বিভিন্ন সংগঠনের ত্রাণের গাড়ি দেখা গেলেও সেগুলো মূল সড়কেই থাকছিল, স্থানীয়রা পানি ভেঙে এসে মূল সড়কে দাঁড়িয়ে ছিলেন ত্রাণের আশায়।
Published : 27 Aug 2024, 11:45 PM
আগে কখনও পানি ওঠেনি ঘরে, সে চিন্তা থেকে তেমন কোনো প্রস্তুতিও ছিল না। কিন্তু হঠাৎ পনি ঢুকে অল্প সময়ের মধ্যে ঘর ডুবে যাওয়ায় প্রাণ বাঁচাতে প্রতিবেশীর পাকা ভবনে আশ্রয় নিয়েছিলেন ফেনীর সোনাগাজীর রহিমা খাতুন।
চারদিন পর সোমবার বিকাল থেকে পানি কমতে শুরু হলে মঙ্গলবার ঘরে ফিরে রহিমা দেখেন, কোনো কিছুই আগের মত নেই। গোলাভরা ধান, ঘরে পালা হাঁস-মুরগী সবকিছুই ভেসে গেছে বানের জলে।
গত চার দিন প্রতিবেশীর ঘরে কয়েক বেলা আহার জুটলেও ঘরে ফিরে বিপদ বেড়েছে মধ্যবয়সী এই নারীর। আশ্রয় কেন্দ্রে গিয়ে অনেকে ত্রাণ পেলেও মানুষের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়ায় তার কপালে ত্রাণও জোটেনি সেভাবে।
মঙ্গলবার সোনাগাজী উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে রহিমার মত আশ্রয় কেন্দ্র ছেড়ে ঘরে ফেরা বানভাসী মানুষগুলোর দুর্দাশার এমন চিত্রই দেখা গেছে।
উপজেলার মতিগঞ্জ ইউনিয়নের সুলাগালী গ্রামে দেখা যায় সড়কের সামনে বসে আছেন রহিমা। এক গ্রাম পুলিশ সদস্যকে দেখে সাহায্যের আশায় তাকে ডাকতে থাকেন। ত্রাণের তালিকায় যেন তার নামটা লেখা হয়, সেই অনুরোধ করেন।
রহিমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গতকাল ঢাকা থেকে কিছু লোক ত্রাণের ট্রাক নিয়ে এসেছিল। ত্রাণ চাইলে তারা এক প্যাকেট বিস্কুট আর অল্প মুড়ি দিছে। সেগুলো খেয়েছিলাম। এক লোকের কাছ থেকে ১০০ টাকা চেয়ে নিয়েছিলাম, সেগুলো দিয়ে কিছু কিনছি।”
রহিমার বাড়ির সামনে গিয়ে দেখা যায় ঘরে প্রবেশের রাস্তায় কোমর সমান পানি, উঠানে আরও ঘরের ভেতরেও হাঁটুপানি জমে আছে। একটু উঁচু জায়গায় ইট দিয়ে চুলা বানিয়ে ভাত রান্না করতে দিয়েছেন। শুধু ওই ভাত, আর কিছুই তার জোটেনি।
একই অবস্থা দেখা যায় গ্রামের আন্যান্য বাড়িতেও। সড়কে কোথাও হাঁটু পানি, আবার কোথাও পায়ের গোড়ালি সমান পানি।
পলি আক্তার নামে এক তরুণী সাংবাদিক দেখে এগিয়ে এসে বলতে থাকেন, তার নামটা যেন লেখা হয় ত্রাণের জন্য।
পলি জানালেন, তিন মাস আগে তার বাবা মারা গেছেন, ঘরে মা অসুস্থ। মানুষের বাসায় কাজ করে চলেন। বন্যা কবলিত ঘর দেখিয়ে বললেন, ভেতরে হাঁটু সমান পানি। কিছুই নেই রান্নার, দুই দিন আগে কিছু শুকনো ত্রাণ পেলেও সেগুলো শেষ।
ত্রাণের জন্য হাহাকার
ফেনীর বিভিন্ন অঞ্চলে গত সোমবার সন্ধ্যা থেকেই বানের পানি ঢুকতে শুরু করেছিল। তবে সোনাগাজী উপজেলার গ্রামগুলো তলিয়েছে শুক্রবার থেকে।
স্থানীয়রা জানান, উপজেলার মূল সড়কের বিভিন্ন জায়গায় হাঁটু থেকে কোমর সমান পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল। সোমবার বিকালের পর থেকে পানি নামা শুরু হয়েছে।
মঙ্গলবার ফেনীর লালপোল থেকে সোনাগাজী উপজেলার সড়কে প্রবেশের সময় বিভিন্ন স্থানে পানি দেখা গেলেও বিকালে পানি ছিল শুধু দুই জায়গায়। তবে গ্রামের বিভিন্ন সড়কে কোথাও হাঁটু আবার কোথাও কোমর সমান পানি দেখা গেছে বিকালের পরও। পানি ছিল বসত বাড়িগুলোতেও।
ওই এলাকায় বিভিন্ন সংগঠনের ত্রাণের গাড়ি দেখা গেলেও সেগুলো মূল সড়কেই থাকছিল, ভেতরে প্রবেশ করছিল না। স্থানীয়রা পানি ভেঙে এসে মূল সড়কে দাঁড়িয়ে ছিলেন ত্রাণের আশায়।
গাড়ি দেখলেই তারা হাত নাড়াচ্ছিলেন। কোনো কোনো গাড়ি থেকে কিছু ত্রাণ দেওয়া হলেও কিছু গাড়ি চলে যায় অন্য কোনো গন্তব্যে।
উপজেলার সোনাপুর বাজারে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন নারী বাজারের সড়কে দাঁড়িয়ে আছেন ত্রাণের আশায়। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তাদের আবার ফিরে যেতেও দেখা গেল।
আমিরাবাদ ইউনিয়নের চরডুব্বা গ্রামে নানা বয়েসী কিছু নারী পানি ভেঙে গ্রামের সড়ক দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। কোথায় গিয়েছিলেন জানতে চাইতেই সবাই ঘিরে ধরে বলতে লাগলেন, তাদের নামগুলো যেন একটু লেখা হয়। ঘরে রান্নার কিছুই নেই। ত্রাণও পাচ্ছেন না।
হাজেরা বেগম, মনোয়ারা বেগম নামে দুই নারী জানালেন, শুক্রবার পানিতে ঘর তলিয়ে যাওয়ার পর তারা স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানে জুটেছিল কিছু শুকনো খাবার।
পানি কমে আসায় চার দিন পর সোমবার তারা বাড়ি এসেছেন। কিন্তু তারপর থেকে আর ত্রাণ তারা পাননি। তাদের ঘরেও রান্নার কিছু নেই।
সুলাগালী গ্রামের আশ্রয়কেন্দ্রেও একই পরিস্থিতি দেখা গেল। সেখানে কয়েকজন দাবি করলেন, তারা গত পাঁচদিন ধরে আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করলেও ত্রাণ পেয়েছেন মাত্র একবার। ফলে তাদের অনাহারে দিন কাটাতে হচ্ছে।
ঘুরে দাঁড়ানোর নতুন চ্যালেঞ্জ
সুলাগালী গ্রামের মাসুদা বেগমের জীবন চলে মানুষের বাড়িতে কাজ করে। সাত বছর বয়েসী দুই যমজ মেয়ে আর ১২ বছর বয়েসী এক ছেলেকে নিয়ে তার সংসার।
মাসুদা বললেন, ঘরে পানি উঠে তার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। শুক্রবার তিনি ছেলেমেয়েকে নিয়ে এক প্রতিবেশীর পাকা ভবনে আশ্রয় নিয়েছেন। ঘরে ফিরে দেখেন, সব শেষ।
পানি নামতে শুরু করার পর ঘোর অনিশ্চয়তায় পড়া এই নারী বলেন, “মানুষের ঘরে কাজ করে খাই। তিন সন্তান নিয়ে এখন কী করবে চলব সেটাই বুঝতে পারছি না।”
মাসুদার মত একই কথা গ্রামের নিম্ন আয়ের লোকজনগুলোর।
আশ্রয়ন প্রকল্পের সব ঘর পানির নিচে
সুলাগীল এলাকায় বিগত সরকারের আমলে গৃহ ও ভূমিহীনদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছিল জিৎপুর আশ্রয়ন প্রকল্প। সেখানে আশ্রয় মিলেছিল ২৬টি গৃহহীন পরিবারের। সেখানেই থাকেন নুরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস।
জান্নাতুল জানান, তার স্বামী রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। মাস দশেক আগে সরকারের কাছ থেকে নতুন ঘর পেয়ে সেখানে উঠেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ বন্যায় তাদের সাজানো ঘরের সবকিছুই শেষ।
“পানি বেড়ে যাওয়ায় আমার বাবার বাড়িতে এসেছিলাম। সেটাও পানির নিচে তলিয়ে গেছে। সেখানে এক প্রতিবেশীর পাকা ঘরে আশ্রয় নিয়েছি। ত্রাণ পাইনি… একেতো খাবার কষ্ট, তার উপর কীভাবে আবার সবকিছু গুছিয়ে নেব সেটা নিয়ে চিন্তায় আছি। এত টাকা কীভাবে পাব, কিছু ভাবতে পারছি না।”