“৪৩টি ইভেন্ট পরিচালনা করার যোগ্যতা কিংবা দক্ষতা তাদের আদৌ আছে কিনা আমাদের সন্দেহ রয়েছে,” বলেন মেয়র শাহাদাত।
Published : 31 Jan 2025, 09:30 AM
জেলা ক্রীড়া সংস্থার অ্যাডহক কমিটি নিয়ে নানামুখী আলোচনা চলছে চট্টগ্রামের ক্রীড়াঙ্গনে। ক্রীড়া সংগঠকরা বলছেন, অ্যাডহক কমিটি গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে না পারলে ক্রীড়াঙ্গনে স্থবিরতা নেমে আসতে পারে।
ছাত্র-জনতার অভুত্থ্যানে সরকার পতনের পর দেশের সব বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার কমিটি ভেঙে অ্যাডহক কমিটি করার নির্দেশনা দেয় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। সে অনুযায়ী গত ১৯ জানুয়ারি চট্টগ্রাম বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থা এবং ২৬ জানুয়ারি চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার অ্যাডহক কমিটি ঘোষণা করা হয়।
বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার কমিটি ঘোষণার পর চট্টগ্রামের ক্রীড়াঙ্গনে কোনো শোরগোল না উঠলেও জেলা ক্রীড়া সংস্থার কমিটি ঘোষণার পর নানা ধরনের আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে।
বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার অ্যাডহক কমিটিতে স্থান পাওয়া সদস্যরা চট্টগ্রামের ক্রীড়াঙ্গনের পরিচিত মুখ। তবে জেলা ক্রীড়া সংস্থার কমিটিতে যারা স্থান পেয়েছেন, তারা স্থানীয় ক্রীড়াঙ্গনের সাথে সম্পৃক্ত নন বলে অভিযোগ তুলেছেন ক্রীড়া সংগঠক ও সাবেক খেলোয়াড়রা।
গত বছরের ২৭ অগাস্ট জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ থেকে জারি করা নির্দেশনায় বলা হয়, জেলা ক্রীড়া সংস্থার অ্যাডহক কমিটিতে আহ্বায়ক থাকবেন জেলা প্রশাসক আর সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তা।
আর বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার আহ্বায়ক থাকবেন বিভাগীয় কমিশনার, সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন সংশ্লিষ্ট বিভাগের বিভাগীয় শহরের যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক।
এছাড়া অপর পাঁচ সদস্য হিসেবে দুই জন সরাসরি ক্রীড়া সম্পৃক্ত ব্যক্তি (খেলোয়াড়, কোচ, রেফারি), একজন করে স্থানীয় পর্যায়ে সর্বজন গ্রহণযোগ্য ক্রীড়ানুরাগী, ক্রীড়া সংশ্লিষ্ট সম্মানিত ব্যক্তি, ক্রীড়া সম্পৃক্ত সংগঠক/ছাত্র প্রতিনিধি ও ক্রীড়া সাংবাদিককে রাখার কথা বলা হয় নির্দেশনায়।
গত ১৯ জানুয়ারি চট্টগ্রাম বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার ঘোষিত অ্যাডহক কমিটিতে সদস্য হিসেবে স্থান পেয়েছেন ক্রীড়ানুরাগী ক্যাটাগরিতে ইস্পাহানী গ্রুপের চেয়ারম্যান মীর্জা সালমান ইস্পাহানী, ক্রীড়া সম্পৃক্ত ব্যক্তি হিসেবে নাম এসেছে চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সহ-সভাপতি সৈয়দ আবুল বশর, সাবেক ফুটবলার ও চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সহ-সভাপতি হাফিজুর রহমান, ক্রীড়া সংবাদিক ক্যাটাগরিতে শাহনেওয়াজ রিটন, যিনি চট্টগ্রাম মহানগরী ক্রীড়া সংস্থার ক্রিকেট কমিটির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে আছেন ইয়াসির আরেফিন চৌধুরী।
কমিটির সদস্য সচিব করা হয়েছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের চট্টগ্রাম বিভাগীয় উপ-পরিচালককে।
চট্টগ্রামের ক্রীড়া সংঠক ও সাবেক খেলোয়াড়দের ভাষ্য, ২৬ জানুয়ারি চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার ঘোষিত অ্যাডহক কমিটিতে যাদের রাখা হয়েছে তারাই চট্টগ্রামের ক্রীড়া সংশ্লিষ্ট নন এবং চট্টগ্রামের ক্রীড়াঙ্গন নিয়ে তাদের ‘কোনো ধারণাও নেই’। তাদের অনেককেই তারা চেনেন না।
চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার ঘোষিত অ্যাডহক কমিটিতে ক্রীড়ানুরাগী ক্যাটাগরিতে নাম এসেছে মোহাম্মদ ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীর। যাকে চিনতে পারছেন না চট্টগ্রামের ক্রীড়া সংশ্লিষ্ট কেউ। প্রশিক্ষক ক্যাটাগরিতে নাম এসেছে রিফাত বিন আনোয়ারের । তিনি কোন ইভেন্টের প্রশিক্ষক– সেটাও জানাতে পারেননি চট্টগ্রামের কোনো খেলোয়াড় কিংবা সংগঠক।
সাবেক খেলোয়াড় ক্যাটাগরিতে নাম এসেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শারিরীক শিক্ষা বিভাগের উপ-পরিচালক হাবিবুর রহমান জালালের। সাবেক ফুটবলার হাবিবও চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা নন। চাকরিসূত্রে তিনি চট্টগ্রামে থাকেন।
ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে কমিটিতে স্থান পেয়েছেন আরিফ মঈনুদ্দিন এবং ক্রীড়া সাংবাদিক ক্যাটাগরিতে শেখ সাইদুল ইসলাম মীর ওরফে ইভান মীর।
ইভান মীর একটি টেলিভিশন চ্যানেলের চট্টগ্রাম অফিসের সাংবাদিক। তবে তিনি ক্রীড়া সংবাদিকতার সাথে যুক্ত নন বলে চট্টগ্রামের একাধিক ক্রীড়া সাংবাদিকের ভাষ্য।
চট্টগ্রামের স্থানীয় পত্রিকা দৈনিক পূর্বদেশের জ্যেষ্ঠ ক্রীড়া সাংবাদিক সাইফুল্লাহ চৌধুরী বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের তালিকাভুক্ত প্রশিক্ষক ও ম্যাচ রেফারি। পাশাপাশি চট্টগ্রামের একটি ক্রিকেট অ্যাকাডেমিরও পরিচালক এবং জেলা ক্রীড়া সংস্থার কাউন্সিলর তিনি।
চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার (সিজেকেএস) অ্যাডহক কমিটি নিয়ে সাইফুল্লাহ চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চট্টগ্রামের ক্রীড়াঙ্গন চালাতে প্রয়োজন চট্টগ্রামের লোকজন। যারা চট্টগ্রামের ক্রীড়াঙ্গন সম্পর্কে ধারণা রাখেন। কিন্তু সিজেকেএস অ্যাডহক কমিটিতে যাদের রাখা হয়েছে, তাদের কেউই চট্টগ্রামের ক্রীড়াঙ্গনের সাথে সম্পৃক্ত নন এবং তাদের এ নিয়ে ধারণা নেই।”
চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার অধীনে সারা বছর নিয়মিত খেলাধুলা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, বিভিন্ন উপ-কমিটি গঠন করে এসব টুর্নামেন্ট চালানো হয়। যারা সেখানে দায়িত্ব পালন করেন, তাদের বেশিরভাগই সাবেক ক্রীড়াবিদ।
দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে গত ছয় মাসে কোনো ইভেন্টের খেলা হয়নি জানিয়ে সাইফুল্লাহ চৌধুরী বলেন, “গত অগাস্টে প্রিমিয়ার ডিভিশন ফুটবল লিগ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটি হয়নি। দ্বিতীয় বিভাগ ক্রিকেট লিগ মাঝপথে বন্ধ হয়ে গেছে, তৃতীয় বিভাগ ক্রিকেট লিগ শুরুই হয়নি।”
অ্যাডহক কমিটি নিয়ে খেলাধুলা আয়োজনের চিন্তা করা হলে চট্টগ্রামের ক্রীড়াঙ্গন শঙ্কায় পড়বে বলে মনে করেন ক্রীড়া সাংবাদিক সাইফুল্লাহ চৌধুরী।
তার প্রত্যাশা, অ্যাডহক কমিটি গঠনতন্ত্র অনুসারে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করে নির্বাচিত কমিটিকে দায়িত্ব হস্তান্তর করবে, যাতে সংগঠকরাই ক্রীড়াঙ্গন পরিচালনা করেন।
তবে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সাবেক পরিচালক সিরাজউদ্দিন মো. আলমগীর মনে করেন, কোনো সংস্থায় অ্যাডহক কমিটি করা হয় নির্বাচন করার জন্য। দায়িত্ব গ্রহণের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকে অ্যাডহক কমিটির। সে আঙ্গিকে বিচার করলে কমিটিতে কারা স্থান পেয়েছেন সেটা ‘বড় বিষয় নয়’।
নির্বাচিত কমিটি ছাড়া খেলাধুলা পরিচালনা করা কষ্ঠসাধ্য মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সংস্থার গঠনতন্ত্র অনুসারে যদি অ্যাডহক কমিটি নির্বাচনের জন্য দায়িত্ব পালন করে তাহলে সেটা ক্রীড়াঙ্গনে কোন প্রভাব ফেলবে না। যদি লম্বা সময়ের জন্য অ্যাডহক কমিটি দায়িত্ব পালন করতে যায় তাহলে খেলাধুলা পরিচালনা করা অসম্ভব হবে।”
ক্রীড়া সংগঠক আলমগীরের মতে, খেলাধুলার সাথে বিভিন্ন ক্লাব সম্পৃক্ত। সে কারণে ক্লাবের প্রতিনিধি কমিটিতে না থাকলে কমিটি অনেকটা ‘অচল’। কারণ টুর্নামেন্টের সময় ক্লাবগুলোর কিছু দাবি দাওয়া থাকে। সেগুলো সমন্বয়ের বিষয় আছে। ক্লাবের স্বার্থ দেখার যদি কোনো প্রতিনিধি না থাকে, তাহলে তাদের ‘স্বার্থ বিঘ্নিত’ হবে। ফলে ক্লাবগুলো দল গঠন থেকে দূরে থাকবে এবং খেলাধুলা স্থবির হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, “গঠনতন্ত্রে স্পষ্ট বলা আছে ৯০ দিনের জন্য অ্যাডহক কমিটি গঠন করা হয়। তাই প্রত্যাশা থাকবে এসময়ের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করে অ্যাডহক কমিটি ক্লাব প্রতিনিধিদের হাতে দায়িত্ব তুলে দেবে। যাতে ক্রীড়াঙ্গন স্থবির হয়ে না যায়।”
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের তৈরি করা জেলা ক্রীড়া সংস্থার গঠনতন্ত্রের ২৮ নম্বর অনুচ্ছেদের ২৮:২ ধারায় বলা আছে, অ্যাডহক কমিটি ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করার জন্য গঠনতন্ত্র মোতাবেক নির্বাচন কমিশন গঠন করবে। নির্বাচন সম্পন্ন করার পর অ্যাডহক কমিটি নির্বাচিত কার্যনির্বাহী কমিটির কাছে যথানিয়মে দায়িত্ব হস্তান্তর করবে।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার অ্যাডহক কমিটির আহ্বায়ক ফরিদা খানম বলেন, “সেন্ট্রালি এ কমিটিটা করা হয়েছে। আমি যাদের নাম পাঠিয়েছি তাদের কেউ এ কমিটিতে নেই।
“এ কমিটি ঘোষণার পর একটা রিপারকেশন হচ্ছে। সবাই বলছে তারা ক্রীড়াপ্রেমী না। মেয়র মহোদয়কে বলেছি, তিনি উপদেষ্টার সাথে কথা বলবেন। দেখি একটু ওয়েট করে কী হয়।”
খেলাধুলা পরিচালনার বিষয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, “আমি সরকারের লোক। যেভাবে আমাকে বলা হবে সেভাবে আমি কাজ করতে বাধ্য।”
ওই অ্যাডহক কমিটি বাতিলের দাবি জানিয়ে সিটি মেয়র শাহাদাত বলেন, “সেখানে কোনো খেলোয়াড়, কোচ কিংবা সিজেকেএসের কোনো কর্মকর্তার নাম আমরা দেখছি না, এটা আমাদের অবাক করেছে। কারণ এ ৪৩টি ইভেন্ট পরিচালনা করার যোগ্যতা কিংবা দক্ষতা তাদের আদৌ আছে কিনা আমাদের সন্দেহ রয়েছে।
“এখানে যারা কোচ, খেলোয়াড়, প্রাক্তন খেলোয়াড়, সিজেকেএসের কর্মকর্তা এবং সাংবাদিক আছে, তারা এখানে নেতৃত্ব দেবে এবং এটাই হয়ে এসেছে।
পুরনো খবর
এম এ আজিজ স্টেডিয়াম ফুটবলের জন্য বরাদ্দ, অন্য খেলার কী হবে?