Published : 31 Dec 2024, 01:21 PM
গত অগাস্টের শেষে যখন সবজির আগাম চাষ শুরুর সময়- তখন বন্যার পানিতে ডুবেছিল চট্টগ্রামের কৃষি জমি। সেই পানি সরে যাওয়ার পর ক্ষেত প্রস্তুত করতে লেগেছে মাসখানেক সময়। সেই কারণে শীতকালীন সবজি উঠছে ভরা মৌসুমে, তাতে প্রত্যাশিত দাম পাচ্ছেন না চাষিরা।
অবশ্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে সবজি চাষ হবে এবার জেলায়। আর ফলন ভালো হওয়ায় কৃষক তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
তবে কৃষকরা বলছে, সরকারি প্রণোদনা পেলে তাদের পক্ষে বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সহজ হতো। ফলন দেরিতে হওয়ায় দাম খুব একটা মিলছে না।
বাজারে এখন শীতকালীন সবজির সরবরাহ প্রচুর; টানা দু-তিন সপ্তাহ ধরে কমছে দামও। কৃষকদের আশঙ্কা, দাম আরো কমতে পারে। তেমনটা হলে খরচ উঠিয়ে আনা কঠিন হবে।
অগাস্টের শেষে টানা ভারি বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলার ১২ উপজেলাই কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তার মধ্যে মীরসরাই, ফটিকছড়ি, সীতাকুণ্ড, লোহাগাড়া, সাতকানিয়া, বাঁশখালী ও চন্দনাইশ- এ সাত উপজেলায় তলিয়ে যায় ১ হাজার ৯২২ হেক্টর সবজি ক্ষেত।
বন্যায় চট্টগ্রামে মোট ২২৭২ হেক্টর সবজির জমি তলিয়ে প্রায় ১০৮ কোটি ১৬ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছিল বলে তখন জানিয়েছিল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হন ২২ হাজার ৬৫০ জন কৃষক।
সাধারণত মধ্য অগাস্ট থেকে মধ্য সেপ্টেম্বরের মধ্যে আগাম রবিশস্য হিসেবে ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, বেগুন, কুমড়া, লাউ ও ওলকপির জন্য জমি তৈরি ও চারা রোপণ করা হয়।
কিন্তু এবার জমিতে পানি থাকায় ক্ষেত প্রস্তুত করতে হয়েছে মাসখানেক সময় বাদে। তাতে আগাম সবজির বাজার ধরতে পারেনি ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা।
সীতাকুণ্ডের বারআউলিয়া ইউনিয়নের মধ্যম সোনাইছড়ি গ্রামের কৃষক বেলাল হোসেন অগাস্টেই সবজির চারা লাগিয়েছিলেন নিজের জমিতে। কিন্তু পানিতে তার পুরো ক্ষেত নষ্ট হয়।
বেলাল হোসেন বলেন, “জমিতে পানি ছিল। পানি নামার পর জমি তৈরি করতে আরো এক মাস লেগে যায়। তারপর লাউ, করলা ও চিচিঙ্গা লাগাই। অক্টোবরে যদি ফসল উঠতো দাম ভালো পেতাম। তখন বাজারে ছিল উত্তরবঙ্গের সবজি।
“কিন্তু চারা লাগাতে দেরি হওয়ায় আমাদের ফসল উঠতেছে এখন। বাজারে এখন প্রচুর সবজি। দাম একদম কম।”
তিনি বলেন, “প্রতি পিস লাউ ১০-১৫ টাকা মাত্র। ৪০ পিস লাউ বিক্রি করেছি ১২ টাকা পিস দরে। চিচিঙ্গার কেজি ২৫-৩০ টাকা। টমেটো আর শিম এখনো বেচতে পারি নাই।
“টমেটো পাকেনি। শিমে ফুল আসছে মাত্র। আগামী মাসে শিম বেচতে পারব।”
অনেক দূর থেকে পানি এনে দিতে হয় বলে শিমের ক্ষেতে বেশি পানি দিতে পারছেন না জানিয়ে বেলাল হোসেন বলেন, “পানি দিতে পারলে বেশি শিম পেতাম। কিন্তু দূর থেকে পানি আনতে খরচ বেশি হয়ে যায়।”
সীতাকুণ্ড উপজেলা শিম চাষের জন্য সুপরিচিত, এ উপজেলায় শীতকালীন সবজির মধ্যে শিমই বেশি চাষ হয়।
সীতাকুণ্ড উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হাবিবুল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এবার শিম আবাদ হয়েছে ২৫০০ হেক্টর জমিতে, আর অন্যান্য শীতকালীন সবজি আবাদ হয়েছে ১৫৫০ হেক্টর জমিতে।
“সবজি চাষে এখন কৃষক বেশি আগ্রহী। আগাম সবজিতে ভালো দাম পাওয়া যায়। আর শীতকালীন সবজি প্রায় প্রতিদিন তুলে বিক্রি করা যায় বলে দৈনিক আয়ের আশায় কৃষক বেশি উৎসাহী। তাই বেশি পরিমাণ জমিতে এখন সবজি চাষ হয়। এবার ফলনও ভালো।”
কৃষি কর্মকর্তা হাবিবুল্লাহ জানান, সবজি ভেদে প্রতি হেক্টরে উৎপাদন হয় গড়ে ১৫ টন থেকে ২০ টন পর্যন্ত।
সবজির জন্য চন্দনাইশ উপজেলার শঙ্খ নদীর চরের খ্যাতি পুরো জেলায়। এবার চরে ফলনও হয়েছে বেশ। কিন্তু দাম কমতে থাকায় শঙ্কিত সেখানকার চাষিরা।
দোহাজারী এলাকায় শঙ্খের চরে প্রায় ৫ কানি (১ কানিতে প্রায় ৪০ শতক) জমিতে টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, মরিচ, মুলা, ধনেপাতা, বেগুন ও শিম চাষ করেছেন মারুফ।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এবার বন্যার পর সবজির ফলন হয়েছে ব্যাপক। কিন্তু দামের অবস্থা খুব খারাপের দিকে। শুরুতে করলা বিক্রি করেছিলাম ৭০-৮০ টাকা কেজি দরে। তখন কিছু দাম পাইছি।
“এখন বেগুন ১৮-২০ টাকা কেজি আর শিম বিক্রি করতে হচ্ছে ৩০-৩৫ টাকা কেজি দরে। বন্যায় জমি ডুবে গেছিল। কিন্তু সরকারি কোনো সুবিধা আমরা পাইনি। এবার সারের দামও বাড়তি। শুধু ফসফেট সারের দামই কেজিতে ৫ টাকা বেড়েছে।”
চন্দনাইশের পাশের উপজেলা সাতকানিয়ার উত্তর কালিয়াইশ গ্রামের কৃষক হাসান বলেন, ৫ কানি জমিতে তার প্রায় তিন লাখ টাকা খরচ হয়েছে। শঙ্খ নদী থেকে প্রায় হাজার-বারোশ ফুট দূরের জমিতে পাইপ দিয়ে পানি আনতে হয়। পাম্প মেশিন তার নিজের।
“তেলের খরচ অনেক হয়ে যায়। একজন কামলার দৈনিক বেতন ৮০০ টাকা এখন। আর একশ কেজি মুলা বিক্রি হচ্ছে ৭০০-৯০০ টাকায়। ফুলকপির কেজি ১৫ টাকা। কোনো সরকারি প্রণোদনা আমি পাইনি। সব নিজের খরচে করতে হয়েছে। সামনে দাম আরো কমবে। নিজের ক্ষেতের ফসল ফেলে যেতে পারছি না বলে ক্ষেতে পড়ে আছি।”
চন্দনাইশ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আমজাদ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এবার সবজি চাষের লক্ষ্যমাত্রা ২২৫৪ হেক্টর। শিম, আলু, ফুলকপি, বাঁধাকপিসহ বিভিন্ন সবজি আবাদ চলমান। এখন পর্যন্ত ১৮০০ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হয়েছে।
“বৃষ্টির ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য সবজিতে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে ৪৬০০ জন কৃষককে। প্রণোদনা সহায়তা হিসেবে ছিল বিভিন্ন সবজির বীজ, রাসায়নিক সার; আর্থিক সহায়তা হিসেবে প্রত্যেক কৃষককে এক হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে।”
চট্টগ্রাম জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আবদুচ ছোবহান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মৌসুমের শুরুতে চট্টগ্রামে বাইরে থেকে সবজি এসেছে। হয়ত আগাম সবজি চাষ শুরু করা গেলে, তখন বাইরে থেকে সবজি কম আসত।
“তবে এবার চট্টগ্রামে সবজির ফলন খুব ভালো হয়েছে। কৃষক দামও পাচ্ছে বাজারে। আয়ের পাশাপাশি নিজের পরিবারের পুষ্টির নিশ্চয়তা হয়, তাই সবজি চাষে আগ্রহ বেড়েছে।”
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তসহ জেলার মোট ৬৬ হাজার কৃষক এবার সবজি চাষের জন্য প্রণোদনা পেয়েছেন জানিয়ে কৃষি কর্মকর্তা ছোবহান বলেন, “জেলায় এবার সবজি চাষের লক্ষ্যমাত্রা ৩৩ হাজার ১৫৫ হেক্টর। লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি চাষ হয়ে গেছে। আগামী মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত নানা রকম সবজি লাগানো হবে।”
লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে-এমন আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, গত দুই দশকে চট্টগ্রামে সবজি চাষের জমির পরিমাণ বেড়েছে প্রায় তিনগুণ।