ফেইসবুক পোস্টের পর ঘটনা তদন্তে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে।
Published : 23 Sep 2022, 07:48 PM
চুলে বিশেষ ধরনের বেণি করায় কাবাডি দলের কয়েকজন ছাত্রীকে প্রধান শিক্ষিকার ‘মারধরের’ প্রতিবাদে মাথা ন্যাড়া করেছেন; পরে সেই ছবি ফেইসবুকে পোস্ট করে ঘটনা তুলে ধরেছেন চট্টগ্রামের একটি স্কুলের ক্রীড়া শিক্ষিকা।
সাফ শিরোপা জয়ী নারী ফুটবল দলকে নিয়ে দেশজুড়ে উচ্ছ্বাসের মধ্যে এমন খবর সামনে এসেছে।
চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গীবাজার ব্যাপটিস্ট মিশন রোডে ‘এয়াকুব আলী দোভাষ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের‘ এমপিওভুক্ত সহকারী শিক্ষিকা ও কাবাডি দলের কোচ জাহিদা পারভীন বৃহস্পতিবার রাতে ফেইসবুকে ন্যাড়া মাথার ছবি দিয়ে ব্যতিক্রমী প্রতিবাদ জানানোর বিষয়টি প্রকাশ্যে আনেন।
গত ৬ থেকে ১৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যে শিক্ষার্থীদের মারধর ও তার মাথা ন্যাড়া করার ঘটনা ঘটে।
জাহিদার দাবি, ফ্রেঞ্চ বেণি করায় প্রধান শিক্ষিকা নীপা চৌধুরী স্কুলের কাবাডি দলের কয়েকজন ছাত্রীকে চুল টেনে মারধর করেন। সেই ক্ষোভ ও বেদনা থেকে প্রতিবাদ জানাতে তিনি বাসার পাশে সেলুনে গিয়ে মাথা ন্যাড়া করেন।
ফেইসবুক পোস্টের পর এ ঘটনা জানাজানি হলে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে প্রধান শিক্ষিকা নিপা চৌধুরীর দাবি, ফ্রেঞ্চ বেণি করার জন্য ছাত্রীদের কাউকে মারধর করা হয়নি। কাবাডি খেলতে যাবার আগে স্কুলের খেলোয়াড়দের সঙ্গে হাসিমুখে ছবিও তুলেছেন তিনি।
এদিকে ক্ষোভ জানিয়ে শিক্ষিকা জাহিদা পারভীন স্কুলের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি বরাবর ‘বিমুক্তিকরণ পত্র’ (পদত্যাগ) দিয়েছেন। আবেদনপত্র গ্রহণ করে তাকে বিদ্যালয়ে না আসার জন্য প্রধান শিক্ষক জানিয়েও দিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার রাতে প্রতিবাদী ওই শিক্ষিক ফেইসবুকে লেখেন, ‘‘স্কুলের মেয়েদের মাসখানেক কষ্ট করে খেলা শিখিয়ে মাঠে নিতে যাওয়ার আগের দিন তাদের ফ্র্যান্স বেণি করে ছবি তোলা ও খেলতে যাওয়ার অপরাধ আমার স্কুলে হেড মাস্টার মেয়েদের চুল ধরে মারা ও বকার প্রতিবাদে নিজের মাথার চুল ফেলে দিয়েছি। খুব কি খারাপ দেখা যাচ্ছে?
“পুনশ্চঃ আমার মেয়েরা খেলার মাঠে খেলতে নামার অনুমতি পায়নি। স্কুলের সভাপতি আবার বর্তমানে চট্টগ্রামের সিডিএর চেয়ারম্যান এবং স্কুলটি উনার বড় আব্বার নামে।’’
এ বিষয়ে শুক্রবার নগরীর বায়েজিদ থানাধীন কুঞ্জছায়া আবাসিক এলাকায় সহকারী শিক্ষিকা জাহিদা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘জাতীয় স্কুল ও মাদ্রাসা কারিগরী শিক্ষা বোর্ডের অধীনে কোতয়ালী অঞ্চলের গ্রীষ্মকালীন খেলায় কাবাডিতে অংশ নেওয়ার জন্য অনুমতি নিয়ে টিম তৈরি করি। স্কুলের ১৩ জন ছাত্রীকে নিয়ে দল করা হয়।’’
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ৭ সেপ্টেম্বর স্কুলের মডেল টেস্টের পর দলের জার্সি পড়ে গ্রুপ ছবি তোলার কথা। কাবাডির নিয়ম অনুযায়ী খেলার সময় ক্লিপ বা কোনো ধাতব জিনিস শরীরে রাখা যায় না। সেকারণে তাদের ফ্রেঞ্চ বেণি করতে বলি।
তার অভিযোগ, “ওই সময় ওয়াশরুমে গেলে ফ্রেঞ্চ বেনি দেখে প্রধান শিক্ষিকা ছাত্রীদের ডেকে বকাঝকা করে দুই বেনি করতে বলে এবং কয়েকজনকে মারধরও করে। আমি বের হয়ে তাদের বকা না দেওয়ার অনুরোধ করি এবং চুলের দুই বেনি করে স্কুলের মাঠে গিয়ে উনাকে নিয়ে ছবি তুলে নিই।”
এ ঘটনায় তিনি মর্মামত হন জানিয়ে বলেন, পরদিন (৮ সেপ্টেম্বর) স্কুলের খেলা ছিল খাস্তগীর স্কুলের মাঠে সেন্ট স্কলাসটিকা স্কুলের সাথে। মডেল টেস্ট চলার কারণে সকালে আমাদের দেরি হবে বলে আয়োজকদের জানাই।
‘‘পরদিন সকালে খাস্তগীর স্কুলে পৌঁছাতে দেরি হওয়ার কারণে স্কলাসটিকা স্কুলকে ওয়াকওভার দিয়ে দেওয়া হয়। এ বিষয়ে আয়োজক স্কুলের গেম টিচার কাজল স্যারকে জিজ্ঞেস করেও কোনো প্রতিকার পাইনি। এ ঘটনার থানা শিক্ষা অফিসারসহ সংশ্লিষ্টদের জানিয়ে প্রতিবাদ করি।’’
জাহিদা পারভীন জানান, এ ঘটনার পর শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি চার দিন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। এরপর ১৪ সেপ্টেম্বর স্কুলে যোগদান করলেও ঘটনার প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন (‘বিমুক্তিকরণপত্র’ দেন)। ওইদিনই প্রধান শিক্ষিকার মারধরের প্রতিবাদে স্থানীয় একটি সেলুনে গিয়ে মাথা ন্যাড়া করি।
পদত্যাগ করার পরও কয়েকদিন বিদ্যালয়ে গিয়ে প্রধান শিক্ষিকার আচরণের প্রতিবাদ করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “বিমুক্তি চেয়েছি পরিচালনা কমিটির সভাপতির কাছে। কিন্তু গত ২২ সেপ্টেম্বর আমাকে প্রধান শিক্ষিকা স্কুলে আসতে মানা করে দেন।’’
কেন ফেইসবুকে পোস্ট দিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আমার ছাত্রীরা আমার অর্ডারে ফ্রেঞ্চ বেণি করে। আর শাস্তি দিয়েছেন প্রধান শিক্ষিকা। নিজের কাছে খারাপ লেগেছে। দু:খ, ক্ষোভ ও বেদনা থেকে মাথা ন্যাড়া করে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছি।”
১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এয়াকুব আলী দোভাষ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণিতে তিনশর মত শিক্ষার্থী পড়ে। শিক্ষক আছেন ১২জন। সবাই এমপিওভুক্ত। এ বিদ্যালয়ের ভূমিদাতা বর্তমান সিডিএ চেয়ারম্যান ও মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা জহিরুল আলম দোভাষের পরিবার।
২০১১ সালের বোয়ালখালীর একটি স্কুল থেকে এ স্কুলে যোগ দেন জাহিদা পারভীন। যোগ দেওয়ার একমাসের মাথায় আগের স্কুল কর্তৃপক্ষের অভিযোগের প্রেক্ষিতে তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। পরে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে আপিল করে চাকরি ফিরে পান দেড় বছর পর।
এখন জাহিদা তার বিমুক্তিকরণ পত্র প্রত্যাহার করতে চান এবং দেড় বছরের বকেয়া পাওনা পরিশোধ ও স্কুলের শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতে খেলতে দেওয়ার সুযোগ চান।
যা বললেন প্রধান শিক্ষিকা
অভিযোগ অস্বীকার করে শুক্রবার প্রধান শিক্ষিকা নীপা চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘তিনি (জাহিদা) বেণি করায় মারধরের যে অভিযোগ করেছে তা একেবারেই ভিত্তিহীন। তাদের মারধর করলে হাসিমুখে গ্রুপ ছবি কেন তুলব? যেটি শিক্ষিকা জাহিদা পারভীন নিজেই তুলেছেন।“
তবে ফ্রেঞ্চ বেণি কেন করেছে এ বিষয়ে ছাত্রীদের জিজ্ঞাস করার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, আমি তাদের কয়েকজনকে টিচারস রুমে নিয়ে বলেছি এটা যেহেতু স্কুলের প্রতিনিধিত্ব করবে সেকারণে দুই বেণি করে ছবি তোলার জন্য বলেছি। ওইসময় জাহিদা ম্যাডাম ওয়াশরুমে ছিলেন।
‘‘সে হিসেবে মেয়েরা সকলেই দুই বেণি করে মাঠে আসে এবং জার্সি পরে ছবি তোলে। আর সেই ছবি জাহিদা পারভীন নিজেই তুলেছিলেন। সেখানে কোন সমস্যা হয়নি।’’
নীপা চৌধুরী বলেন, ‘‘৮ সেপ্টেম্বর সকাল নয়টায় খেলা থাকলেও জাহিদা ম্যাডাম ছাত্রীদের নিয়ে দশটার দিকেই স্কুল থেকে বের হয়েছিলেন। কিন্তু স্কুল ত্যাগের পর থেকে তিনি আমার ফোন আর রিসিভ করেননি।
‘‘তার সাথে থাকা স্কুলের দপ্তরির মাধ্যমে জানতে পারি দেরিতে যাবার কারণে সেন্ট স্কলাসটিকা স্কুলকে ওয়াকওভার দিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে জাহিদা ম্যাডাম খাস্তগীর স্কুলের গেমটিচারের সাথে অশোভন আচরণও করেছেন।’’
জাহিদা পারভীনকে কোনো কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হয়নি দাবি করে তিনি বলেন, তার বিমুক্তিকরণ পত্রের বিষয়টি আমি পরিচালনা কমিটির সভাপতিকে অবহিত করি। গত ১৭ সেপ্টেম্বর কমিটির সভায় তার আবেদন গ্রহণ করা হয়। এরপর তাকে (জাহিদা) চিঠি নিতে বলা হলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি।
পরিচালনা কমিটির সভাপতি যা বললেন
স্কুল কমিটির সভাপতি সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ ডলফিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, খাস্তগীর স্কুলে ইন্টার স্কুল স্পোর্টসের কাবাডি টুর্নামেন্টে অংশ নিতে গেছিল। সেখান থেকে কমপ্লেইন আসে। এজন্য ওই শিক্ষিকা পদত্যাগপত্র জমা দেন। পরিচালনা কমিটির সভায় সেটি গ্রহণ করা হয়েছে।
ডিসি’র তদন্ত কমিটি
মাথা ন্যাড়া করে শিক্ষিকার ফেইসবুক স্ট্যাটাস দেওয়ার ঘটনায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে প্রধান করে গঠিত কমিটি শুক্রবার থেকেই কাজ শুরু করেছে উল্লেখ করে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মো. মমিনুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তাদের দ্রুত সময়ে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এ ঘটনায় যেই দোষী হোক তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।