Published : 11 Jun 2024, 04:02 PM
আদালতের যে আদেশের কথা বলে তিন বছর আগে যাত্রামোহন সেনগুপ্তর বাড়ি ভেঙে জমিটি দখল নিতে চেয়েছিলেন এক ব্যবসায়ী, সেই আদেশ বাতিল করেছে চট্টগ্রামের একটি আদালত।
চট্টগ্রামের প্রথম যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ মো. খায়রুল আমিন সোমবার ওই আদেশ দিলেও বিষয়টি জানা যায় মঙ্গলবার।
জেলা প্রশাসনের আইনজীবী রুবেল পাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, জমির মালিকানা দাবি করে ব্যবসায়ী এম ফরিদ চৌধুরীর করা মামলায় তার পক্ষে যে ডিক্রি দেওয়া হয়েছিল, তা বাতিল করেছেন আদালত।
“জাল নথিপত্র তৈরি করে তিনি সেই রায় হাসিল করেছিলেন। ২০২১ সালে জমির দখল নিতে এলে ডিক্রি লাভ ও তার ভিত্তিতে জারি মামলায় আদেশ পাওয়ার বিষয়টি সরকারপক্ষ প্রথম জানতে পারে। এরপর সরকার পক্ষে মিস কেইস করা হয়। যার ভিত্তিতে গতকাল আদেশ হয়েছে।”
আইনজীবী রুবেল পাল বলেন, “ওই জমি অর্পিত সম্পত্তি। কিন্তু সরকারকে অবগত না করে দলিল বানিয়ে একতরফাভাবে ডিক্রি নেওয়া হয়েছিল। সেই ডিক্রিটি এখন বাতিল হল।”
২০২১ সালের ৪ জানুয়ারি দুপুরে বন্দর নগরী চট্টগ্রামের রহমতগঞ্জ এলাকায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত যাত্রামোহন সেনগুপ্তর বাড়িটি দখল নিতে যান ব্যবসায়ী ফরিদ চৌধুরীর লোকজন।
ফরিদ চৌধুরীর দুই ছেলে, স্থানীয় যুবলীগের নেতাকর্মী, ৪৫ জন পুলিশ সদস্য এবং চট্টগ্রাম যুগ্ম জেলা জজ আদালতের নাজির আমিনুল হক আকন্দ ‘দখল পরোয়ানা’ সহ কাগজপত্র নিয়ে সেদিন উপস্থিত ছিলেন।
সেদিন বুলডোজার দিয়ে ভবনের সামনের অংশ ভেঙে ফেলা হয়। খবর পেয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর এবং হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। পরে প্রতিরোধের মুখে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা এসে ঐতিহ্যবাহী বাড়িটি সিলগালা করে।
সেদিন রানা দাশগুপ্ত দাবি করেছিলেন ‘অপকৌশলে’ ওই জমি নিয়ে আদালতের আদেশ আনা হয়েছে। তিনি বাড়িটি সংরক্ষণের জন্য সরকারে কাছে দাবি জানিয়েছিলেন।
এরপর জেলা প্রশাসকের পক্ষে আইনজীবী ফখরুদ্দীন জাবেদ ২০২১ সালে চট্টগ্রামের প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালতে মামলা দায়ের করেন।
বাড়ির ইতিহাস
ভারতীয় কংগ্রেসের নেতা যাত্রামোহন সেনগুপ্ত এই বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন। চট্টগ্রামের এই আইনজীবীর ছেলে হলেন দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত।
ব্যারিস্টার যতীন্দ্রমোহনও ছিলেন সর্বভারতীয় কংগ্রেসের নেতা। তিনি কলকাতার মেয়র হয়েছিলেন। ইংরেজ স্ত্রী নেলী সেনগুপ্তাকে নিয়ে কিছু দিন ভবনটিতে ছিলেন তিনি।
আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের আন্দোলন, মহাত্মা গান্ধী, সুভাষ চন্দ্র বসু, শরৎ বসু, মোহাম্মদ আলী ও শওকত আলীসহ কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা বিভিন্ন সময় এই বাড়িতে এসেছেন।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবীরাও এই বাড়ির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। সূর্য সেন, অনন্ত সিংহ, অম্বিকা চক্রবর্তীর হয়ে মামলা লড়েছিলেন যতীন্দ্রমোহন। সেজন্য তিনি ব্রিটিশ শাসকদের রোষানলে পড়েন। ১৯৩৩ সালে কারাগারে মৃত্যু হয় তার।
নেলী সেনগুপ্তা ১৯৭০ সাল পর্যন্ত রহমতগঞ্জের বাড়িটিতে ছিলেন। পরে তিনি চিকিৎসার জন্য ভারতে যান। ফিরে দেখেন বাড়িটি বেদখল হয়ে গেছে।
১৯ গণ্ডা এক কড়া পরিমাণ জমিটি পরে শত্রু সম্পত্তি ঘোষিত হয়। এর মধ্যে ১১ গণ্ডা ২ কড়া জমি ১৯৬৬ সালের অক্টোবরে জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে ইজারা নিয়ে ‘বাংলা কলেজ’প্রতিষ্ঠা করেন শামসুদ্দিন মো. ইছহাক নামের এক ব্যক্তি।
১৯৭৫ এর পর নাম বদলে সেই ভবনে ‘শিশুবাগ স্কুল’ তিষ্ঠা করা হয়। ইছহাকের সন্তানরা স্কুলটি পরিচালনা করছিলেন।
যেভাবে ডিগ্রি ও দখল আদেশ
২০২১ সালের ৪ জানুয়ারি এম ফরিদ চৌধুরীর লোকজন বুলডোজার দিয়ে ওই ভবন ভাঙার চেষ্টা করে। সেদিন ফরিদ চৌধুরীর ছেলে ফরহাদ দাবি করেন, ১৯৮০ সালে মিলন সেনগুপ্তর কাছ থেকে তারা ওই জমি কেনার বায়না করেন। জমি বুঝিয়ে না দেওয়ায় তারা দখল চেয়ে মামলা করেন।
সেদিন তারা দাবি করেছিলেন, চট্টগ্রামের প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালতে ২০০৫ সালে করা ওই মামলায় ডিক্রি পাওয়ার পর ২০১৭ সালে তারা আরেকটি জারি মামলা করে। ওই জারি মামলার আদেশ অনুসারে ২০২১ সালের ৪ জানুয়ারি তারা জমির দখল নিতে যান।
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২০২১ সালে করা মিস কেইসের এজাহারে বলা হয়, জেলা প্রশাসন ২০২১ সালের ৪ জানুয়ারি ঘটনার দিনই প্রথম ২০০৫ সালে করা মামলাটির বিষয়ে জানতে পারে। ওই মামলায় এম ফরিদ চৌধুরী বাদী হয়ে মিলন কান্তি সেনগুপ্তকে বিবাদী করেন। পাশাপাশি জেলা প্রশাসনকে করা হয় মোকাবিলা বিবাদী।
মিলন কান্তি সেনগুপ্ত নিজেকে যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তর ভাগ্নে দাবি করেন।
২০২১ সালে জেলা প্রশাসন ফরিদ চৌধুরীর করা মামলাটির নথিপত্র অনুসন্ধানে দেখতে পায়, ২০০৬ সালের ১৩ ফেব্রয়ারি সরকার পক্ষ মামলায় হাজির হয়ে সময় প্রার্থনা করে এবং পরে ২৭ মার্চ সরকার পক্ষে তথা জেলা প্রশাসনের লিখিত বর্ণনা দাখিল করা হয়। কিন্তু সেসব নথিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত দেওয়ানী শাখার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কোনো সাক্ষর নেই।
এমনকি ওই মামলার পরবর্তী কোনো শুনানির তারিখে সরকার পক্ষ হাজিরও ছিল না।
এছাড়া বাদী ও মোকাবিল বিবাদী তথা সরকার পক্ষে একই আইনজীবীর সিল ও সাক্ষর পাওয়া যায় মামলার নথিতে। যদিও একই ব্যক্তি বাদি ও বিবাদী পক্ষে হাজির হওয়ার বিধান নেই আইনে।
জেলা প্রশাসনের করা মিস মামলায় বলা হয়, ২০০৯ সালের ৭ এপ্রিল বাদী এম ফরিদ চৌধুরীর পক্ষে মামলার রায়ে ডিক্রি হয়। এতে দেখা যায়, বাদি-বিবাদী যোগসাজোশে সোলেনামা দাখিল করে এবং আদালতকে বিভ্রান্ত করে ডিক্রি নিয়েছেন। এবং তাতে একতরফা নাকি দোতরফা ডিক্রি দেওয়া হয়েছে তার উল্লেখ ছিল না।
ওই সোলেনামা থেকে জানা যায়, বাদী এম ফরিদ চৌধুরী বিবাদী মিলন কান্তি সেনগুপ্তর সাথে কোনো বায়না করেননি।
আইনজীবী রুবেল পাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ফরিদ চৌধুরী জমি বাবদ মিলন কান্তি সেনগুপ্তকে টাকা দেওয়ার কথা মামলায় উল্লেখ করলেও, এর কোন পে অর্ডার বা চেক নেই। নগদে লেনদেনের কোনো নথিও তিনি আদালতে দিতে পারেননি।”
জেলা প্রশাসনের করা মিস মামলায় বলা হয়, মিলন কান্তি সেন গুপ্তের কাছ থেকে বায়না মূলে জমির মালিকানা চেয়ে মামলা করা হলেও ওই জমি যাত্রা মোহন সেনগুপ্তর সন্তান রনজিত মোহন সেনগুপ্ত এবং শিশুবাগ স্কুলের পক্ষে এর প্রতিষ্ঠাতার নামে বিএস জরিপে লিপিবদ্ধ আছে। আইন অনুসারে বিএস খতিয়ান ছাড়া কোনো সম্পত্তি হস্তান্তর করা যায় না।
২০০৯ সালের ৭ এপ্রিল ওই মামলায় ডিক্রি পান এম ফরিদ চৌধুরী। কিন্তু এর ৩০ দিনের মধ্যে মিলন কান্তি সেনগুপ্ত জমি রেজিস্ট্রি না দেওয়ায় ২০১০ সালে একটি জারি মামলা করেন এম ফরিদ চৌধুরী।
ওই জারি মামলা ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে খারিজ করে দেয় আদালত। এরপর ২০১৭ সালের ১ অগাস্ট আরেকটি জারি মামলা করেন ফরিদ চৌধুরী।
জেলা প্রশাসনের করা মিস মামলায় বলা হয়, ওই জারি মামলাটিও আইনত বৈধ নয়। কারণ কোনো জারি মামলা খারিজ হলে তিন বছরের মধ্যে পরের জারি মামলা করতে হয়। কিন্তু শেষ জারি মামলাটি করা হয়েছে ৫ বছর পর।
“এছাড়া ওই নালিশী সম্পত্তি অর্পিত সম্পতি প্রত্যর্পণ আইনের অধীনে ‘ক’ তফসিলের সম্পত্তি। ফলে ওই জমিতে মিলন কান্তি সেনগুপ্তর কোনো বিক্রয়যোগ্য স্বত্ব নেই।”
২০২১ সালের জানুয়ারিতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের করা আবেদনের প্রেক্ষিতে ওই বাড়িটি ভাঙায় নিষেধাজ্ঞা দেয় চট্টগ্রামের একটি আদালত।
আন্দোলনের মুখে ওই বছরের ২৩ জানুয়ারি বাড়িটি ‘দখলদার মুক্ত’ করে এর নিয়ন্ত্রণ নেয় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। সেদিন বাড়িটিতে ‘স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নির্মাণের জন্য নির্ধারিত স্থান’ লেখা একটি সাইনবোর্ডও দেওয়া হয়।
পুরনো খবর
বুলডোজার ঠেকালেন রানা দাশগুপ্ত, রক্ষা পেল ঐতিহাসিক বাড়ি
যাত্রামোহন সেনগুপ্তের বাড়িতে স্থিতাবস্থা জারি
যাত্রামোহন সেনগুপ্তের বাড়ি ভাঙায় আদালতের নিষেধাজ্ঞা
যাত্রামোহনের বাড়ি জাদুঘর ঘোষণার দাবিতে সমাবেশ
‘দখলদার’ সরিয়ে যাত্রামোহনের বাড়ির নিয়ন্ত্রণ নিল জেলা প্রশাসন