ঢালু পাহাড়ি রাস্তা আর অপ্রশস্ত সড়কে ঘন ঘন বাঁক; ঈদের ছুটির মৌসুমে অন্য জেলা থেকে আসা চালকরা অচেনা এ সড়কে দুর্ঘটনায় পড়ছেন।
Published : 02 Apr 2025, 04:48 PM
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চুনতি জাঙ্গালিয়া এলাকায় মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় তিন দুর্ঘটনায় ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে; আহত হয়েছেন অন্তত ৩০ জন।
গাড়ি চালক, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, ওই এলাকার উঁচু-নিচু সড়কে বাঁকগুলো খুব বিপদজনক। ঈদের ছুটির মৌসুমে দেশের অন্যান্য জেলা থেকে আসা চালকরা অপ্রশস্ত এ অচেনা সড়কে দুর্ঘটনায় পড়ছেন।
বারবার দুর্ঘটনা ঘটায় সেখানকার সড়ক সংস্কার ও প্রশস্ত করার দাবি তুলেছেন স্থানীয়রা।
লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি জাঙ্গালিয়া এলাকাটি চট্টগ্রাম থেকে ৭৫ কিলোমিটার দূরে। কাছেই চুনতি অভয়ারণ্য সংলগ্ন বন বিটের একটি অফিস আছে।
জাঙ্গালিয়ার এ অংশে প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ঢালু পাহাড়ি সড়ক। এর মধ্যে কয়েকটি বিপদজনক বাঁক আছে। সারা বছরই সড়কের এ অংশে দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়।
স্থানীয়দের ভাষ্য, জাঙ্গালিয়া ও আশেপাশের অংশের সড়কে সকালের দিকে এবং সন্ধ্যার পর দুর্ঘটনা বেশি ঘটে।
ঈদের একদিন বাদে বুধবার সকালে যাত্রী নিয়ে কক্সবাজারের দিকে যাচ্ছিল একটি মাইক্রোবাস। অন্যদিকে কক্সবাজার থেকে যাত্রী নিয়ে চট্টগ্রামে যাচ্ছিল রিলাক্স পরিবহনের একটি বাস।
সকাল সোয়া ৭টার দিকে দুই বাহনের মুখোমুখি সংঘর্ষে মাইক্রোবাসের ১০ আরোহীর মৃত্যু হয়।
দুর্ঘটনার পর রিলাক্স বাসের যাত্রী মতিন মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, সেখানে বাঁক নেওয়ার সময় বাসের চালক নিয়ন্ত্রণ হারান। পরে ব্রেক করতে গিয়ে মাইক্রোবাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়।
যে স্থানে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে, সেখান থেকে মাত্র ৩০-৩৫ গজ দূরে ঈদের দিন সকালে বাস ও মিনিবাসের সংঘর্ষে ৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
পরদিন কাছাকাছি এলাকায় দুটি মাইক্রোবাস সড়ক থেকে উল্টে পাশের খাদে পড়ে গেলে ১২ জন আহত হন।
একই এলাকায় বারবার দুর্ঘটনার কারণ জানতে চাইলে লোহাগাড়া থানার ওসি আরিফুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর বলেন, “প্রথমত বলতে চাই বেপরোয়া গাড়ি চালাচ্ছে। দ্বিতীয়ত রাস্তায় এক ধরনের লবণ পানি হচ্ছে, যার কারণে স্লিপারি হয়ে যাচ্ছে। যে মুহূর্তে ব্রেক করে, সাথে সাথে দুর্ঘটনা ঘটে।
“পাশাপাশি এখানে যে রোড ইঞ্জিনিয়ারিং, যে বাঁকটা আছে, সেটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা দরকার।”
লোহাগাড়ার স্থানীয় সাংবাদিক কায়সার হামিদ মনে করেন, চুনতি জাঙ্গালিয়া এলাকার উঁচু-নিচু পাহাড়ি সড়ক এবং বাঁক পর্যটকদের নিয়ে আসা অন্য জেলার চালকদের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
“ঈদের ছুটিতে বাইরের জেলার চালকরা বেশি আসেন। কিন্তু তারা এই সড়কে গাড়ি চালিয়ে অভ্যস্ত নন। অনেক চালক গতিও বেশি তোলেন। পর্যটকদের উচিত মাইক্রোবাস বা ছোট গাড়ির পরিবর্তে ঢাকা থেকে বা চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার রুটে চলাচলকারী বাসে ভ্রমণ করা।”
বুধবার সকালে দুর্ঘটনার পর সৃষ্টি হওয়া যানজটে আটকা পড়েছিলেন এই পথে নিয়মিত চলাচলকারী মার্শা পরিবহনের বাসের চালক আবদুল আজিজ।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এই অংশে রাস্তা সামান্য ঢালু এবং অনেক বাঁক আছে। এছাড়া কক্সবাজার থেকে লবণের ট্রাক ও কাদামাটি নিয়ে ডাম্প ট্রাক আসে। তাই সকালের দিকে রাস্তা লবণের পানি ও কাদায় পিচ্ছিল থাকে।
“আমরা যারা নিয়মিত এই রুটে গাড়ি চালাই, তারা সতর্ক থাকি। কিন্তু ট্যুরিস্ট নিয়ে যেসব গাড়ি বাইরে থেকে আসে, সেসব গাড়ির চালক এখানে অভ্যস্ত না। গত তিন দিনের সবগুলো দুর্ঘটনায় বাইরের কোনো না কোনো গাড়ি ছিল।”
সড়কের বাঁক অপসারণের দাবি জানিয়ে চালক আবদুল আজিজ বলেন, বাঁকের কারণে ছোট গাড়িকে রক্ষা করতে গিয়ে অনেকসময় বড় গাড়ির চালকরা দুর্ঘটনায় পড়েন।
বুধবারের দুর্ঘটনার পর উদ্ধার কাজে অংশ নেওয়া হাইওয়ে থানার এসআই মো. আব্দুল মতিন বলেন, “ঈদের দিন সকালে যেখানে দুর্ঘটনা ঘটে তার ৩০-৩৫ গজের মধ্যে আজকের দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। রাস্তার ওই অংশ পাহাড়ি ঢালু এবং টার্নিং আছে। এছাড়া কক্সবাজার থেকে লবণের গাড়ি এই সড়কে চলাচল করে। সেসব গাড়ি থেকে রাস্তায় লবণের পানি পড়ে।
“অন্য জেলার চালকরা এখানকার রাস্তা সম্পর্কে এতকিছু জানেন না।”
ফায়ার সার্ভিসের লোহাগাড়া স্টেশনের লিডার রাখাল চন্দ্র রুদ্র বলেন, “দুর্ঘটনাস্থলের আশেপাশের রাস্তা আঁকাবাঁকা। এখানে গতিরোধক থাকলে হয়ত ভালো হত।”
কক্সবাজারে এমনিতেই পর্যটকদের আনাগোনা থাকে। ঈদের ছুটিতে পর্যটকবাহী গাড়ির সংখ্যা যে অনেক বেড়েছে, সে কথা তুলে ধরলেন আরাকান সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. মুসা।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “গাড়ির চাপ থাকলেও সড়কটি প্রশস্ত হয়নি। মহাসড়ক বললেও এটা আসলে মহাসড়ক না। বেশিরভাগ অংশে সড়ক মাত্র ২ লাইন।
“রাস্তা প্রশস্ত করা খুব জরুরি। প্রশাসন ও সরকারের উদ্যোগ দরকার।”
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কের জাঙ্গালিয়া, চকরিয়ার কচ্ছপিয়া এবং বানিয়াছড়া ঢালা এই তিন স্থান খুবই ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানালেন সড়ক পরিবহন শ্রমিক নেতা মো. মুসা।
তিনি বলেন, “এই অংশে বাঁক অনেক বেশি। বাঁক অপসারণ করা জরুরি। চট্টগ্রাম কক্সবাজার মহাসড়ক জুড়ে অনেক বাঁক। পুরো মহাসড়কটি চার লেইন করা দরকার।”
লোহাগাড়া উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ফরিদ উদ্দিন খান ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, “এই এলাকায় আমার বাড়ি। ছোটবেলা থেকে আমি এখানে বড় হয়েছি। এখানে বারবার দুর্ঘটনার মূল কারণ এই সড়কটি সংকীর্ণ। প্রতিদিন হাজার হাজার গাড়ি চলে। তা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
“যতদিন ৬ লেইনের রাস্তা করা না হবে, দুর্ঘটনা হবে। ৬ লেইন করে অবশ্যই মাঝে ডিভাইডার দিতে হবে। পরবর্তী একনেক সভায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক ৬ লেইন করার বিষয়টি অনুমোদন দিতে হবে। তা না হলে আমরা এখানে মানববন্ধন, বিক্ষোভ ও হরতাল দিতে বাধ্য হব।”
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে লোহাগাড়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইনামুল হাছান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জাঙ্গালিয়ার ওই অংশে এবং আশেপাশে সড়ক উঁচু-নিচু এবং আঁকাবাঁকা। দুর্ঘটনার খবর শুনে উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বীর প্রতীক আজ বিকেলে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসবেন বলে জানিয়েছেন।
“মহাসড়কের ওই অংশে কয়েক কিলোমিটার সড়কের বাঁক অপসারণ করে সোজা করা যায় কিনা সে বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের চেষ্টা করছি। উপদেষ্টা মহোদয় পরিদর্শনের পর হয়ত এ বিষয়ে নির্দেশনা দেবেন।”
লোহাগাড়ার দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে চার জন এক পরিবারের
চট্টগ্রামে বাস-মাইক্রোবাস সংঘর্ষ: মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১০