ থেকে আরো জানতে পারি জাপানে বছরে ৩৩০০০ আত্মহত্যাকারীদের মাঝে অধিকাংশ সকাল ৮-১০টার মাঝে চলন্ত ট্রেনের নিচে তাঁদের জীবনাশন ঘটায়! অন্যদিকে ঘটনার সাড়ে পাঁচ মিনিটের মাঝে মৃতদেহাবশেষ সরিয়ে ট্রেন চালু করতে ১০ কোটি টাকার বিলটি মৃতের পরিবারের হাতে ধরিয়ে দেয়!
বইয়ের আরেকটি বিশেষত্ব হচ্ছে জাপানে বাংলাদেশ সম্পর্কিত যেসব লেখা বা তথ্য তিনি পেয়েছেন, পরম মমতায় লেখক তা তুলে ধরেছেন। শুধু তাই নয়, সেই বিশেষ লেখা বা কাজের সাথে সম্পর্কিত মানুষটির বিস্তারিত পরিচিতিও আমাদের জানিয়েছেন। এঁদের মাঝে রয়েছেন সাড়ে পাঁচশত পৃষ্ঠার বিশাল ‘বাংলাদেশের ইতিহাসঃ দু হাজার বছরের পথচলা ও আগামী দিনের উদ্দেশ্যে আনাড়ি অনুসন্ধান’ বইয়ের রচয়িতা বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করা রাষ্ট্রদূত হোরিগুচি মাতসুশিরো, মহিলা কবি শিরাইশি কাজুকো, একাত্তরে রেডক্রসের কাজে বাংলাদেশে নিয়োজিত ফুকিউরা তাদামাসা, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে শ্রম ও নিজের অজস্র অর্থ দিয়ে সাহায্য করা তানাকা তোশিহিসা এবং আরো অনেকে। এ প্রসঙ্গে একটি তথ্য জাতি হিসাবে আমাদের গুরুত্ব সহকারে স্বীকৃতি দেয়া ও প্রচার করা উচিৎ। তা হচ্ছে ‘জাপান একটি পুরনো বিমানবহর ডিসি-টেন বাংলাদেশকে উপহার দিয়েছিল সেটা দিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের’ (পৃ৪৫)।
আরেকটি তথ্যবহুল ও প্রয়োজনীয় প্রবন্ধ হচ্ছে ‘জাপান বাংলাদেশ সম্পর্কের পটভূমি’। সেখানে ৭ম শতাব্দীর চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়ান সাং এর বাংলা ভ্রমণের জাপানি অনুবাদ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত যে যে জাপানি ও বাঙালি পারস্পরিক দেশ ভ্রমণ করেছেন তার উল্লেখ রয়েছে। ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও জাপানি ও বাংলা ভাষার শব্দ ও কাঠামোগত সামঞ্জস্য নিয়ে আলোচনাটি বেশ কৌতুহল উদ্দীপক। আমার নিজের সীমিত ভাষাজ্ঞান নিয়ে জাপানি ও বাংলা ভাষার আরেকটি সামঞ্জস্যের কথা আমি আমার ‘নিহনজিন’ ভ্রমণ কাহিনিতে আলোচনা করেছি। কিন্তু লেখক প্রবীর বিকাশ সরকারের দেয়া আরেকটি তথ্য দেখে সবচেয়ে বেশি চমৎকৃত হয়েছি। আলোচনায় না গিয়ে তার বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়েই এই প্রংগের ইতি টানবো। ‘বাঙালিদের চেয়ে জাপানিদের বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি যে গভীর আগ্রহ বিদ্যমান তা আশ্চর্য করে বৈকি! যেমন দুটি জাপানি ভাষার ম্যাগাজিন মূলত বাংলা সাহিত্য নির্ভর ‘কল্যাণী’ ও ‘সোওকা/উজানযাত্রী’ অনিয়মিতভাবে অনেক বছর ধরে প্রকাশিত হচ্ছে। ‘কল্যাণী’ এখনও প্রকাশিত হয়ে চলেছে। সেটাতে পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি পূর্ববঙ্গের সাহিত্যও অনূদিত হয়ে আসছে। আর উজানযাত্রী সম্পূর্ণই পূর্ববঙ্গীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক। এমন উদাহরণ বিদেশের আর কোন দেশে আছে?’ (পৃ৫৫)।
ফিরে দেখা জাপান বইয়ের লেখক সৈয়দ মাহতাব আহমেদ, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মনোবিজ্ঞান চিকিৎসক ও শিক্ষক। লেখকের প্রথম প্রকাশিত বই। দীর্ঘ দশ বছর জাপান বাসের ২৫ বছর পর পুনরায় জাপান ভ্রমণ নিয়ে লিখেছেন ও প্রকাশ করেছেন ২০১৯ সালে ঢাকা থেকে। লিখেছেন, ‘স্মৃতি নিউরন থেকে বেরিয়ে আসলে তার গতি হয় দূর্বার’। এই গতিতেই তিনি আগেকার দশ বছরের মূলত স্মৃতিচারণমূলক প্রায় ৩০টি ছোটো ছোটো রচনায় তাঁর যাপিত জীবন ও জাপানি সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন। ‘জাপানে’ বইতে অন্নদাশংকর রায়ের মতো বিষদ না হলেও জাপানের ঐতিহ্যবাহী ‘কাবুকি’ মঞ্চ নাটকের বিবরণে কিছু নতুন তথ্য পাওয়া যায়। লেখক নিজেও এক কাবুকি নাটকে অভিনয় করেছিলেন বলে জানিয়েছেন। প্রায় শেষদিকে ‘ঐতিহ্যের পূজারি জাপান’ বইয়ের একটি চমৎকার এবং একমাত্র প্রবন্ধ। সেখানে একটিমাত্র বাক্যে উপসংহার টেনেছেন এইভাবে – ‘ইতিহাস আর ঐতিহ্যকে সাবধানে, সজ্ঞানে আর নিখুঁতভাবে হাতে ধরে সর্বদা বর্তমানে চলার যে মহৎ এবং সাফল্যজনক প্রচেষ্টা সেটাকেই শুধুমাত্র আমি জাপানের অনন্য বলব।‘
এই বইয়ের বিশেষত্ব হচ্ছে স্বল্প কথার সাথে বুদ্ধিমত্তার মিশেলে লেখাগুলো আকর্ষণীয় করে তোলা। বাহুল্যবর্জিত হলেও লেখকের সূক্ষ্ম রসবোধ সাবধানী পাঠকের দৃষ্টি এড়াতে পারে না। তার বর্ণনায় কৌতুকের পরশও বেশ স্পষ্ট। একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। লেখকের স্ত্রী প্রথম সন্তান প্রসবের বেদনার চাইতেও জাপানি ডাক্তার-নার্সদের শুশ্রূষার কথাই বেশি মনে রেখেছে বলে লিখেছেন! অপরদিকে জাপান ও পার্শবর্তী দেশের সততার সাথে আমাদের অসততার তুলনা করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘দুনিয়াটা আসলেই তাজ্জবের জায়গা।…এক ইমানদার দেশের বিমানের সাথে, যে আমাদের দেশে ইমান রফতানি করতে চেয়েছিল ক্লাইভের স্টাইলে’। তবে অপরিচিত পাঠকের কাছে রসের সাথে বিষয়ের সম্পর্ক সবসময় বোধগম্য নাও হতে পারে।
আবেগের বিচারে বইয়ের দুটি রচনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রথমটি হচ্ছে একমাত্র দুখী, হিজরা সন্তানের আত্মহননের অনুরণনে লেখকের এক নিকটতম জাপানি বন্ধু ও বন্ধুপত্নী যুগলের আত্মত্যাগের ঘটনা। হৃদয়বিদারক এই ঘটনা বিবৃত করেই লেখক থেমে যাননি, ‘হারাকিরি’ নামে পরিচিত জাপানি এই আত্মহননের পরিসংখ্যান, সামাজিক, ঐতিহাসিক, মনস্তাত্বিক ব্যখ্যাও দিয়েছেন, যার কিছুটা উপরোক্ত ‘জানা অজানা জাপান’ বইতেও আমরা পেয়েছি। অপর উল্লেখযোগ্য লেখাটিও হচ্ছে মৃত্যু সম্পর্কীয়। মৃত্যু আসন্ন জানতে পেরে লেখকের পিতৃসম জাপানি অভিভাবক কী দৃঢ়তার সাথে অবশিষ্ট দিনগুলি সবার জন্য আনন্দ ও গৌরবময় করে তুলেছিলেন, তার বর্ণনা। এছাড়া জাপানি সংস্কৃতিতে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার বর্ণনাটিও নতুনত্বের দাবি রাকে। পরের ‘জাপান কাহিনি’ বইতেও মৃত্যু সম্পর্কিত অনুরূপ একটি কাহিনি ও একটি নিবন্ধ আছে, কিন্তু দুটির পাত্র-পাত্রী ও ঘটনা-বিন্যাস সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং দুই লেখকের রচনাশৈলীও ভিন্ন, কিন্তু আকর্ষণীয়।
স্মৃতিময় নিপ্পন – লিখেছেন ও ২০২১ সালে ঢাকার অনন্যা থেকে প্রকাশ করেছেন ডঃ নূরুন নবী, মূলত বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসাবেই যিনি অধিক পরিচিত। বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে প্রায় দশটি বই তাঁর রয়েছে। আলোচিত পূর্বোক্ত ‘ফিরে দেখা জাপান’ বইয়ের মতোই এই বইটি তাঁর ছয় বছর জাপান বাসের স্মৃতিচারণ। তবে এই বইতে মাঝে মাঝেই উঠে এসেছে বাংলাদেশ ও বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস। প্রায় সব লেখকের মতো তিনিও গণস্নানাগারে বিড়ম্বনার অভিজ্ঞতা লিখেছেন। অন্যান্য বই থেকে এই বইয়ের নতুন সংযোজন হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শ্রমিক হিসাবে আনা কোরিয় নাগরিক এবং তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের প্রতি জাপানিদের বৈষম্যমূলক আচরণ। ধারণা করি ব্যাপারটি অনেকটা বাংলাদেশে বিহারিদের প্রতি আমাদের যে আচরণ, অনেকটা তেমন। তাঁর লেখার বিশেষত্ব হচ্ছে সহজ সরল ভাষার সাবলীলতা ও ঝরঝরে বর্ণনা।
ওপরে বর্ণিত জাপান সম্পর্কিত পাঁচটি বইয়ের লেখকের সবার বিচরণ ছিল মধ্য জাপান, মূল ভূখণ্ডের প্রধান তিনটি দ্বীপের মাঝের হনসু দ্বীপে। কাজেই তাঁদের বিবরণে অন্যান্য দ্বীপের বিবরণ প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্তু ডঃ নূরন নবী এবং পরবর্তী ‘জাপান কাহিনি’র লেখক আসির আহমেদ দুজনেই জাপান বাসের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন দক্ষিণের কিউসু দ্বীপে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আনবিক বোমায় বিধ্বস্ত নাগাসাকি শহরটি এই কিউসু দ্বীপেই অবস্থিত। ফলে দুজনের লেখাতেই একটি জীবন্ত আগ্নেয়গিরি ধারণ করা এই দ্বীপের ভৌগলিক এবং ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক বৈশিষ্টের ধারণা পাওয়া যায়। স্থানীয় দাইজফু-তেন্মাগু শিন্তো মন্দির ভ্রমণে গিয়ে লেখক সুন্দর একটি গল্প বলেছেন। মিসিজানে সুগাওয়ারা নামে এক মেধাবী ছাত্র কিয়োতোর রাজরোষে পতিত হয়ে একটী ষাঁড়-চালিত শকটে করে কিউসুর ফুকুওকা শহরের সন্নিকটে বনবাসে প্রেরিত হয়েছিলেন। কিন্তু রাজপরিবারটি কয়েকটি অলৌকিক দুর্ঘটনার শিকার হলে শাস্তিপ্রাপ্ত মিসিজানে সুগাওয়ারা-কে ঐশ্বরিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত পণ্ডিত বলে গণ্য করতে থাকেন। রাজার নির্দেশেই প্রায় এগারো শত বৎসর পূর্বে একটি ষাঁড়ের মূর্তিসহ এখানে মন্দিরটি স্থাপন করা হয়। প্রথাটি পুরনো হলেও আধুনিক জাপানের ছাত্রছাত্রীরাও ভালো ফল করার মানসে পরীক্ষার আগে এই মন্দিরে পণ্ডিত-দেবতার আশীর্বাদ নিতে আসে।
জাপান কাহিনির দুটি খণ্ড আমি পড়েছি। এর লেখক আশির আহমেদ একজন তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, ১৯৮৮ সাল থেকে একনাগাড়ে জাপানেই অবস্থান করছেন। সেই প্রথমবার জাপানে যাওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত জাপানি যে যে বিষয়গুলো তার কাছে অভিনব, নতুন, কৌতুকপূর্ণ বা উল্লেখযোগ্য মনে হয়েছে সেসব ছোটো ছোটো বাক্যে, এক বা দুই পৃষ্ঠার গল্প বা প্রবন্ধাকারে লিখেছেন। দুটি বইই সহজপাঠ্য বিধায় কোনো কষ্ট না করে ঘণ্টা দুয়েকের মাঝে শেষ করা যায়, অনেকটা প্রয়াত লেখক হুমায়ুন আহমেদের বই পড়ার মতো। একটি বর্ণনায় তাঁর প্রিয় হুমায়ুন আহমেদ সম্পর্কে নিজেই লিখেছেন, ‘খুঁটে খুঁটে ওনার সাথে আমাদের মিল খুঁজে বের করতাম। কোথায় আশির আহমেদ আর কোথায় হুমায়ুন আহমেদ’। শুধু তাই নয়, হুমায়ুন আহমেদ এবং তাঁর অনেকগুলো চরিত্র অসংখ্যবার দেখা দিয়েছে এই বইতে!
১১৩ বছর পূর্বে হরিপ্রভা তাকেদা তার উপরে বর্ণিত ‘বঙ্গমহিলার জাপান যাত্রা’ বইতে যেমন লিখেছেন, আশির আহমেদ তার ‘জাপান কাহিনি’তে বিদেশির প্রতি জাপানিদের, বিশেষ করে ছোটোদের আগ্রহের কথা কৌতুকের মিশ্রণে বর্ণনার সময় জাপানিদের আন্তরিক আতিথেয়তার দিকটিও ফুটিয়ে তুলেছেন। বিষয়টি নিয়ে সাম্প্রতিক লেখায় আমি নিজেও এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
সৎকারের পর পিতৃসম এক ব্যক্তির অবশিষ্ট ছাইয়ের বাক্স শেষবারের মতো হাতে নিয়ে এর ওজন কত তা প্রকাশ করেছেন এক গভীর মর্মবেদনার ভাষায়। লিখেছেন, ‘বাক্সটির ভর হয়তো কয়েকশ গ্রাম ছিল। কিন্তু ওজন (ভর X g) যে কত ছিল তা বুঝাতে পারব না। এই g তো আর মাধ্যাকর্ষণের আকর্ষণ না। এই আকর্ষণ তৈরি হয়েছিল ২২ বছরে, কত দয়ার, কত মায়ার, কত অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একটা জলজ্যান্ত মানুষ ৩৫ মিনিটে ছাই হয়ে গেল?
বিভিন্ন উদাহরণ সহ ‘সামাজিক শিক্ষা’ নিবন্ধে জাপানি চরিত্রের অসামান্য যেসব দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন, আমার এই আলোচনার সব ক’টি বইতেই বিভিন্নভাবে তা তুলে ধরা হয়েছে। ১১৩ বছর পূর্বে শিশুশিক্ষার যে পদ্ধতি হরিপ্রভা তাকেদা প্রত্যক্ষ করেছিলেন, আশির আহমেদ তাঁর বিস্তার ঘটিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষায় প্রতিটি নাগরিকের মাথায় সামাজিক দায়িত্ববোধ কীভাবে ঢুকিয়ে দেয়া হয় তা আলোচনা করেছেন।
বইয়ের প্রথম খণ্ডটিতে সুক্ষ্মরসবোধের ছোঁয়া থাকলেও দশম খণ্ডে তার লেশমাত্র নেই। সেখানে বাঙালিদের কাছে যেসব সংবাদ, আধুনিক তথ্য ও প্রযুক্তি সম্পর্কে আকর্ষণীয় হতে পারে তা অনেকটা টেকনিক্যাল নোটের আদলে পরিবেশন করা হয়েছে।
২০শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫