ডিপো কর্তৃপক্ষের ‘দায়’ পায়নি ডিবি; অথচ সরকারি তদন্ত কমিটি তাদেরও দায়ী করেছিল।
Published : 09 May 2023, 12:05 AM
চট্টগ্রামের বিএম কন্টেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণে অর্ধশত মানুষের মৃত্যুর ঘটনায় ডিপো কর্তৃপক্ষের ‘দায় খুঁজে না পেয়ে’ যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন পুলিশ দিয়েছিল, তা গ্রহণ করেছে আদালত।
ফলে এ ঘটনায় বিএম ডিপোর যে ৮ কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়েছিল মামলায়, তারা সবাই অব্যাহতি পেয়েছেন।
সোমবার চট্টগ্রামের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল্লাহ খানের আদালতে পুলিশের জমা দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়। সেটি দেখে গ্রহণের আদেশ দেন বিচারক।
চট্টগ্রাম জেলা আদালতের পিপি শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ফলে মামলার আসামিরা সবাই অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পাচ্ছেন।”
তিনি বলেন, “এ ঘটনায় আর কোনো সরকারি সংস্থার তদন্ত কার্যক্রম থাকলে সেটা হয়ত চলবে। তবে ফৌজদারি আর কোনো কার্যক্রম আপাতত আর চলবে না।”
গত বুধবার ‘কারও দায় না পাওয়ার’ কথা জানিয়ে চট্টগ্রামের মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল জেলা গোয়েন্দা পুলিশ।
অথচ ঘটনার পর অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে গঠিত প্রশাসনের তদন্ত কমিটি বলেছিল, মালিকপক্ষ এবং তদারকির দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলো ওই ঘটনার দায় এড়াতে পারে না।
সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপো মালিকদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
রাসায়নিকের কথা পরিবেশ অধিদপ্তরকেও ‘বলেনি’ বিএম কন্টেইনার ডিপো
বিএম ডিপোর অগ্নিকাণ্ডে কারও ‘দায় পায়নি’ পুলিশ, আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন
গত বছর ৪ জুন রাতে সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি ইউনিয়নের কেশবপুর গ্রামে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে আগুন লাগার পর একের পর এক বিস্ফোরণে তা ছড়িয়ে পড়ে। ডিপোতে থাকা রাসায়নিকের কারণে ছড়িয়ে পড়া ওই আগুন ৮৬ ঘণ্টা পর বিভিন্ন বাহিনীর চেষ্টায় নেভানো হয়।
ওই ঘটনায় অর্ধশত মানুষের মৃত্যু হয়, আহত হন দুই শতাধিক মানুষ। অগ্নিকাণ্ডের এক মাস পরও সেখান থেকে পোড়া হাড়গোড় উদ্ধার করা হয়।
বিস্ফোরণের তিন দিন পর ৭ জুন রাতে সীতাকুণ্ড থানার দণ্ডবিধির ৩০৪ (ক) ধারায় একটি মামলা করেন এসআই আশরাফ সিদ্দিকী।
ডিপোর ডিজিএম (অপারেশন) নুরুল আকতার, ম্যানেজার (অ্যাডমিন) খালেদুর রহমান, সহকারী অ্যাডমিন অফিসার আব্বাস উল্লাহ, সিনিয়র এক্সিকিউটিভ মো. নাসির উদ্দিন, সহকারী ব্যবস্থাপক (ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো) আবদুল আজিজ, কন্টেইনার ফ্রেইট স্টেশনের ইনচার্জ সাইফুল ইসলাম, একই বিভাগের নজরুল ইসলাম ও জিএম (সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং) নাজমুল আকতার খানকে সেখানে আসামি করা হয়েছিল।
সীতাকুণ্ড থানা পুলিশ প্রথমে মামলাটি তদন্ত করলেও পরে তদন্তভার পায় চট্টগ্রাম জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। এ ঘটনায় প্রশাসনের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল।
এর মধ্যে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটি গতবছর ৬ জুলাই প্রতিবেদন দেয়। সেখানে বলা হয়, বেসরকারি ওই কনটেইনারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মালিকপক্ষ এবং তদারকির দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলো দায় এড়াতে পারে না।
অগ্নিকাণ্ডের পর বিভিন্ন সংস্থার পরিদর্শনে ওই ডিপোতে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড থাকার বিষয়টি উঠে আসে। বিএম ডিপোর মূল প্রতিষ্ঠান স্মার্ট গ্রুপের সহযোগী আল রাজী কেমিকেল কমপ্লেক্স থেকে এসব রাসায়নিক বিদেশে রপ্তানির জন্য সেখানে রাখা ছিল।
প্রশাসনের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই হাইড্রোজেন পার অক্সাইডই ডিপোতে ‘আগুনের উৎস’।
চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার বিষয়ে শুক্রবার চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার এসএম শফিউল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “আমাদের তদন্তে আমরা দেখেছি এটা ‘মিসেটক অব ফ্যাক্ট’। ঘটনা যেটা ঘটেছে সেটার সাথে যারা আসামি, তারা কেউ সংশ্লিষ্ট না। এটা একটা নিছক বিস্ফোরণ।
“বাকিটা আদালতের বিষয়। আদালত যদি সেটিসফাইয়েড না হয়, তাহলে নারাজি দিতে পারবে, অন্য কোনো সংস্থাকে পুনঃতদন্ত করতে দিতে পারে।”
পুলিশ সুপার শফিউল্লাহ বলেন, “তদন্তে আমাদের কাজটা ছিল কোনো ‘ক্রিমিনাল অফেন্স’ হয়েছে কিনা, কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে কি না কিংবা কোনো ‘ইল মোটিভ’ ছিল কি না, সেটা দেখা।
“এখানে দেখা গেছে এটা ‘মিসটেক অব ফ্যাক্ট’। যাদের আসামি করা হয়েছে তারা কেউ ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট না। এটা নিছক একটা বিস্ফোরণ। যেখানে বিস্ফোরক রাখা হয়েছে, সেখানে টেকনিক্যাল ফল্ট থাকতে পারে। এগুলো দেখার আলাদা সংস্থা আছে, তারা প্রতিবেদন দেবে।”
পুলিশ সুপার বলেছিলেন, “যার যেটা দেখার দায়িত্ব না, তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া আইনে পারমিট করে না। আমাদের তদন্তেও সেটা আসেনি।”
চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার আগে পিপি হিসেবে তাকে দেখানোর বিধান থাকলেও তাকে না দেখিয়েই এটি আদালতে জমা দেওয়া হয় বলে জানিয়েছিলেন পিপি শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী।
বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রাম আদালতের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আকতার কবির চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে বলেই আদালত তা গ্রহণ করেছেন। আদালতের আদেশের বিষয়ে কিছু বলার নেই।
“তবে ইতিপূর্বে এই ঘটনার বিষয়ে বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয় এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের করা দুটি তদন্ত প্রতিবেদনে গাফিলতির বিষয়টা এসেছিল। সে দুটি প্রতিবেদনে এসেছে- এটা অবহেলাজনিত ঘটনা, কোনো দুর্ঘটনা নয়। এটা গোডাউন নয়, কন্টেইনার ডিপো। যাদের রাসায়নিক পণ্য রাখা হয়েছিল তাদেরই ডিপো। তারা ফায়ার সার্ভিসকেও তথ্য দেয়নি যে সেখানে রাসায়নিক ছিল।”
আইনজীবী আকতার কবীর চৌধুরী বলেন, “এখন যদি পুলিশের চূড়ান্ত প্রতিবেদন সত্যি ধরে নিই, তাহলে আগের দুটি সরকারি সংস্থার প্রতিবেদন কী মিথ্যা?
“শুরু থেকে ঘটনা প্রবাহে লক্ষ্য করছি, বিএম ডিপোর মালিকপক্ষের হাত অনেক লম্বা। শুধু কয়েকজন কর্মচারী কেন আসামি হয়েছিল মামলায়? পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গিয়েছিল কেন? তাহলে এরআগে তাজরীন গার্মেন্টসসহ অন্য ঘটনায় মালিকরা কেন আসামি হয়েছিল? তারা আসামি হলে বিএম ডিপোর ক্ষেত্রে নয় কেন?”
বিএম ডিপোর ঘটনায় নিহত ও আহতদের পরিবারের সদস্যরা মামলা করতে পারবেন জানিয়ে আকতার কবীর চৌধুরী বলেন, “আইনে নতুন করে মামলার বিধান আছে। এক্ষেত্রে পুলিশের করা মামলাটি তদন্তাধীন থাকায় বিলম্ব হয়েছে। এতে আইনগত কোনো সমস্যা হবে না।”