ব্যবসায়ীদের নেতা থেকে জামায়াত-ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ নিয়েই নৌকা প্রতীকের এমপি বনে যাওয়া এম এ লতিফের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃতির অভিযোগ ওঠার পর তার পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ।
Published : 17 Feb 2016, 09:55 PM
নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী এবং তার সমর্থকরা বঙ্গবন্ধু অবমাননার জন্য লতিফের শাস্তির দাবিতে সোচ্চার হওয়ার পর তার পক্ষে দাঁড়িয়ে গেছে চট্টগ্রামে দলের সাত সংসদ সদস্য।
আত্মপক্ষ সমর্থনে লতিফের কিংবা সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর প্রতিবাদের- কোনো কর্মসূচিতে দেখা যাচ্ছে না বর্তমান মেয়র ও নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিনের অনুসারীদের।
শুরু থেকে লতিফ বিষয়ে নীরব নাছির নিজের মতামত দেওয়া এড়িয়ে দুই পক্ষেরই সমালোচনা করেছেন; বলছেন, বিষয়টি দলকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
গত ৩০ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চট্টগ্রাম সফরকে কেন্দ্র করে লতিফের নামে স্থাপিত বিলবোর্ডে বঙ্গবন্ধুর বিকৃত ছবি দেখে ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতারা বিক্ষোভ শুরু করেন। তার বিরুদ্ধে চারটি মামলা হয়, আনা হয় রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগও।
সমালোচনার মুখে লতিফ এক সংবাদ সম্মেলনে আসেন ওই বিলবোর্ড স্থাপনের দায়িত্ব পাওয়া বিজ্ঞাপনী সংস্থার ডিজাইনারকে নিয়ে। তাতে ওই ডিজাইনার লতিফকে নির্দোষ দাবি করে নিজে ওই ঘটনার দায় নেন।
এরপর এক সমাবেশে মহিউদ্দিন চৌধুরী বঙ্গবন্ধুকে অবমাননায় ক্ষোভ প্রকাশ করে দলীয় এই সংসদ সদস্যকে বন্দর নগরীতে চলাচলে হুঁশিয়ার করে বলেন, কেউ যদি ক্ষুব্ধ হয়ে লতিফের উপর আক্রমণ করে, তবে নির্দেশদাতা হিসেবে দায় নিতে তিনি প্রস্তুত।
মহিউদ্দিনের ওই হুঁশিয়ারির দুই দিনের মধ্যে বন্দর নগরীতে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা ব্যবসায়ী নেতা থেকে আওয়ামী লীগের টিকেট নিয়েই এমপি হওয়া লতিফের পক্ষে দাঁড়িয়ে বিবৃতি দিলেন।
বিবৃতিতে বলা হয়, মহিউদ্দিন চৌধুরী দলীয় শৃঙ্খলার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন, যা ‘রাজনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত এবং দেশের প্রচলিত আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনের সমতুল্য’।
চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগে নগর কমিটির সহ-সভাপতি আফসারুল আমিন ও নুরুল ইসলাম বিএসসি, কোষাধ্যক্ষ আবদুচ ছালাম ও সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির সভাপতি মহিউদ্দিনের বিরোধী শিবিরের লোক হিসেবে পরিচিত।
বন্দর আসনের সাংসদ লতিফ বন্দর ইস্যুতে মহিউদ্দিনবিরোধী। ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল, চট্টগ্রাম চেম্বার ও চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন বিষয়ে একাধিকবার মহিউদ্দিনের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছেন তিনি।
বিবৃতিদাতা সংসদ সদস্যদের দাবি, মহিউদ্দিন তার ‘ব্যক্তিগত’ রোষ থেকে এখন লতিফের বিরোধিতায় নেমেছেন। অন্যদিকে মহিউদ্দিন ও তার অনুসারীরা বলছেন, লতিফের পক্ষে বিবৃতিদাতারা আওয়ামী লীগে ‘মেহমান’ ও ‘হাইব্রিড নেতা’।
লতিফের পক্ষে এমপিদের বিবৃতিতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি দল করেছিলাম বলেই অনেক অযোগ্য-অথর্ব লোক এসে ভিড়েছে। তারা এমপি হয়েছে। তাদের বল, সাহস থাকলে আমার সামনে এসে দাঁড়াক।”
চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক সভাপতি লতিফ ২০০৮ সালে আকস্মিকভাবে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে চট্টগ্রাম-১০ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর নানা সময়েই বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন।
২০০৯ সালের ৩১ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর সহযোগী সংগঠন চাষী কল্যাণ সমিতি আয়োজিত যৌতুকবিহীন বিয়ের অনুষ্ঠানে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের মুখে থাকা ইসলামী সমাজ কল্যাণ পরিষদের সভাপতি মাওলানা শামসুদ্দিন, জামায়াতের তৎকালীন নায়েবে আমির আফসার উদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে মঞ্চে উঠে সমালোচনায় পড়েছিলেন তিনি।
মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, “শাক দিয়ে এখন মাছ ঢাকার চেষ্টা হচ্ছে। জাতির জনকের অপমানে কোনো আপস হবে না। সরকারের কাজ সরকার করছে, দলের কাজ দল করবে। অপরাধীদের শাস্তি পেতেই হবে।”
লতিফের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন চট্টগ্রাম-১০ (ডবলমুরিং) আসনের মো. আফসারুল আমীন, চট্টগ্রাম-৩ (সন্দ্বীপ) এর মাহফুজুর রহমান, চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড) এর দিদারুল আলম, চট্টগ্রাম-৬ (রাউজান) এর এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী, চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) এর শামসুল হক চৌধুরী, চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ) এর নজরুল ইসলাম চৌধুরী ও চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) এর মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী। এই সাতজনের ছয়জনের নির্বাচনী এলাকাই চট্টগ্রাম নগরীর বাইরে।
তাদের অবস্থান নিয়ে জানতে চাইলে নগর কমিটির সহ-সভাপতি আফসারুল আমিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা সাংসদ হিসেবে বিবৃতি দিয়েছি।”
শামসুল হক চৌধুরী বলেন, “যা খুশি তা বলে একজন সাংসদকে অপমান করা হচ্ছে, সেকারণেই আমরা বিবৃতি দিয়েছি।”
মহিউদ্দিনের অবস্থান নিয়ে মত জানতে চাইলে আফসারুল বলেন, “লালদীঘিতে যে সমাবেশ হয়েছে, সেটা আওয়ামী লীগের নয়। মহিউদ্দিন চৌধুরী ছাড়া কি নগর আওয়ামী লীগে কেউ নেই? একজন গেলেই তো সেটা পুরো কমিটির অবস্থান হল না। উনি নাগরিক কমিটির ব্যানারে মিটিং করতেই পারেন।”
মহিউদ্দিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত নগর কমিটির সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন বিবৃতিদাতাদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, “যখন বঙ্গবন্ধুর ছবিতে পাকিস্তানি পোশাক পরিয়ে প্রদর্শন করা হল, তখন সাংসদরা বিবৃতি দিলেন না কেন ? যখন অপরাধী ধরা পড়ে গেছে, তখন তাকে (লতিফ) বাঁচাতে এত দরদ কেন? নিশ্চয়ই ডাল মে কুচ কালা হ্যায়।”
বিবৃতিদাতাদের একজন (আফসারুল আমিন) বাদে অন্যরা ‘গরবা’ (মেহমান) আওয়ামী লীগ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “তারা বঙ্গবন্ধুর ঘরে আশ্রয় নিয়ে সে ঘরে আগুন দিচ্ছে। তারা সময়ে নিরব, অসময়ে সরব। দলের সম্মান নিয়ে তারা চিন্তিত নন। পরে প্রয়োজনে তারা অন্য দলে চলে যাবেন।”
তবে পাল্টাপাল্টি এ অবস্থানকে ‘বিভক্তি’ মানতে নারাজ সুজন।
“আমাদের রাজনীতির মূল ভিত্তি বঙ্গবন্ধু। জাতির জনকের অপমান সহ্য করা হবে না। অতীতে দলকে যারা ক্ষতিগ্রস্ত করতে চেয়েছে তারা ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে; এরাও হবে।”
সিটি মেয়র নাছির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যা হচ্ছে তা ভালো হচ্ছে না। এটা হেলদি প্র্যাকটিস না। দলের জন্যও ভালো না। সবারই দায়িত্বশীল আচরণ করা উচিত।”
নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও ব্যক্তি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃতির বিষয়ে মত জানতে চাইলে তিনি বলেন, “দলীয় ফোরামে আলোচনা হলে অবস্থান ব্যক্ত করতাম। তার আগেই অনেকে এ বিষয়ে মুখ খুলে ফেলেছেন; অবস্থান নিয়েছেন। এখন আমার ব্যক্তিগত মত দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।”
ওই ঘটনায় আদালতে মামলার প্রসঙ্গ তুলে নাছির বলেন, “প্রচলিত আইনে দোষীদের বিচার হবে। আর যার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তিনি সাংসদ। এখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার সংসদীয় দলের নেতা ও প্রধানমন্ত্রীর। তিনি যে সিদ্ধান্ত নেবেন তাই চূড়ান্ত।”
জাতির জনকের ছবি বিকৃতিকারীদের বিচার চান কি না- জানতে চাইলে আফসারুল আমিন বলেন, বঙ্গবন্ধুর কারো একার নন। তিনি ১৬ কোটি মানুষের।
“যারা ছবি বিকৃত করেছে বলে স্বীকার করেছে, পত্রিকায় যাদের নাম এসেছে তাদের বিচার দেশের প্রচলিত আইনেই হবে।”
৩০ জানুয়ারি লতিফকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃতির বির্তক ওঠার পর চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের দলীয় কোনো কর্মসূচি বা সভা হয়নি।