চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন্যায় আউশ, রোপা আমন ধান ও আমনের বীজতলার পাশাপাশি সবজি ক্ষেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
Published : 17 Aug 2023, 10:30 PM
চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও তিন পার্বত্য জেলায় স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় প্রায় ৭০০ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হওয়ার কথা জানাচ্ছেন কৃষি কর্মকর্তারা।
তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩১০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে বান্দরবানে, আর সবচেয়ে কম ১১ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে খাগড়াছড়িতে। ক্ষতির হিসাবে চট্টগ্রামের অবস্থান দ্বিতীয়, যার আর্থিকমূল্য ১৮৪ কোটি টাকারও বেশি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের হিসাব অনুযায়ী, এ মাসের শুরুতে অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় তাদের আওতাধীন চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ফেনী ও লক্ষীপুরের ৫০ হাজার ৪০৪ হেক্টর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ১৭ হাজার ৭৪৫ দশমিক ৩ হেক্টর জমির ফসল পুরোপুরি নষ্ট হয়েছে।
ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর বেশির ভাগই চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের। চট্টগ্রাম জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ ১১ হাজার ৬০৯ দশমিক ২ হেক্টর জমি, আর কক্সবাজারে এর পরিমাণ ৫ হাজার ৪৪৪ দশমিক ৫৫ হেক্টর।
ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের মধ্যে রয়েছে আউশ, রোপা আমন ধান ও আমনের বীজতলা এবং বিভিন্ন ধরনের শরৎকালীন সবজি।
এপ্রিল থেকে জুন মাসে রোপণ করা আউশ ধান কৃষকরা সংগ্রহ করেন জুলাই থেকে অগাস্ট মাসে। আর জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসে রোপণ করা আমন ধান সংগ্রহ করা হয় অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাসে।
আউশ ধান সংগ্রহ ও ধানের শীষ আসার সময়েই চট্টগ্রাম অঞ্চলে অতি বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে বন্যার সৃষ্টি হয়। এতে তলিয়ে যায় বান্দরবান ও চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, চন্দনাইশ, লোহাগাড়া উপজেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের হিসাব অনুযায়ী, পাহাড়ি ঢল ও বন্যায় চট্টগ্রাম অঞ্চলের এক লাখ ৯১ হাজার ৭৯৭ জন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নষ্ট হওয়া ফসলের ক্ষতির পরিমাণ ৩১১ কোটির কিছু বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে ।
এর মধ্যে কেবল চট্টগ্রাম জেলায় ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৮৪ কোটি ১৫ লাখ টাকা। আর কক্সবাজারে ক্ষতির পরিমাণ ১১১ কোটি ২৬ লাখের বেশি।
অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম জেলার হিসাব অনুযায়ী, সাতকানিয়া উপজেলার এক হাজার ৮৪৭ হেক্টর জমির ফসল পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। শতকরা হিসাবে ওই এলাকার ৭৫ শতাংশ জমিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার আর্থিক মূল্য প্রায় ২৭ কোটি টাকা।
এ উপজেলার পাশ্ববর্তী চন্দনাইশে তিন হাজার ৮০০ হেক্টর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার মধ্যে দুই হাজার ৬৯০ হেক্টর জমির ফসল পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। শতাংশের হিসেবে এ উপজেলার ক্ষতির পরিমাণ সাতকানিয়া থেকে কম হলেও আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বেশি। এ উপজেলায় প্রায় ৩৩ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে।
সাতকানিয়ার কেঁওচিয়া ইউনিয়নের কৃষক আমির হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি প্রায় ১১ কানি (৪ দশমিক ৪০ একর) জমিতে ধান চাষ করি। তার মধ্যে দুই কানি (৮০ শতক) জমিতে আউশ ধান করেছিলাম। ধানের শীষ আসার সময়েই বন্যার পানিতে সব নষ্ট হয়ে গেছে।“
আমির জানান, ৯ কানি (তিন দশমিক ৬০ একর) জমিতে আমন ধানের বীজতলাও তৈরি করেছিলেন। সেগুলোও সব বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক অরবিন্দু কুমার রায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চট্টগ্রামের সাতাকানিয়া, চন্দনাইশ উপজেলা। পাশাপাশি লোহাগাড়া ও বাঁশখালী উপজেলার কিছু অংশও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”
আর কক্সবাজারের চকরিয়া ও পেকুয়া এলাকাতেও বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানান তিনি।
অতিরিক্ত পরিচালক বলেন, “ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের প্রণোদনা দেওয়ার জন্য আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখেছি, যাতে এক সপ্তাহের মধ্যে আমনের বীজ দেওয়া গেলে তারা বীজতলা তৈরি করে চারা রোপণ করতে পারে।
“কিন্তু এটা সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না। তাই আগামী শীতকালীন চাষে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হবে।”
অরবিন্দু মনে করেন, চট্টগ্রাম অঞ্চলে যে পরিমাণ ফসল উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তাতে বন্যার ক্ষতি খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না।
তার ভাষ্য, তার অঞ্চলের অধীনে ৪৮টি উপজেলা থাকলেও বেশি ক্ষতি হয়েছে তিনটি উপজেলায়। অন্যান্য উপজেলাগুলোর মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যাবে।”
তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রাঙামাটি অঞ্চলের আওতাধীন।
এ অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক তপন কুমার পাল জানান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়িতে চার-পাঁচটি করে উপজেলায় বেশি ক্ষতি হলেও বান্দরবানে প্রায় সবকটি উপজেলায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, এ অঞ্চলের অধীনে ১৫ হাজার ৮২৭ হেক্টর জমির ফসল আক্রান্ত হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ের পাহাড়ি ঢল ও বন্যায়। যার মধ্যে ১২ হাজার ৭৭৭ হেক্টর জমির ফসল পুরোপুরি ক্ষতি হয়েছে। টাকার অঙ্কে এই ক্ষতির পরিমাণ ৩৮৩ কোটির টাকার বেশি।
এর মধ্যে রাঙামাটিতে ৪ হাজার ৬২৮ হেক্টর জমি বন্যার পানিতে আক্রান্ত হয়েছে, আর পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তিন হাজার ২১৪ দশমিক ৬০ হেক্টর।
এ জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের মধ্যে রয়েছে আউশ ধান, রোপা আমানের চারা, আদা, হলুদ, কলা, বিভিন্ন ধরনের ফল ও সবজি।
খাগড়াছড়িতে এক হাজার ৩৪৪ হেক্টর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৭১০ হেক্টর জমি; যেখানে নষ্ট হয়েছে আউশ, রোপা আমন ও গ্রীষ্মকালীন সবজি।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বান্দরবানে। এ জেলায় ৯ হাজার ৮৫৫ হেক্টর জমি পানিতে তালিয়ে গেছে, যার মধ্যে আট হাজার ৮৫৩ দশমিক ০৫ হেক্টর জমির ফসল পুরোপুরি নষ্ট হয়েছে। নষ্ট হওয়া ফসলের মধ্যে রয়েছে কলা, পেঁপে, গ্রীষ্মকালীন সবজি ও ধান।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, পাহাড়ি তিন জেলার কেবল বান্দরবানেই ক্ষতি ৩১০ কোটি টাকার বেশি।
রাঙামাটিতে ক্ষতির পরিমাণ ৬১ কোটি ৩২ লাখ ও খাগড়াছড়িতে ১১ কোটি টাকার কিছু বেশি ফসলের ক্ষতি হয়েছে।
বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার আলেক্ষ্যং ইউনিয়নের বাসিন্দা সাচিং থুই মারমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তাদের এলাকার তারাছা খালের পাড় ও আশেপাশের প্রায় এক একর জায়গা জুড়ে তিনি পেঁপে, শসা, ওলকচু, বেগুনসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ করতেন।
এবারের বন্যায় এত বেশি পানি হয়েছে যে নদীর পাড়ের নিচু জায়গায় যেসব ক্ষেত ছিল, সেসব পুরোই ভাসিয়ে গেছে বানের পানিতে। উপরের কিছু থাকলেও সেগুলোও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, অগাস্ট মাসে চট্টগ্রাম বিভাগে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৫৫৩ মিলিমিটার। কিন্তু চলতি মাসের শুরুতেই এখানে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বর্ষণ হয়েছে।
চলতি মাসের প্রথম ৯ দিনে কেবল বান্দরবানে ১ হাজার ৬৩ মিলিমিটার, চট্টগ্রামে ৭২৭ মিলিমিটার, কক্সবাজারে ৪১১ মিলিমিটার এবং রাঙামাটিতে ৬৬২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রাঙামাটি অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক তপন পাল বলেন, বান্দরবান, রাঙামাটিতে তাদের কর্মকর্তারা ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের তালিকা তৈরি করে আমনের বীজ বিতরণ শুরু করেছেন। আবার যেসব বীজতলা পুরোপুরি ক্ষতি হয়নি, সেগুলো রোপণের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
চট্টগ্রাম অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালকের মতো তপন পালও জানান, ক্ষতিগ্রস্তদের আগামী মৌসুমী সহায়তা করা হবে।