‘একাত্তরের জেনোসাইডের জাতিসংঘের স্বীকৃতি বেশি দূরে নয়’

এ স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হবে আন্তর্জাতিক সম্মেলন।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 May 2023, 01:48 PM
Updated : 21 May 2023, 01:48 PM

একাত্তরে বাংলাদেশের মানুষের উপর পাকিস্তানিদের বর্বরতাকে ‘জেনোসাইড’ হিসেবে জাতিসংঘের স্বীকৃতি পেতে আর বেশি অপেক্ষা করতে হবে না বলে মনে করছেন ডাচ রাজনীতিক হ্যারি ফন বোমেল।

তিনি বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশের বিরোধিতা করায় একাত্তরে জেনোসাইডের স্বীকৃতি পেতে দেরি হচ্ছে। তবে এখন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা বাংলাদেশে সংঘটিত জেনোসাইডকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। খুব শিগগিরই জাতিসংঘ থেকেও এ স্বীকৃতি আদায় সম্ভব হবে।

রোববার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। সোমবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠেয় ‘বাংলাদেশে জেনোসাইডের স্বীকৃতি অর্জনের জন্য আন্তর্জাতিক সম্মেলন’ উপলক্ষে এ সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করা হয়।

নেদারল্যান্ডসের সাবেক এমপি বোমেল বলেন, “ভুক্তভোগী এবং তাদের পরিবারের জন্য গণহত্যার স্বীকৃতি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা ১৯৭১ সালে গণহত্যার শিকার ব্যক্তিদের পরিবার, সাক্ষী, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলব। এছাড়া বিভিন্ন গণহত্যার স্থান পরিদর্শন করব।

“এখান থেকে প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে নেদারল্যান্ডসে গিয়ে আমরা এই গণহত্যার স্বীকৃতির জন্য আবেদন করব, প্রচারও চালাব। এছাড়া গণহত্যার সাক্ষীদের ডাচ পার্লামেন্টে নিয়ে গিয়ে তাদের বক্তব্য তুলে ধরব।” 

আমস্টারডাম ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. অ্যান্থনি হোলস্ল্যাগ বলেন, “এই জেনোসাইডকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারকে চাপ প্রয়োগ করতে হবে। আর ঠিক সেই কারণে এই বিষয়ে বৈজ্ঞানিক আলোচনা প্রয়োজন।”

সুইস ইন্টারস্ট্যাটেজি গ্রুপের কমিউনিকেশন ডিরেক্টর ক্রিস ব্ল্যাকবার্ন বলেন, “আমাদের লক্ষ্য হলো, ১৯৭১ সালে এদেশে কী হয়েছিল- সেটা জেনে বিশ্বের কাছে তা তুলে ধরা। একইসঙ্গে এই জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি কেন প্রয়োজন, সে ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মহলকে অবহিত করা।”

বাঙালির মুক্তির আন্দোলনের শ্বাসরোধ করতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে এ দেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের সেই অভিযানে কালরাতের প্রথম প্রহরে ঢাকায় চালানো হয় গণহত্যা।

২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান; শুরু হয় বাঙালির প্রতিরোধ পর্ব।

নয় মাসের যুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান, আড়াই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি এবং জাতির অসাধারণ ত্যাগের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সেই বর্বর হত্যাযজ্ঞে নিহতদের স্মরণে ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের প্রস্তাব ২০১৭ সালে জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়। তখন থেকেই এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ।

একাত্তরে বাংলাদেশিদের উপরে পাকিস্তানিদের নির্মম হত্যাযজ্ঞকে ইতিমধ্যে ‘জেনোসাইড’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান ‘লেমকিন ইনস্টিটিউট ফর জেনোসাইড প্রিভেনশন’, আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘জেনোসাইড ওয়াচ’ এবং গণহত্যা বিশেষজ্ঞদের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলার্স (আইএজিএস)। 

রোববারের সংবাদ সম্মেলনে সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য আরমা দ্ত্ত বলেন, “এত বছর পর আমরা শহীদ পরিবারের তরফে ১৯৭১ সালে সংঘটিত জেনোসাইডের জাতিসংঘের স্বীকৃতি পেতে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছি, কারণ এটি পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ জেনোসাইডের একটি।” 

একাত্তরের জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায়ে যারা বাংলাদেশ সফর করছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে তুলেছেন। আমরা অত্যন্ত সম্মানিত এবং আনন্দিত যে জেনোসাইডের বিষয়টিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে... আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে বলতে পারি যে সবচেয়ে খারাপ জেনোসাইডের স্বীকৃতি দেওয়া উচিত এবং অবশ্যই স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।”

আরমা দত্ত বলেন, “জাতিসংঘ আমাদের ওপর চালানো জেনোসাইডের স্বীকৃতি দিতে ও এর বিচার করতে বাধ্য। আমাদের এই বিষয়কে আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরতে হবে এবং জাতিসংঘ থেকে এই গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ে আমাদের কাজ করতে হবে।” 

জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, “১৯৭১ সালে যে ভয়াবহ গণহত্যা হয়েছিল, তা করা হয়েছিলো এই জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য। মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যার সব তথ্য-প্রমাণ আমাদের আছে, সেগুলো জেনোসাইডের স্বীকৃতি পাওয়ার সকল শর্ত পূরণ করে। সুতরাং এই জেনোসাইডের স্বীকৃতির জন্য আমাদের দাবি অযৌক্তিক নয়।”

ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ ফোরামের সভাপতি বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া বলেন, “বাংলাদেশেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ বিপক্ষ নিয়ে বিপরীতমুখী রাজনীতি আজও চলমান, যা জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায়ে বাধা সৃষ্টি করছে।” 

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সোমবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আব্দুল মতিন ভার্চুয়াল ক্লাসরুমে প্রজন্ম’৭১, আমরা একাত্তর ও ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ ফোরামের (ইবিএফ) যৌথ উদ্যোগে জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায়ে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। 

এ আয়োজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান, পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ, গণহত্যা জাদুঘরের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, গণহত্যা গবেষক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাজী সাজ্জাদ আলী জহির (বীর প্রতীক), মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক, সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের মহাসচিব হারুন হাবীব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন অন্যদের মধ্যে বক্তৃতা করবেন। 

সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে ইবিএফের কো-প্রেসিডেন্ট আনসার আহমেদ উল্লাহ বক্তব্য রাখেন।

 আরও পড়ুন

Also Read: ৭১ এ বাঙালি হত্যাকাণ্ডকে ‘জেনোসাইড’ ঘোষণা করল আইএজিএস

Also Read: একাত্তরের জেনোসাইডের স্বীকৃতি দিতে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে প্রস্তাব

Also Read: একাত্তরের জেনোসাইডকে স্বীকৃতি দিল আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘জেনোসাইড ওয়াচ’

Also Read: একাত্তরের গণহত্যার স্বীকৃতি এল যুক্তরাষ্ট্র থেকে