চট্টগ্রামে পুলিশের যেসব সদস্যের করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়েছে তাদের কয়েকজনের কোনো উপসর্গ ছিল না বলে একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
Published : 29 Apr 2020, 07:21 PM
ভাইরাস সংক্রমণের মধ্যে চট্টগ্রামে পুলিশ সদস্যদের তোলা হচ্ছে হোটেলে
এখন পর্যন্ত চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলা মিলিয়ে মোট আক্রান্ত হয়েছেন ৬৪ জন, তাদের মধ্যে ১০ জনই পুলিশ সদস্য। আর চিকিৎসক আছেন তিনজন।
আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের মধ্যে আটজনই ট্রাফিক পুলিশের সদস্য। অপর দুইজনের একজন নগর পুলিশের এসএএফ ইউনিটে এবং অপরজন র্যাব-৭ এ কর্মরত।
এছাড়াও এক ট্রাফিক পুলিশ সদস্যের স্ত্রীও করোনাভাইরাস সংক্রমিত হয়েছেন।
আক্রান্ত আট ট্রাফিক সদস্যের সাতজনই ট্রাফিক পুলিশের উত্তর জোনে কর্মরত এবং তারা সবাই সুস্থ আছেন বলে নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (ট্রাফিক-উত্তর) মো. শহীদুল্লাহ জানিয়েছেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শনাক্ত হওয়ার আগে কয়েকজনের জ্বর আসলেও অন্যদের তেমন কোনো দৃশ্যমান উপসর্গ ছিল না।
“সোমবার পরীক্ষায় যে সদস্যের করোনাভাইরাস পজিটিভ এসেছে তার কোনো উপসর্গ ছিল না। যেহেতু তিনি আগে আক্রান্তদের সংস্পর্শে এসেছিলেন সেজন্য তার নমুনা পরীক্ষা করা হয়। ফল পজিটিভ এসেছে।”
উপ-কমিশনার শহীদুল্লাহ বলেন, “এর আগে আক্রান্ত একজনের জ্বর উঠেছিল। জ্বর সেরে যাওয়ার পর তিনি ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে ছিলেন। তবুও তার নমুনা পরীক্ষা করা হয় তিনি সংক্রমিত কি না তা জানতে, ওই সদস্যেরও করোনাভাইরাস পজিটিভ এসেছে।
“এছাড়াও কয়েকজনের সামান্য জ্বর হলেও তাদের অন্য কোনো শারীরিক সমস্যা ছিল না। কিন্তু প্রথম আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে একই কক্ষে থাকায় তাদেরও নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছিল এবং রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে।”
চট্টগ্রামে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে প্রথম কোভিড-১৯ সংক্রমণ হওয়ার খবর আসে ১২ এপ্রিল। পঞ্চাশোর্ধ ওই ট্রাফিক সদস্য থাকতেন দামপাড়া পুলিশ লাইনের ট্রাফিক ব্যারাকে। ওই দিন রাতেই অবরুদ্ধ করে দেওয়া হয় ব্যারাকটি।
পরে যে আট ট্রাফিক পুলিশ সদস্যের করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে তারা সবাই একই ব্যারাকেই থাকতেন। প্রথমজন থেকেই তাদের সবার মধ্যে এই ভাইরাস সংক্রমণ হয়েছে বলে ধারণা করছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
এখন উপসর্গ দেখা না দিলেও সতর্কতার অংশ হিসেবে আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের সংস্পর্শে যারাই এসেছিলেন, তাদের সবাইকে কোয়ারেন্টিনে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ।
এজন্য সিএমপি স্কুল অ্যান্ড কলেজের ৩৩টি কক্ষকে কোয়ারেন্টিনের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। এছাড়া দামপাড়া বিভাগীয় পুলিশ হাসপাতালে ২০টি আইসোলেশন শয্যার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর ১৬ শয্যার ফ্লু কর্নারও চালু রয়েছে।
এছাড়াও নারী পুলিশ সদস্যদের কোয়ারেন্টিনের জন্য পুলিশ লাইনে একটি ভবনের সাতটি কক্ষ প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
“তাদের মধ্যে ২৯ জনের পরীক্ষার ফলাফল পাওয়া গেছে, যেখানে নয়জনের কোভিড-১৯ পজিটিভ এসেছে। আরও ৩৪টি নমুনা পরীক্ষার ফলাফল এখনও পাওয়া যায়নি।”
সতর্কতার অংশ হিসেবে সিএমপির বিভিন্ন ইউনিটে কর্মরত ৭৪ জনকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন ওয়ার্ড ও ফ্লু কর্নারে রাখা হয়েছে বলে জানান পুলিশ কর্মকর্তা মঈনুল।
তিনি জানান, ৬৩ জন পুলিশ সদস্যকে দামপাড়া সিএমপি স্কুলে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে, আটজনকে দামপাড়া পুলিশ হাসপাতালের ফ্লু কর্নারে এবং তিনজনকে আইসোলেশন ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে।
এদিকে সোমবার রাতে এক র্যাব সদস্যের করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ার পর ব্যারাকে থাকা ৩০ সদস্যের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে বলে জানান র্যাব-৭ এর স্টাফ অফিসার এএসপি মাহমুদুল হাসান মামুন।
আক্রান্ত ওই র্যাব সদস্যকে গত ৭ এপ্রিল থেকে আইসোলেশনে রাখা হয়েছিল। পরে তার নমুনা পরীক্ষায় পজিটিভ আসে।
র্যাব কর্মকর্তা মাহমুদুল বলেন, “যেহেতু ব্যারাকে অনেকেই থাকেন তাই সতর্কতার অংশ হিসেবে ৩০ জনের নমুনা পরীক্ষার জন্য দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে তা আরও বাড়ানো হতে পারে।”
এদিকে দামপাড়া পুলিশ লাইনের ব্যারাকের ঘনবসতি রোধ করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আবাসন নিশ্চিতের জন্য পুলিশ সদস্যদের সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। পুলিশ লাইনের পাশের দুটি কনভেনশন ও কমিউনিটি সেন্টারে এবং একটি হোটেলে পুলিশ সদস্যদের থাকার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
পরস্থিতি ভালো না হওয়া পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে আরও সদস্যদের ব্যারাক থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে বলে সিএমপি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি বলে মনে করছেন উপ-কমিশনার শহীদুল্লাহ।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ট্রাফিক পুলিশের সদস্যদের সরাসরি সাধারণ মানুষের সংস্পর্শে আট ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালন করতে হয়। বিভিন্ন যানবাহন তল্লাশিসহ নানা ধরনের কাজ করতে হয়। যার কারণে সবচেয়ে বেশি মানুষের সংস্পর্শে আসতে হয় ট্রাফিক সদস্যদের।
“ট্রাফিক সদস্যদের দূরত্ব বজায় রেখে দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়েছে। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়ে ওঠে না তাদের পক্ষে। এনফোর্সমেন্ট করতে গেলেই পাবলিকের সংস্পর্শে আসতে হয়।”
শহীদুল্লাহ বলেন, “সার্জেন্টদের পিপিই, গ্লাভস, মাস্ক পরে দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়েছে। কিন্তু রোদের মধ্যে সেটাও সম্ভব হয়ে ওঠে না। সেজন্য যেখানে চারজন দায়িত্বে থাকে সেখানে পালা করে দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়েছে, যাতে বিশ্রাম নিয়ে দায়িত্ব পালন করতে পারেন তারা।”
এদিকে তিন চিকিৎসক আক্রান্ত হওয়ার পর চট্টগ্রামের স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যেও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
আক্রান্ত চিকিৎসকদের মধ্যে একজন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। অপর দুইজনের একজন বাঁশখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এবং অন্যজন ফটিকছড়ি উপজেলায় কর্মরত ছিলেন।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সাংগঠনিক সম্পাদক ও সংগঠনের করোনা সেলের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সমন্বয়ক আ ন ম মিনহাজুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চট্টগ্রামে যে তিন চিকিৎসক করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়েছেন তারা সরাসরি রোগী দেখার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। রোগী দেখার সময়ই তারা সংক্রমিত হয়েছেন।”
এদের মধ্যে বাঁশখালীতে দায়িত্ব পালন করা চিকিৎসক সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরেছেন। অন্যদের মধ্যে একজন বাসায় কোয়ারেন্টিনে থেকে এবং অপরজন নগরীর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে জানান তিনি।
ডা. মিনহাজ জানান, আক্রান্ত তিন চিকিৎসকের পাশাপাশি এসে কাজ করা এমন অন্তত ৫০ জন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য দেওয়া হয়েছে।